অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম সামু ব্লগ নিয়ে কিছু লেখা লিখব, কেন আসে না আগের মত সেই সব মন মাতানো লেখা? লিখব লিখব করেও লেখা হয়ে ওঠে নি আজকে হঠাৎ করে দেখলাম ব্লগার জেন রসি লিখে ফেলছেন ব্লগ কি তার কার্যকারীতা হারিয়ে ফেলেছে ভাবছিলাম, উনার পোষ্টে কমেন্ট দেব, কিন্তু দেখলাম মন্তব্য এত বড় হয়ে যাচ্ছে যে আলাদা একটা পোষ্টই দেয়া যাচ্ছে। সেই আলোকে আজকের পোষ্ট .....
পড়াশুনা
আমার প্রায় আট বছর আগে এই সামু ব্লগের সাথে পরিচয় ঘটে। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি আমি ব্লগের স্বর্নালী যুগের শেষের অতি সামান্য সময় দেখছিলাম (এই স্বর্নালী সময় নিয়ে অনেকেরই হয়ত দ্বিমত থাকতে পারে, তাতে সমস্যা নেই কারন এটা একান্ত আমার ব্যাক্তিগত মতামত)। সে একটা সময় গেছে, এদিক থেকে হাজীর বিরিয়ানী আসছে তো ওদিক থেকে পুরানো ঢাকার চাপ, কাবাব আবার নজর ফিরাতে ফিরাতে ঘিয়ে ভাজা আস্ত খাসির রোষ্ট। কোনটা ছেড়ে কোন কোনটা খাবর মত অবস্থা। মানে প্রতিটা লেখাই ছিল অসাধারন মানসম্মত। লিখত কারা? লিখত এখনকার মতই যারা ব্লগিং করছে তাদের মতই কেউ একজন। তার কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, তলস্তয়, ডিকেন্স বা চেখভের মত মেধা ছিলনা, সাধারন মাপের লেখকরাই লিখতে লিখতে এক সময় নিজস্ব একটা ষ্টাইল বা বলয় তৈরী করে ফেলত। তৈরী হয়ে যেত কিছু মান সম্মত লেখক।
এখন সে সময়ের একজন সাধারন মাপের একজন লেখক আর এখনকার একজন সাধারন মাপের লেখকের মাঝে পার্থক্য কোথায়? সোস্যাল মিডিয়া বলতে আমরা যা বুজি এই নেট কালচার তখনো শৈশবের ঘরে, ফেসবুক সবে মাত্র মার্কেটে আসছে (আমি ২০০৫/২০০৬ এর কথা বলছি) এদেশে তখনো হাতে গোনা কিছু মানুষ সবে ফেসবুক চিনতে শুরু করছে, ব্লগিং তখনো আতুড় ঘরে। তো ওই সময়ে যে মানুষটা লিখতে শুরু করছে তার লেখা শুরু করার আগে সে তার অবসর সময় কিভাবে কাটাত? কিভাবে আবার বই পড়ে আর যারা বই পড়ত না তারা সিনেমা টিনেমা দেখে। কিন্তু মুলতঃ পড়ুয়া গ্রুপটাই ব্লগে এসে লেখা শুরু করে। এর মানে হল, পড়তে পড়তে মোটামুটি ঝুনা ঝুনা পার্টিরাই কি বোর্ডে ভুল ভাল টাইপ করে ব্লগিং শুরু করে। টাইপে ভুল হোক কিন্তু লেখার মাঝে ছিল গভীরতা।
একজন ইমন যুবায়ের মারা যাবার পর কি তার বিকল্প ব্লগে এসেছে? কেন আসে নি? কারন ইমন ভাই (উনার সাথে আমার ব্যাক্তিগত আলাপ কোন দিন হয় নি, আমি ব্লগে আসার অল্প কয়েক মাস পরেই উনি মারা যায়, এরপর উনার ব্যাপারে আমার ব্যাক্তিগত ইন্টারেষ্ট থাকায় উনার সন্মন্ধ্যে আমি জানি) সারা দিন পড়তেন এবং সকালে উঠে লিখতেন। ইমন ভাই বাংলা ব্লগকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন। আবার ম্যাভেরিক এর পোষ্ট গুলো যদি আপনি খেয়াল করেন তবে দেখবেন তার বিজ্ঞান এবং গনিত বিষয়ক লেখার ধারে কাছেও কেউ নেই, এই লেখাগুলো লিখতে গেলে উনাকে প্রচুর পড়তে হয়েছে বলা বাহুল্য শুধু ম্যাভেরিক কেন এই ধাচের আরো কয়েকজন ছিল যারা এই টাইপের অসাধারন লেখা লিখত, এখনে গান নিয়ে লিখত গাংচিল এবং সিরাজ সাই, গানের ব্যাপারে এদের জ্ঞান দেখে অবাক হয়ে যেতাম, কিভাবে এটা সম্ভব?
