শিমুল।সুন্দর শ্যামবর্ণ । সহসাই কোথায় যেন হারিয়ে যায় নিজের মনের অজান্তেই। মুহূর্তেই আবার ফিরে আসে। বাস্তবতার মাঝে থেকেও ছুটে চলা যন্ত্রমানবদের বেশ কিছু কার্যকলাপ ওর হজম হয় না। নিজেকে স্বপ্নের জগতে দেখতেই বেশি ভালোবাসে। সত্যি বলতে স্বপ্ন দেখতে ও বড্ড বেশি ভালোবাসে। হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পছন্দ করে না। কিন্তু কি করলে মনে প্রশান্তি পাবে তা জানা নেই, তাই অগত্যা দেহের ঘাম ঝরাতে খুব একটা আগ্রহী নয়। বয়স বেড়ে চলেছে। সকলের সাথে মিলে মিশে তাল দিয়ে চলে। এতে নাকি অন্যদের মনে একটু জায়গা করে নেয়া যায়। সে তার ব্যক্তিগত ব্যক্তিত্ব নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়। কারণ ভাত্রিত্ববোধ জেগে থাকলে নাকি ব্যক্তিত্ব বিকিয়ে খুব একটা পকেট গরম করা যায় না। যদিওবা পকেট গরমের কথা ও খুব একটা চিন্তাও করে না। কিন্তু একটা অভ্যাস ওর ছোট বেলা থেকেই রয়েছে, ভবিষ্যতে কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে এমন কথার বা ঘটনার শুরুতেই প্রতিবাদ করে। জাতীয়তাবাদের অনর্থক বুলি না আউড়িয়ে জাতীয়তাবোধ টিকে থাকবে এমন কার্যকলাপ করতে শিমুল কুন্ঠাবোধ করে না। দাম্ভিক এক বন্ধু সেদিন নিজের মোটা অংকের মাইনের বান্ডিল্টাকে হাতপাখা বানিয়ে আপন মনে নিজ মুখমন্ডলে বাতাস করতে করতে এমন কিছু কথা বলছিল যার ভেতর একটা তীব্র মাত্রায় দাম্ভিকতার আঁচ এবং খানেক বাদে অপর আরেক বন্ধুর সাথে বিবাদের সম্ভাবনা টের পেয়ে খুব কৌশলের সাথে ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রন করে নিল শিমুল। বেশ একটা ম্যানেজিং পাওয়ার ওর ভেতর আছে। ব্যাটাকে যখন যে বন্ধু যেখানে নিয়ে যায় ও না করে না। নিজের আর্থিক অনটন কাঊকে প্রকাশ করে না। তাই বলে বিত্তশালীর মত আচরণও করে না। প্রকান্ড আত্মবিশ্বাস আছে এই যুবকটির ভেতর। কারা ওর সাথে কবে খারাপ ব্যবহার করেছে, কবে খোঁচা দিয়ে কথা বলেছে ওসব ও মনে রাখে না। ঘুমের সময় যদি অবচেতন মন থেকে আপনাআপনি ওই বিষাদময় ক্ষুদ্র কোন অধ্যায় চলে আসে তবে সেটাকে ভুলবার জন্য এর বিপরীতে অন্য সুখময় স্বপ্ন দিয়ে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এসব অনর্থক ঘটনা নিয়ে একটা রাতের ঘুম নষ্ট করার কোন মানেই হয়না। তবুও বিষাদের প্রগাঢ়তা সুখের থেকে অনেক বেশি। মাঝে মধ্যে নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হয়ে যায়। মস্তিষ্কে যখন অগ্রহণযোগ্য বিষাদ দাপিয়ে বেড়ায় প্রায়সই রাতের ঘুমটা আর ঘুমানো হয় না বেচারার। সিগারেটের ধুয়ায় ঐ বিষাদ পায়রাদের উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে অবশেষে। মাঝে মধ্যে সফলতা আসে আবার মাঝে মধ্যে পরবর্তী রাতের জন্য দুঃখ গুলো অপেক্ষা করতে থাকে।
মাঝে মধ্যে মনে তীব্র প্রেম জাগে। কার তরে তা শিমুলের নির্দিষ্ট করে জানা নেই। লিস্টে তিনটে মেয়ের প্রতিই সমান অনুভূতি বিদ্যমান। কিন্তু প্রেম করবে না। প্রেমের ধরণ গুলো নাকি তার পছন্দ নয়। আজকালের মেয়েরা নাকি ঐ পার্কে বসে আড্ডা, বিশেষ দিবসে ঘুরতে যাওয়া, শপিং এসবেই বেশি মজা পায়। কিন্তু এর ভেতর একটাও শিমুল করতে রাজি না। শুধু মনে প্রেমানুভূতি জাগিয়ে নিজেকে জীবন্ত রাখার চেষ্টা করে মাঝে মধ্যে। খুব একটা গুরুত্ব দেয়না এই বিশেষ বিষয়টাতে।
