২০০৩ বা ২০০৪ এর ঘটনা। তখন সবে ইন্টার পরি অথবা শেষ করেছি। কুরবানির ঈদের দিন। গরু পেছনেই প্রায় সারাটা দিন পার হয়ে বিকেল হয়ে গেছে। নামাজ পরে কুরবানি দেওয়া তারপর মাংস মাপামাপি, ভাগ করা, গরীবদের মাঝে বিলানোএ পর বাকি থাকলো আত্মীয়দের বাসায় মাংস দেওয়া। আবার তখন গ্রামে আমার দাদি-নানি দুজনেই থাকেন। তাদের জন্যও মাংস আলাদা করে রাখা হয়েছে। মা বলল পরের দিন মাংস নিয়ে গ্রামে যাওয়ার জন্য। আমি বললাম না, আমি সেদিন বিকালেই গ্রামে যেতে চাইলাম। একটা ব্যাক্তিগত কারন ছিল সেদিনি গ্রামে যেতে চাওয়ার পেছনে।
বাসা থেকে বের হতে হতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেলো। আমাদের গ্রামে যাওয়ার পথে একটা নদী পরে। তখন নদীটার উপরে ব্রিজ ছিল না। এখন অনেক সুন্দর একটা ব্রিজ বানানো হয়েছে। তখন ফেরীতে অথবা ট্রলারে করে নদী পার হতে হত। আমি নদী পার হয়ে দেখি সব বেবিট্যাক্সি ওয়ালা মন খারাপ করে বসে আছে কারন ঈদের দিন প্যাসেঞ্জার নাই কোনো। যারা গ্রামে যাওয়ার তারা ঈদের আগেই চলে যায়। আমি একা দেখে কেউ যেতে রাজি হচ্ছে না। কিছুক্ষন পর আরেকজন লোক আসলো আমি যেখানে নামবো সেও সেখানেই যাবে। বেবিওয়ালা বলল, আমরা দুজন একটু বেশি করে টাকা দিলে আর দেরি করবে না। আমরা রাজি হয়ে গেলাম।
আমাদের যখন বেবিওয়ালা নামিয়ে দিল তখন সন্ধ্যা পার হয়ে রাত হয়ে গেছে প্রায়। যেখানে নামেছি সেখান থেকে আমাদের বাড়ি আরো ৪৫ মিনিটের পায়ে হাটা পথ। গ্রামে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আছে তবে রাস্তা ঘাট আলোহীন। যখন খেয়াল করলাম যে এতোটা পথ আমাকে এই অন্ধকারের মধ্য পায়ে হেটে, দুহাতে ৫কেজি করে ১০ কেজি কাচা গরুর মাংস নিয়ে পার করতে হবে তখন ফেলে আসা পথের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম মাঝে মাঝে মায়ের কথা শুনতে হয়।
আমার সাথের লোকটির বাসা কাছেই। তার বাড়ি হয়েই আমাকে যেতে হবে। তিনি আমাকে লাইট দিয়ে বড় সড়কে দিয়ে গেলেন। আমি বিসমিল্লাহ্ বলে হাটা শুরু করলাম। কুরবানির সময় আকাশে বড় চাঁদ থাকে। সেই চাঁদের আলোয় রাস্তা দেখে হাঁটছি। চারদিকে বিভিন্ন পোকামাকড়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আমি কান খাড়া করে রেখেছি অন্য কোনো অস্বাভাবিক শব্দ শোনার অপেক্ষায়। মনের ভেতর অনেক ভয় কাজ করছিলো। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি পেছনে কোনো পায়ের শব্দ পাব অথবা এই বুঝি কেউ ঘাড়ের উপরে লাফিয়ে পড়ল। আমি ভুলেও পেছন ফিরে তাকাই নি, যদি অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাই এই ভয়ে। তাছাড়া ডাকাত বা ছিনতাইকারীর ভয়ও ছিল। ২০ মিনিটের রাস্তাতা জেনো শেষ হচ্ছিল না।
আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে সড়ক পথ শেষ হল। এর পর গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা। একটা বড় পুকুর পাড় ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে নীরব সংক্ষিপ্ত রাস্তা দিয়ে যেতে সাহস না হয়ায় অন্য একটা ঘোরা পথ ধরলাম। হাটতে হাটতে আমাদের গ্রামের স্কুল পাড় করে এমন এক জায়গায় আসলাম যেখান দিয়ে দিনের বেলাও হেটে যেতে ভয় করে। একটু বর্ণনা করলে বুঝা যাবে। তখন মোটামুটি বর্ষাকাল। পানি চলে এসেছে ক্ষেত খামারে। আমি যেখানে দাড়িয়ে ছিলাম সেখানে আমার সামনে বাদিকে একটা পুকুর আর ডানদিকে একটা খাল, মাঝে সরু একটা রাস্তা। আমার পায়ের সামনেই দশ কদমের মত রাস্তা অনেকটা নিচু। এই স্থান দিয়ে খাল আর পুকুরে পানি আসাযাওয়া করছে। এই জায়গাটুকুতে কখনই মাটি থাকে না। কি কারন কেউ জানে না। মাটি দেওয়া হলেও মাটি হয় পুকুরে অথবা খালে নেমে যায়। ঐ পানির রাস্তার পরের ছোট্ট রাস্তা শুকনা আর চিকন। তার দুপাশে ঘন বাঁশঝাড়। ডানপাশে পর পর দুটো বড় বটগাছ। গাছ দুটো অনেক অনেক পুরনো আর ঝাপটানো। এমনিতেই ভয় লাগে। এর পরেই বাদিকের পুকুর ঘেঁষে একটা অনেক পুরনো কবরস্থান। কবরস্থানের পরে গিয়ে অন্য মানুষের বাড়ি।
