১.
সকাল থেকেই আকাশের ভাবভঙ্গি কেমন যেন খাপছাড়া মনে হচ্ছে। ভোর ভোর সময়ে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছিলো, এখন আবার মেঘলা আকাশে রোদ উঠেছে, ভ্যাপসা ধরণের গরম চারপাশে। বৃষ্টির মধ্যেই সকালে একটা কাজে বের হতে হয়েছিলো, ছাতা ছাড়া উপায় ছিলোনা। এখন রোদ উঠেছে, ছাতাটা কোনো কাজেই লাগছেনা। বাড়তি একটা বোঝা নিয়ে চলা। এমনিতেই এক হাত ক্রাচে থাকে সবসময়, আরেকহাতে ছাতা, দুই হাতই আটকে গিয়েছে পুরোপুরি। নাকে মাছি বসলেও তাড়ানো যাবে না, অবস্থা এরকম দাঁড়িয়েছে।
যাচ্ছি নতুন ঢাকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত পুরাণ ঢাকার দিকে। অনেকদিন হয়েছে আগামসি লেন, আগাসিদ্দিক লেনের গলিঘুঁজিতে যাওয়া হচ্ছেনা। যদিও গলি কখনোই ঘুরে বেড়ানোর জন্যে ভালো সিদ্ধান্ত না, তবুও এই জায়গাগুলোতে এলে কেমন যেন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। গলি ধরে হাঁটলে ষাট-সত্তর বছরের প্রাচীন দোকানগুলোর "প্রাগৈতিহাসিক" ফ্লেভার পাওয়া যায়, মাঝেমাঝে মোঘলাই খাবারের দোকান, বিরিয়ানি, কাবাবের গন্ধ। মধ্যযুগীয় রেডিওতে হিন্দি গান "হাওয়ামে উড়তা যায়ে মেরে লাল দোপাট্টা"... এ এক অদ্ভুত মিশ্রণ। বিষয়টা অনুভবের, অনুভব করতে না পারলে সমস্যা। যদিও, আমার মত ক্রাচমানবদের জন্যে পুরাণ ঢাকার গলি, উপগলি'র মধ্যে চলাফেরা করার বিষয়টা সহজ না, তবে অসম্ভবও না।
সকালে যে কাজে বেরিয়েছিলাম সেটা খুব তাড়াতাড়িই হয়ে যাওয়াতে এই আকস্মিক সফরে যাওয়া হচ্ছে। এমনিতে সারাদিন প্রায় ঘরেই বসে থাকি। বই পড়ে বা মাঝেমধ্যে টিভি দেখেই দিন কেটে যায়। মোবাইল ব্যবহার করতে পারিনা। বাসায় একটা "এন্টিক" টেলিফোনসেট আছে। প্রায়সময়েই, টেলিফোন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। আমি কাউকে কল দিইনা, কদাচিৎ আমার কাছে দুই একটা কল আসলেও, বেশিরভাগই রং নাম্বার।
২.
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এদিকটায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। শিক্ষার্থীরা হলের দাবীতে বিক্ষোভ করেছে। বয়সটা আর আগের মত নেই, নাহলে হয়তো বিক্ষোভের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতাম। ধীরপায়ে হট্টগোল থেকে সরে আসি। বাহাদুরশাহ পার্কের ভেতরে কোণার ছোট্ট একটা বেঞ্চিতে বসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে কয়েকটা ট্যাবলেটের ফাইল বের করলাম। ঘড়িতে ১০.৩০ বেজেছে, ওষুধ খেতে হবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানা রোগের সম্মেলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছি। আজকাল, হয়তো অক্সিজেন ছাড়াও দু'একদিন চালানো যাবে, ওষুধ ছাড়া এক বেলাও না। পার্কের এক পানিবিক্রেতার কাছ থেকে পানি কিনে ওষুধগুলো গিললাম।
সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি, ভারি কিছু খেতেও ইচ্ছে করছেনা। ঝালমুড়ি বা চানাচুরওয়ালা টাইপের কাউকে আশেপাশে দেখছি না। আজকাল পার্কে এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে নাকি!
দূরে একটা বাদামওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে, বাদাম টাইমপাসের জন্যে আদর্শ খাবার, কিন্তু, এখন বাদাম ভাঙ্গতে ইচ্ছে করছেনা। তারচেয়ে ওঠা যাক। কিন্তু যাবো কোথায়! তাঁতিবাজার যাওয়া যায়, বংশাল যাওয়া যায় আবার গুলিস্তান পেরিয়ে টিকাটুলিও যাওয়া যায়।
সাতপাঁচ ভেবে আগামসি লেনে যাওয়াই স্থির করলাম, ওখানে নান্না মেটালের পাশে একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো, বিছমিল্লাহ বিরিয়ানি ঘর। ভালো লটপটি করতো, সাথে তাওয়াগরম নানরুটি। সেদিকেই যাওয়া যাক... রোদ আস্তে আস্তে চড়ছে।
৩.