এখানে গোলাম দস্তগীর লিসানী ভাইর নাম নেবার প্রয়োজন অনুভব করছি তার ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতা দেখে, আবার এর পাশাপাশি ভ্রমন কাহিনী নিয়ে অনেকে লিখতেন সুখের বিষয় জুন আপা এর মাঝে এই টাইপের লেখা দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন এবং এখনো মাঝে সাঝে লিখেন, এর পাশাপাশি একটা গ্রুপ ছিল যারা নাস্তিক বা অবিশ্বাসী, এই নাস্তিক বলতে আবার থাবা বাবা টাইপের কাউকে মনে করবেন না, যারা এই ব্লগে নাস্তিক বা অবিশ্বাসী ছিল তারাও ধর্মীয় পোষ্টের মাঝে এবং বিপরীতে পোষ্টও দিত কিন্তু সেটা ছিল সভ্যতা, ভব্যতার মাঝে। বিশ্বাসীর বিশ্বাসে আঘাত না তারা যুক্তি দিয়ে কথা বলে প্রমান দেবার চেষ্টা করত তাদের বিশ্বাস ভুল। বিশ্বাস করুন আমি সেটা উপভোগ করতাম। আল্লাহ বা রাসুলকে গালি দেবার প্রয়োজন হত না তাদের, তারা ছিল যুক্তিবাদী। পুরানো অনেকের কথাই মাথায় ঘুরে যাচ্ছে কিন্তু তাদের সবার নাম নিতে গেলে এই পোষ্ট আর লেখা হবে না, তাই আমার পুরানো একটা সংকলন আছে সেটায় যেসব পোষ্ট আছে তাতে একবার নজর বুলিয়ে আসার অনুরোধ থাকল শের শায়রীর রহস্যের দুনিয়ায় স্বাগতম তাহলেই বুজবেন তারা কেমন ছিল ( বিনয়ের সাথে জানিয়ে রাখি ঐ সংকলনে আমার নিজেরও কিছু পোষ্ট আছে, সেগুলো ওখানে যারা লিখছে তাদের পাশাপাশি জায়গা পাবার মত কিছু না হলেও যেহেতু ধাচটা রহস্য রোমাঞ্চের তাই রেখে দিয়েছি)
এখন কথা হল এরা এত দারুনভাবে কিভাবে লিখত, আসলে তারা পড়ত, লেখার থেকে বেশী পড়ত। যেহেতু এরা কেউ জন্ম সুত্রে লেখা লেখির প্রতিভা নিয়ে আসেনি, তাই পড়াশুনার অভিজ্ঞতার আলোকে লেখালেখি করে একটা সময় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে। এখনকার কয়টা মানুষ লেখার আগে নিয়মিত পড়াশুনা করে বলতে পারেন? তা আপনি গল্প লেখেন, বিজ্ঞান লেখেন, আর কবিতা লেখেন।
আস্তিক নাস্তিক ইস্যু
ব্লগের পতনের জন্য কোনভাবেই নাস্তিক আস্তিক বিতর্ককে আমি দায়ী করতে রাজী না। কেউ যদি সেকালে কিছু ব্লগার নাম ধারীদের নবী রাসুলদের নিয়ে নোংরামিকে বিতর্ক হিসাবে দেখাতে যান সেক্ষেত্রে আমি বলব কিছু ব্লগার এই নোংরামিকে উস্কে দিয়ে লাভবান হবার জন্য এটাকে হাইলাইট করে সাধারন ব্লগারদের এর মধ্যে জড়িয়ে ফেলে নিজেদের লাভের গুড় খেয়ে নিয়েছে। আস্তিক নাস্তিক বিতর্ক আগে যেমন ছিল, এখনো আছে ভবিষ্যতেও থাকবে। এতে দোষের কিছু নাই। কিন্তু নাস্তিকতার নামে যখন কোন মানুষের সব থেকে সেনসেটিভ অনুভুতিতে আঘাত দিয়ে যুক্তিবাদী কেউ বিজয়ী হতে চাইবে বলে আমার মনে হয় না। তাই ব্লগের পতনের জন্য আস্তিক নাস্তিক ইস্যু বড় কিছু না বলেই আমার বিশ্বাস। এটাকে যারাই হাইলাইট করতে চাক না কেন সে আস্তিক হোক আর নাস্তিক হোক আমি বলব নির্দিষ্ট কোন উদ্যেশ্য নিয়েই সেটা সে করছে, যার মাঝে সহনশীলতা নাই সে না পারে আস্তিক হতে না পারে নাস্তিক হতে।