এবার কষ্ট করে ২০০০ টাকা জমিয়েছে। একা একাই ঘুরতে যাবে। কোন বন্ধু যদি যেতেও চায় বুকে পাথর চাপা দিয়ে হলেও বন্ধুকে না করবে। বলবে ওর ব্যক্তিগত কিছু কাজ আছে। কিন্তু আজ অব্দি বন্ধুদের ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলেনি শিমুল, তো আজ কিভাবে বলবে?? তাই ভেবেছে কাঊকে কিছু না বলেই চলে যাবে। কোথায় যাবে জানেনা। তবে খুব ভোরে যে আন্তঃনগর ট্রেনটা আসে ওটাতে চড়ে যাবে। তারপর দেখা যাবে ট্রেন তাকে কোথায় নিয়ে যায়।
দূর্বার গতিতে ছুটে চলা ট্রেনের 'ছ' বগির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে ভাবছে কোথায় যাবে? পরক্ষনেই সেই ভাবনাকে দমিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। এভাবে দুটো সিগারেট টানা শেষ। চুপ থেকে এবার ট্রেনের ঝিকঝিক ঝিকঝিক আওয়াজ শুনছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ এই মিউজিকটা কম্পোজ করে রেখেছে। বেশ একটা মজার তাল আছে এই ট্রেন চলার শব্দে।
কিছুবাদেই তাল স্তিমিত হয়ে এল। এবার ট্রেনটা থামবে । স্টপেজ, যাত্রী উঠবে। তাই শৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা করতে দরজা থেকে সরে দাড়ালো শিমুল। বেশ কিছু যাত্রী ঠেলে উঠে গেল ট্রেনের ভেতর। একটা ৫-৬ বছরের বাচ্চা মেয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফেল ফেল করে তাকিয়ে আছে শিমুলের দিকে। ও যেন বুঝতে পারছে না ট্রেনে ওঠা উচিত হবে কি না। মিনিট খানেক পর ট্রেনটা যখন তার ইঞ্জিন পুনরায় চালু করলো শিমুল দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেই মেয়েটার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিল। কিন্তু মেয়েটি তখনো ফেলফেল করে তাকিয়ে আছে শিমুলের দিকে। এবার শিমুল বুঝতে পারছে না মেয়েটি কি আসলেই ট্রেনে উঠতে চায় কি না। তাই বলে হাত টা নাবিয়ে নিল। ট্রেনটা যখনই ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো মেয়েটা দৌড়ে ট্রেনে উঠার চেষ্টা করতে লাগলো, তাই শিমুলও তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বাচ্চা মেয়েটাকে ট্রেনে উঠতে সহযোগিতা করলো। ট্রেনে উঠেই প্রথমে মেয়েটা বলে উঠলো 'থ্যাঙ্ক ইউ'।
মেয়েটার গাঁয়ের জামাটা বেশ ময়লা। ওটার কাধের দিকে খানিকটা ছিঁড়ে গেছে। ইংরেজীতে উত্তর আমরা সাধারণত ভালো জামাকাপড় পড়া মানুষদের কাছ থেকেই শুনে থাকি। মেয়েটার প্রতি তাই খানিকটা আগ্রহ জন্মানো বেশ সাধারণ একটা ব্যাপার আর উদ্দেশ্যহীন কোন যাত্রীর জন্য তা হবে একনাগারে অন্তত ২০ টাকার বাদাম খাবার সমান।মেয়েটি শিমুলের গা ঘেষেই দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট খানেক চুপ থেকে হঠাৎ মেয়েটা শিমুলকে জিজ্ঞেস করে বসলো
- আপনের সিট কুনডা?
-আমার তো কোন সিট নেই।
-ক্যান টিকেট কাডেন নাই?