আগামসি লেনের একটু সামনে হাতের ডানপাশে একটা সংকীর্ণ সড়ক, সড়কের বামপাশে একটা মাঝারি আকারের বটগাছের গোড়ায় পান বেঁচতো ফজলে হোসেন। আমাকে দেখলেই এক খিলি পান ফ্রি তে খাওয়াতো, মশলাপাতি বেশি দিয়ে। কিন্তু আজ দোকানটা খুঁজে পাচ্ছি না। বটগাছটাও খুঁজে পাচ্ছি না। মস্তিষ্ক কী আমার সাথে প্রতারণ শুরু করে দিলো! করবে নাই বা কেন, সত্তরের ঘরে পা দিয়েছি গত মাসে। এখনো যে হাঁটতে পারছি, এ-ই বড় সৌভাগ্য।
কাছেই একটা কসমেটিকসের অস্থায়ী দোকান। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, বটগাছটার কথা।
- হেই বটগাছ তো বহু আগে ভি কাইটা ফালাইছে
- ফজলে হোসেনের দোকানটা? তার দোকান এখানে ছিলো।
- চাচাজান তো সব বেইচা-বুইচা গ্রামে চইলা গেছে গা। যাউকগা, আপনে ক্যাঠা?
- তুমি চিনবে না আমাকে। ফজলে হোসেন আমাকে চিনতো।
- ও আইচ্ছা। কছমেটিক লাগবো নি, আঙ্কেল?
- না, ঠিক আছে।
নান্না মেটালের পাশে "বিছমিল্লাহ বিরিয়ানি ঘর" বহাল তবিয়তেই আছে। দোকানের ভেতরটা মোটামুটি জনাকীর্ণ। আমাকে দেখে কয়েকজন সরে জায়গা করে দিলো। এক হাতে ক্রাচ আর আরেক হাতে ছাতা নিয়ে সাবধানে ঢুকলাম। মাঝামাঝি এক টেবিলে বসলাম। এক পিচ্চি এসে টেবিল পরিষ্কার করে অর্ডার নিয়ে গেলো। দোকান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। আজকাল, চশমার চোখে চারপাশ দেখতে হয়। দোকানের চারপাশ আগের মতই আছে, খুব একটা বদলায় নি। আগের ফোল্ডিং চেয়ারগুলোর জায়গায় এখন প্লাস্টিকের চেয়ার এসেছে, এই যা। এক টেবিলের কোণায় দেখলাম, অস্পষ্ট হওয়া কালিতে "রাশেদ" লেখা।
এক ধাক্কায় ফিরে গেলাম অনেককাল আগে। যখন জগন্নাথ কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের তুখোড় ছাত্র ছিলাম। ক্লাস শেষে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে প্রায়ই এখানে এসে খেতাম। একদিন, কোন কারণে জানি না, কলম খুঁচিয়ে নিজের নামটা লিখে রেখেছিলাম টেবিলের কোণে। নামটা এখনো রয়েছে, নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম।
৪.
নাস্তা দিয়ে গেছে পিচ্চি ছেলেটা। আস্তে আস্তে খাচ্ছি। নড়বড়ে দাঁত দিয়ে যতটা সম্ভব আস্তে আস্তে খেতে হচ্ছে। পাশের টেবিলে একঝাঁক তরুণ খেতে খেতে টেবিলে তর্কের ঝড় উঠিয়েছে গতকালের ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে। আমাদের সময়ে, আমরা ফুটবল নিয়ে তর্ক করতাম, যুগ পাল্টেছে, পাল্টেছে তর্কের বিষয়গুলোও।
খেতে খেতেই টেবিলের অপরপ্রান্তে এক লোক বসলো। সেও নাস্তার অর্ডার দিলো। আমি লোকটার দিকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে নাস্তা খাচ্ছি। হঠাৎ করে, বিদ্যুৎ চমকে গেলো পুরো শরীরে। আমার সামনে যে বসে আছে, তাকে আমি ভালোভাবেই চিনি। জগন্নাথ কলেজে সহপাঠী ছিলাম, একসময় ভালো বন্ধুও ছিলাম। কিন্তু...
অনেক বছর আগের কথাঃ
কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাশেদ তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে তুমুল হট্টগোল করে "বিছমিল্লাহ বিরিয়ানি ঘর" এ ঢুকলো। রাশেদ, তারেক, সালাম। ঢুকেই একটা টেবিল দখল করে বসলো তারা। দুপুর পেরিয়ে বিকেলের দিকে যাচ্ছে সময়। দুপুরে খাওয়া হয়নি, সবাই বিরিয়ানি আর বোরহানির অর্ডার দিলো। খাওয়া চলছে, সাথে তর্কও
রাশেদঃ করিম স্যার তো সবার মাথা খারাপ করে দেবে রে। এগারোটা থেকে ক্লাস শুরু হয়ে আড়াইটা পর্যন্ত ফিজিক্সের বকবক আর কয়েকদিন শুনলে তো মানসিক হাসপাতালের সীট বুক করতে হবে।
সালামঃ তুমি আর কথা বইলোনা, স্যার যা জিজ্ঞেস করে গড়গড় করে বলে দাও, তোমার তো ক্লাসে আরামই লাগার কথা।
রাশেদঃ আমিই তো সব পারি, তুই যে গত ইয়ারলি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি মার্ক পেলি, ভুলে গেছিস?