ফেসবুককে দায়ী করা
হ্যা অস্বীকার করার উপায় নেই, ফেসবুক আসায় অনেকেই সস্তা জনপ্রিয়তায় ফেসবুকে গেছে, এই যাওয়ায় ব্লগের খুব একটা ক্ষতি হয়েছে তাও না, কারন মিনি মাগনার এই যুগে “ওই চাঁদ প্রিয়া.... ঢ্যাডাং ড্যাঢাং” গানের পাশাপাশি হেমন্তের “এই রাত তোমার আমার” যেমন কোন তুলনা চলে না তেমনি ফেসবুকের দুই লাইনের ষ্ট্যাটাসের সাথে ব্লগের একটা লেখার কোন তুলনাই হয় না। অনেকেই ব্লগের লেখার সাথে ফেসবুককে মিলিয়ে ফেলেন। দুই লাইন পত্রিকা থেকে তুলে অথবা তিন লাইনের একটা লেখা লিখে কেউ যদি ব্লগ পোষ্ট করে আত্মতৃপ্তিতে ভোগে তার জন্য আসলে ব্লগ একটা অবশ্যই ভুল জায়গা। এটা এখনকার অনেকেই জানে না, একটা দারুন মন্তব্য অনেক সময় ব্লগের মুল পোষ্টকে ছাপিয়ে যায়। আমার নিজের লেখার ক্ষেত্রেই এমন দুই চার বার ঘটছে।
বর্তমান ব্লগ জনপ্রিয় না হওয়ার অন্যতম কারন
যেই লিখুক না কেন, সে আমি বা অন্য কেউ সবাই চায় তার লেখা সবাই পড়ুক। এতে দোষের কিছু নেই। অথচ বর্তমানে সামু ব্লগে ঢুকতে গেলে দেশের মধ্যে ওয়াইফাই কানেকশান লাগে, কোন মোবাইল অপারেটরের ডাটা ইউজ করে স্বাভাবিকভাবে ব্লগে ঢোকা যায় না, সেক্ষেত্রে ঢাকা এবং বড় বড় দুই চারটা শহর ছাড়া খুব কম জায়গায় ওয়াইফাই ইউজ হয় অথবা বাসার বাইরে গেলেই মোবাইল ডাটা ইউজ করতে হয়, সেক্ষেত্রে চাইলেও কেউ সহজভাবে ব্লগে ঢুকতে পারছেনা। ঢুকতে গেলে খুব সম্ভবতঃ অপেরা অথবা ভিপিএন দরকার। এত ঝামেলা করে সাধারন কেউ সামু ব্লগে ঢুকতে চায় না, যার কারনে সামু ব্লগ একটা নির্দিষ্ট গন্ডিতে আটকে আছে, অথচ দেখুন রোয়ার বাংলায় একটা পোষ্ট দিলে তার রীচ ৪/৫ হাজার ক্ষেত্র বিশেষ ১৫/২০ হাজার হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে দোষ বা ভুল কার? সামুর নাকি সমস্ত ব্লগ কম্যুনিটির? আগে একটা পোষ্ট দিলেই আমার মত নগন্য মানুষের লেখার ভিউও এ্যাভারেজ এক দেড় হাজার হয়ে যেত, এখন টেনে টুনে ৩০০/৪০০। আর ভালো মানের ব্লগারদের লেখার তো কথাই নেই। যতদিন সামু এই মোবাইল নেট ইউজার ফ্রেন্ডলি না করতে পারবে ততদিন হাজার কারন দেখালেও ব্লগের মানের উন্নতি হবে না, মান সম্মত লেখক আসবে না। আসলেও সংখ্যায় অতি নগন্য হবে।