-না।
-ধুর। আমি আরও ভাবলাম আপনের সিটে একটু আরাম কইরা বমু।আমি অবশ্য আগেই একবার সন্দেহ করসিলাম যে আপনের সিট নাই।
-কিভাবে?
-কারণ আপনের শইল্ল্যে কোন প্রজাপতি বয় নাই।
-মানে?
-যে স্যারগোর সিট থাকে হেগোর শইল্যে একটা নীল রঙের প্রজাপতি থাকে। সিটে বইলে আবার ঐ প্রজাপতি উধাউ হইয়া যায়। হেগোর অনেক টেকাও থাকে।
-বাহ তুই তো অনেক সুন্দর করে কথা বলিস। নাম কি তোর?
-লাভলী।
-বাহ সুন্দর নাম তো। কে রেখেছে তোর এই নাম?
-আমি নিজেই।
-তুই নিজেই নিজের নাম রাখলি?
এবার মেয়েটা শিমুলকে তার লম্বা কাধটা নিচু করে তার মুখের কাছে কান টা আনার ইশারা দিল। আর বলল-
-আমার আসল নাম লাইলি বানু। আমার আব্বায় রাখছে। কিন্তু লাভলী ইংরেজী নাম। এইটা আমার ভালো লাগে। কিন্তু সাবধান কাওরে কইয়েন না কিন্তু। মানসম্মান লইয়া টানাটানি লাইগ্যা যাইব।
কথা শুনে শিমুল হো হো করে হেসে উঠলো। এমন মজার একটা চরিত্রের সন্ধান যে এই উদ্দ্যেশ্যহীন যাত্রা তাকে দেবে এটা সে কল্পনাও করেনি।
-আচ্ছা ঠিক আছে যাও কাওকে বলবো না।
আপনের নাম কি?? মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো।
-শিমুল।
নামডা ভালাই ।। তয় আপনে আমার মত পাল্ডাইয়ালাইতে পারেন নিজের নামটা। আমার কাসে ভালো একটা ইংরেজী নাম আসে।
-আচ্ছা?? কি নাম আছে তোর কাছে শুনি।
- মাইকেল।
-হাহাহা।। এই নাম কোথায় শুনলি?
-ক্যান মাইকেল জিক্সুন এর নাম হুনেন নাই??
-হ্যাঁ শুনেছি তো।
- কি পাল্ডাইবেন নাম??
- না একটু ভেবে চিনতে দেখি।।
- আইচ্ছা আপনের ইচ্ছা।। আইচ্ছা আমি যাই।। সামনের ইস্টিশনে নাইম্যা যামু।
- ক্যান? ঐখানে আমার দাদার সাথেই আমি থাকি।।
-আমি তোর বাড়ি যাবো।
- হাহাহা।। না স্যার আমার বাড়ি গিয়া মজা পাইবেন না।। দম বন্ধ হইয়া যাইব।। এর চেয়ে ভালো নিজ্জের বাড়িতে ফিরা যান।। আর আপনে অনেক ভালা । কিন্তু আপনের মত সবাই ভাবে না স্যার।। যেই লাভলীরে আপনে এক্ষন দেখতাসেন হেই লাভলী গত ৪০ বছর ধইরা ডেইলী এই ট্রেনে কোন না কোন ভাল মানুষ পাইলে ঊঠে। ভালা মাইনসের এখনও অভাব নাই স্যার।। তয় খারাপের লগে থাইক্যা ভালা মানুষগুলা নিজেগোর সাহস হারাইতাসে।। আপনে সাহস হারাইয়েন না।। ভালার জয় হইবোই।
মেয়েটা কোন সুযোগ না দিয়েই ট্রেন থেকে নেমে গেল।। কথাগুলো শুনে মনে শিমুলের মনে হয়নি যে কোন ৫/৬ বছরের মেয়ের কাছ থেকে এমন কথা শুনছে সে।। আগ্রহ বসত তাই পিছু নিলো মেয়েটির। মিনিট ৫ এক হাটার পর একটা ভাঙ্গা রাস্তার পাসে বাউন্ডারী দেয়া মাঠের ভেতর ঢুকে হারিয়ে গেল মেয়েটা।
হ্যাঁ, লাভলী তার দাদার সাথেই থাকে।। একটা সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে।।
-
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১:৪৩