তারেকঃ থাম, তোরা। কই রে, মোবারক, এতক্ষণ লাগাচ্ছিস কেন? সকালে কিছু খাইনি। তাড়াতাড়ি খাবার আন।
সালামঃ আমার একটু নীলক্ষেত যাওয়া লাগবে, কিছু বই কিনবো। যাবি কেউ আমার সাথে?
রাশেদঃ চল, আমিও যাবো। আমারও যাওয়া দরকার। কয়েকটা হ্যান্ডনোট কিনতে হবে, কাগজও শেষ।
খাওয়া শেষে রাশেদ আর সালাম চলে যায় নীলক্ষেতের দিকে। বাসে উঠে পড়ে তারা। তারেক মেসে চলে যায়। বাস যখন নীলক্ষেত মোড়ের কাছাকাছি তখন বাসের হেল্পার বাস থেকে নামার জন্যে তাড়া দেয় দুইজনকে। সালাম গ্রামের ছেলে, চলন্ত বাস থেকে নামার বিষয়টাতে অতটা অভ্যস্ত না। সে ইতস্তত করে। রাশেদ তখন অধৈর্য হয়ে পড়েছে, সে ছিলো সালামের পেছনে।
হঠাৎই পেছন থেকে ধাক্কা খায় সালাম...
টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পীচের রাস্তায় পড়ে যায় সালাম। বা পায়ের উপর দিয়ে চলে যায় বাসের বলিষ্ঠ চাকা, পা চ্যাপ্টা হয়ে মিশে যায় পীচের রাস্তায়। এরপর থেকে ক্রাচ পরিণত হয় সালামের দেহের অঙ্গে। কোনোদিন সে রাশেদকে ক্ষমা করতে পারেনি ঘটনাটার জন্যে। আর কোনোদিন সে রাশেদের সাথে কথাও বলেনি।
৫.
বর্তমানঃ
আমার সামনের টেবিলে বসে আছে সালাম। চশমার ঘোলাটে কাচের ফাঁক দিয়ে আড়চোখে দেখলাম, সালামের পাশে একটা কাঠের ক্রাচ, দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা। খুব সন্তর্পণে, সালামের অলক্ষ্যে আমি আমার মেটাল ক্রাচকে বেঞ্চের উপরে শুইয়ে দিলাম, সালামকে নিজের দুরবস্থার কথা জানিয়ে আত্মতৃপ্তি দেয়ার মানে হয় না। সালাম চলে গেলে তারপর টেবিল থেকে উঠতে হবে। মাথানিচু করে খেতে থাকি আমি।
সালাম যে আমাকে চিনতে পারেনি, সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। কলেজজীবনের হ্যাংলাপাতলা, ক্লিনশেভড রাশেদের মুখে এখন সফেদ দাঁড়িগোফ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে বলিরেখার দাগ সুস্পষ্ট। তাকে চিনতে পারার কথাও না। আমি সালামকে চিনতে পারি ওর কপালের বিশাল দাগটা দেখে। বাস থেকে যখন সালাম পড়ে যায়, তখন কপাল ফেটে এই দাগের জন্ম। নাহলে, সালামকে চিনতে না পারাটাই বেশি স্বাভাবিক ছিলো।
খাওয়া শেষে সালাম চলে যায়, আমি তখনো মাথানিচু করে রুটি, লটপটির ঝোলে ভিজিয়ে খাচ্ছি। সালাম চলে যাওয়ায় বুক থেকে যেন এক বিরাট দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে। খাওয়া শেষে এক কাপ মালাই চা খেয়ে বিল মিটাতে কাউন্টারে গেলাম।
- আপনার বিল তো দিয়া গেছে।
- কে দিলো?
- সালাম চাচায় দিয়া গেলো। লগে একখান চিঠি ভি দিছে। আজিব লোক, যখন চিঠি লিখতাছিলো, দেখলাম কানতাছে।
কাঁপা কাঁপা হাতে চিরকুট খুলে দেখি, লেখাঃ
ভালো আছিস, রাশেদ?
পরিশিষ্টঃ
আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছে। পাঞ্জাবির পকেটে চিঠিখানা ভরে আস্তে আস্তে রাস্তায় নেমে আসি। বৃষ্টির তোড় ক্রমশ বাড়ছে। আগামসি লেন ভেসে যাচ্ছে বিষণ্ণ তানপুরার মত একটানা বর্ষণে। আমাকে ফিরতে হবে বহুদূর। একটাই আফসোস, অনেকবার চেষ্টা করেছি, তবুও সালামকে কখনো বলা হয়নি, বাসের সেই ধাক্কাটা আমি দিইনি, দিয়েছিলো হেল্পার।
কখনোই বলা হয়নি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:২১