ভিয়েতনাম মিলিটারি হিস্টোরি মিউজিয়াম, হ্যানয়
ভিয়েতনাম মিলিটারি হিস্টোরি মিউজিয়াম, গেইট
হ্যানয় শহরের প্রাণকেন্দ্রে ভিয়েতনাম মিলিটারি হিস্টোরি মিউজিয়ামের অবস্থান। এর আশেপাশে অনেক সামরিক স্থাপনা আছে। মিউজিয়ামে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছিল। পুরাতন ভবনের পাশাপাশি নতুন ভবনে এখন অনেক আইটেম সাজানো হয়েছে। পর্যটকদের কাছে ভিয়েতনামের ইতিহাসকে ভাল ভাবে তুলে ধরতে তারা তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে। এখানে একদল দক্ষ এবং নিবেদিত প্রান কর্মী কাজ করে যাচ্ছে।
বিকেল তিনটার সময় আমরা সেখানে পৌঁছালাম, মেইন গেইট দিয়ে ঢুকতেই দুপাশে সুভেনির শপ পাশেই টিকেট কাউন্টার।একজন বেশ সিনিয়র গাইড আমাদেরকে সবকিছু দেখানোর দায়িত্ব নিল। প্রথমেই একটা রুমে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ম্যাপ এবং যুদ্ধ কালীন নানা ঘটনার বিবরণী দিয়ে সাজানো। এই ভবনে অ্যামেরিকানদের সাথে যুদ্ধের ঘটনা গুলো ধারাবাহিক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
দায়িত্ব প্রাপ্ত এক জন মহিলা কর্মকর্তার সাথে আমরা সবাই মিউজিয়ামে প্রবেশ করলাম। রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছিল তখন। দর্শকদের জন্য আরও সুন্দর করে সাজানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।
এখানে ব্রিফিং রুমে বসে পনেরো মিনিটের আবেগপূর্ণ বর্ণনা শুনে যে কোন মানুষের মন বিষণ্ণ হয়ে যাবে। এখানকার কর্মীরা সবাই নিবেদিত প্রান। নির্যাতিত ভিয়েতকং বাহিনী, দেশপ্রেমিক জনগণ, তাদের আত্মত্যাগ, মহান নেতা হো চি মিনের নেতৃত্ব ও মহত্ত্বের কথা বলার সময় গাইড নিজেই আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়।
সাইকেলে করে তিনশত কেজি মালপত্র বহন করে শত মাইল দূরে নিয়ে যেত মানুষেরা ভিয়েতকং বাহিনীকে সরবরাহের জন্য। দরিদ্র জনগণ তাদের নিজের এই এক মাত্র দামী সম্বল দেশের স্বাধীনতার জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছিল।
সারা পৃথিবী বিশেষত পশ্চিমাবিশ্বের মানুষদের কাছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ঘটনা প্রেক্ষাপট জানানো এবং বোঝানোর জন্য এই মিউজিয়ামকে সাজানো হয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের নানা ধরনের সামগ্রী এবং আলোচিত ছবির মাধ্যমে ভিয়েতনামীদের দীর্ঘ স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা জানানোর এই প্রচেষ্টা চলছে এখানে। তৎকালীন গেরিলা যুদ্ধ, কমু নিস্ট যোদ্ধা তাদের ইতিহাস এবং ভিয়েতনাম পিপলস আর্মির কর্মকাণ্ড এখানে পরিস্ফুট হয়েছে।কি কঠিন ছিল ভিয়েতনামিদের সংগ্রাম, বহু বছর ধরে তারা তাদের স্বাধীনতার জন্য পরাধীনতার জোয়াল থেকে মুক্ত হতে জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করে গেছে ।
এই মিউজিয়ামের পুরাতন ভবনটি ১৯৫৯ সালে দর্শকদের জন্য উম্মুক্ত করা হয়েছিল, এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালের ভিয়েতনামের মানুষের সংগ্রামের ও সংঘাতের ঘটনাগুলো জানা যায় এবং এটা তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত।
এখানেই জানা যায় চিনের অধীনে ভিয়েতনামের অবস্থা, ফরাসী উপনিবেশ থাকাকালীন অত্যাচার আর অবিচার এবং দখলদার জাপানীদের দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার কথা। যুগ যুগ ধরে এই জাতি যেন নির্যাতনের শিকার হতেই সৃষ্টি হয়েছিল।তাদের ভৌগলিক অবস্থানের কারনে তারা এই নির্মমতার টার্গেট হয়েছিল।
তাঁরপর উত্তর ভিয়েতনামে ভিয়েতমিং এর উত্থান এবং ১৯৪৫ সালে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা করে নতুন রাষ্ট্রের পত্তন এবং দুই ভিয়েতনামকে একত্র করার পরবর্তী সংগ্রাম।
নতুন ভবনে ১৯৬০ এবং ৭০ এর দশকের সংঘাতের ফলে সৃষ্ট ক্ষত এবং তাঁর ভিয়েত নামী ব্যাখ্যা এখানে বিধৃত। শক্তিশালী আমেরিকান বাহিনীকে কিভাবে হাতে বানানো অস্ত্র বাঁশের সুচালো কঞ্চি দিয়ে নাস্তানাবুদ করত সেগুলোর মডেল আছে এই মিউজিয়ামে। এর পাশেই ১৯ শতকে নির্মিত ফ্লাগ টাওয়ার, ফরাসী উপনিবেশের পতন ঘটাতে চলমান সংগ্রামে যে কয়েকটি পুরাতন ভবন রক্ষা পেয়েছিল এটা তাদের একটা। এখন এর শীর্ষে স্বাধীন ভিয়েতনামের পতাকা গর্ব নিয়ে উড়ে।
পুরাতন ফ্লাগ টাওয়ার
এখানে উঠে শহরের দৃশ্য দেখা যেত, এখন এটা বন্ধ আছে নিরাপত্তার কারনে। তবে এই টাওয়ারের শীর্ষে ভিয়েতনামের লাল পতাকা বাতাসে গর্ব ভরে পতপত করে উড়ছে।
ভেতরে ভিয়েতনাম যুদ্ধ মেঝেতে বানানো একটা মডেলের ব্রিফ করা হয়। এই ব্রিফিং এর সময় নানা রঙের ছোট ছোট লাইট জ্বালিয়ে ঘটনা প্রবাহ বোঝনো হয়। ধারা বর্ণনা বেশ মর্মস্পর্শী এবং তা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কি আমানবিক অত্যাচারের পরে অর্জিত এই স্বাধীনতা। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ঘুরে ইতিহাসের সাথে মিশে আমরা বাইরে এলাম। অনেকদিন এই স্মৃতি আমাদের মনে প্রভাব ফেলবে। ভিয়েতনামের সংগ্রামী জনগণ শান্তিতে থাকুক এটাই চাই।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৩৮