আমি আমার দাড়িয়ে থাকা জায়গায় দাড়িয়ে ভাবলাম, আমার দুহাতে কাঁচা গরুর মাংস যেগুলো থেকে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। সেগুলো নিয়ে এই পুকুর খাল পানি বাঁশঝাড়, বটগাছ, কবরস্থানের মাঝ দিয়ে রাত ৯ টার অন্ধকারে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া কি আমার পক্ষে সম্ভব? পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখি সামনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই আমার।
মাংসের ব্যাগ রেখে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটালাম। স্যান্ডেল খুলে, এক হাতে এক স্যান্ডেল আর এক ব্যাগ, অন্য হাতে অন্য স্যান্ডেল আর ব্যাগ নিয়ে আল্লাহ্র নাম নিয়ে পানিতে প্রথম পা রাখলাম। শরীরের লোমগুলো সব দাড়িয়ে গেলো। ৩ কদম পর দেখি পানি আমার হাঁটুতে। চতুর্থ কদমে আমার প্যান্ট ভিজে গেলো আর পা পিছলানো শুরু হল (পায়ের নিচে এঁটেল মাটি)। আমি কয়েক সেকেন্ড দাড়িয়ে নিজেকে স্থির করলাম। বুকের ভেতর হার্টটা ফেটে বেড়িয়ে যেতে চাইছিল এমনভাবে হার্ট বিট চলছিল তখন। পানি থেকে শুকনায় উঠে দেখি আমি বাঁশঝাড়ের মাঝখানে। পৃথিবীটা ঘোরা শুরু করল আমার এমন ভয় কাজ করছিল ভেতরে। আমি সোজা তাকিয়ে ছিলাম দুরের বাড়িটার দিকে। আড় চোখে বটগাছগুলো দেখছি। বার বার পেছনে তাকাতে ইচ্ছা করছিলো। ঘাড়ের লোমগুলো দাড়িয়ে গেলো সুর সুর করে। মন বলছিল এই বুঝি বিড়াল রুপি খারাপ কিছু দেখবো জা আমার দিকে ছুটে আসছে অথবা কিছু একটা আমার পা ধরে টান দিয়ে পানিতে নিয়ে যাবে বা টেনে বটগাছে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। জাস্ট ঐ মুহূর্তের ফিলিংস আমি ছাড়া এই পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষ বুঝতে পারবে না।
একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটছি আমি। ছোট্ট রাস্তাটা শেষ হচ্ছে না। আমি জেনো অনন্তকাল ধরে হাঁটছি। বাঁশঝাড় আড় বটগাছ পাড় হয়ে যখন আমি কবস্থানের সামনে আসলাম তখন আমি শীতে কাপা শুরু করলাম। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাচ্ছিল। ঠিকভাবে কিছুই দেখছিলাম না। মনেহচ্ছিল আমি দৌড় দেই। কিন্তু পাও চলতে চাচ্ছিল না। ওখানেই জেনো আমি পা গুটিতে পরে যাচ্ছি এমন অবস্থা। শুধু মনের জোরের বলে হাঁটছিলাম।
আমি যখন কবরস্থান পাড় হয়ে ঐ বাড়িতে পা দিলাম তখন আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেলো। দুনিয়ার ক্লান্তিবোধ চলে আসলো আমার ভেতরে। আমি আর হাটতে চাইছিলাম না। যাইহোক এরপর ৫ মিনিট হেঁটে আমি দাদীর বাড়ি পৌঁছাই। দাদী আমাকে দেখে ভুত দেখার মত ভয় পেলেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না আমি এত রাতে এতগুল কাঁচা মাংস নিয়ে ঐ রাস্তা দিয়ে এসেছি।
এখনো আমার ঐ ঘটনা মনে হলে শরীরের লোম দাড়িয়ে যায়। ভাবি এখন হয়ত আমি ঠিক ঐভাবে ঐ রাস্তা দিয়ে যেতে পারবো না। আবার মনেহয় হয়তো পারবো। কারন পরিস্থিতি মানুষকে অনেক কিছু করতে বাদ্ধ করে...