একটা সময় গেছে দিনে তিনটা পোষ্ট দিতাম, মান যাই হোক না কেন নিজের ভালো লাগা থেকেই দিতাম, এখন খুব একটা লিখতে ইচ্ছা বা সময়ও হয় না।
ডিজিটাল আইন
ডিজিটাল আইনের কারনে এখন রাজনৈতিক লেখা লিখতে আর কেউ তেমন উৎসাহী হয় না এটা অতীব সত্য। আর রাজনৈতিক লেখা না আসলে তর্ক বিতর্কের একটা বিরাট অংশ ফাঁকা থেকে যাবে। রাজনৈতিক লেখা যে দুয়েকজন লেখে তাও অতি হিসাব নিকাশের কারনে তার ফ্লেভার হারিয়ে যায়। আগে মুলতঃ ব্লগ মাতিয়ে রাখত এই সব বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার লেখকরা, যেখানে তর্ক বিতর্ক দিয়ে অনেক কিছু আসত।
দলবাজি, সিন্ডিকেটবাজি
দলবাজি, সিন্ডিকেটবাজি খারাপ কিছু না, লেখা লেখিতে একটা পর্যায়ে নিজস্ব বলয় বা কোন গ্রুপের একটা বলয় তৈরী হয়ে যায় তেমনি তার বিপক্ষ বলয়ও তৈরী হয়ে যায়, শুরু হয় দু দলের শব্দাস্ত্র প্রয়োগ, আমি ব্যাক্তিগত ভাবে এটা উপভোগ করি যতক্ষন না এটা ব্যাক্তি আক্রমনে চলে যায়। এই ব্যাক্তি আক্রমন ব্যাপারটাও অনেকে বোঝে না। এই না বুঝাটাই নোংরামিতে পর্যবসিত হয়। তবে আশার ব্যাপার প্রায় ৯৫% ব্লগারই এ ব্যাপারে সচেতন এটাই ব্লগের সৌন্দর্য্য।
ব্লগে মোডারেটররা
আমার কাছে ব্লগের মডুরা সব সময়ই শিখন্ডি। সবাইকে তারা খুশী করতে পারে না। আমি নিজেও কিছু ব্যাপারে কখনো কখনো বিরক্ত হই, কিন্তু হাজার খানেক ব্লগারদের বিভিন্ন মত বিভিন্ন ধারার সবাইকে খুশী রাখা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।
ব্লগ এখন আর নতুন লেখক তুলে আনতে পারছে না আগের মত, এর অন্যতম কারন আমার কাছে সামু ব্লগের সীমিত গন্ডি, এই জেনারেশানের বিভিন্ন লেখকের বই পড়ার অনীহা, ব্লগের টেকনিক্যাল দুর্বলতাই আমার কাছে মুল বলে মনে হয়েছে।
কয়েক বছর আগে লিখছিলাম কেন আসেনা আগের মত সেই সব লেখা? । তার ধারাবাহিকতায় ব্লগার জেন রসির লেখাটা পড়ে একান্ত ব্যাক্তিগত মতামতের ওপর ভিত্তি করে এই লেখাটা লিখলাম। সবাই যে সব ব্যাপারে এক মত হবে তাও না। এক সময় সামু ব্লগ ছিল নতুন লেখক তৈরীর আতুরঘর, কালে কালে তা বিবর্ন হয়ে যাচ্ছে, এতে ব্লগ কর্তৃপক্ষ যেমন দায় এড়াতে পারছে না, তেমনি দায় এড়াতে পারছে না একালে যারা ভিউ লাইক কমেন্টের ইচ্ছা নিয়ে প্রস্তুতি ছাড়া ব্লগে আসে তারাও। আমার কাছে ব্যাক্তিগতভাবে মনে হয়, ব্লগ কর্তৃপক্ষ যতদিন উদসীনতা দেখাবে ততই সামুর মৃত্যু ঘন্টা বাজবে। অতীতের কংকাল হয়ে অতীত গৌরবের জাবর কাটতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০২০ রাত ৯:৩৪