উসমান (রা) এর আমলে ইসলামি বিশ্ব। ছবিসূত্রঃ Wikimedia Commons
আগের পোষ্টঃ খোলাফায়ে রাশেদিন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)
হযরত উসমান (রাঃ) এর খেলাফতকাল নিয়ে আলাপ করার আগে কিছু ব্যাপার আপনার স্মরনে রাখতে হবে কারন না হলে এমন কিছু ব্যাপারের অবতারনা হবে যা স্বাভাবিক ভাবে অনেকেই নিতে পারবে না , যারা এগুলো না জানে। তবে সত্য সত্যই। আমি ধর্মীয় দৃষ্টি কোন দিয়ে না দেখে পুরো ব্যাপারটা ঐতিহাসিক দৃষ্টি কোন দিয়ে দেখার চেষ্টা করব। প্রথমেই আপনাকে জানতে হবে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রাঃ) তার চরিত্রগত ভাবে ভীষন কঠোর ছিলেন তা তিনি নিজের ক্ষেত্রেও যেমন অন্যের ব্যাপারে তেমনি সে তুলনায় ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান (রাঃ) অনেক কোমল এবং শান্ত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন।
খোলাফায়ে রাশেদিনদের ফ্যামিলি ট্রি
দ্বিতীয়তঃ হযরত উসমান (রাঃ) এর আগের দুই জন খলিফা কুরাইশ বংশের বনু হাশমী গোত্রের (উপরের খলিফাদের ফ্যামিলি ট্রি দেখুন), সেখানে উসমান (রাঃ) বনু উমাইয়া গোত্রের। মহানবীর ওফাতের পর হযরত আবু বকর (রাঃ) দুই বছর এবং উমর (রাঃ) ১০ বছর টোটালি ১২/১৩ বছর খেলাফত প্রতিষ্ঠা হয়েছে। গোত্রীয় বিভাজন তখনো হিংস্র বেদুঈন আরবদের রক্তে মিশে আছে। এই ১২/১৩ বছরের মাঝে ইসলাম যেন মরু ঝড়ের মত সমগ্র চেনা পৃথিবী দখল করে ফেলছে। এইটুকু স্মরনে রেখে চলুন আমরা হযরত উসমানের খেলাফত কাল নিয়ে আলোচনায় যাই।
হযরত উমর (রাঃ) যেহেতু হযরত আবু বকরের মত উত্তরাধিকারী রেখে যান নি, আবার তিনি চাচ্ছিলেন ও না যেন খেলাফতের দাবী নিয়ে যেন কোন রক্তারক্তি ঘটানোর মত পরিস্থিতির উদ্ভব হোক তাই তিনি ছয় জন সাহাবার একটা প্যানেল তৈরী করেন যাদের নাম হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ), হযরত উসমান ইবনে আফান (রাঃ), হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ), হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ), হযরত যুবাইর ইবনে আউয়াম (রাঃ), হযরত তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রাঃ)। এদের মাঝ দিয়ে যে কোন একজনকে সংখ্যাধিক্যের মতামতের ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচিত করা হবে, কোন কারনে যদি এই ছয় জন সমান ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন তবে উমর (রাঃ) ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর তার মতামত যুক্ত করে যে কোন এক দিক সংখ্যাধিক্য ঘটিয়ে খলিফা নির্বাচন করবে।
বাস্তবে দেখা গেল এই ছয় জন খলিফা উমর (রাঃ) এর ইন্তেকালের দুই দিন পরো কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না, এ ক্ষেত্রে এই ছয় জনের একজন হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) বাকী পাচ জনকে জানালেন তারা যদি তার কথা মেনে নেয় তবে তিনি খলিফার পদ থেকে নিজের দাবী প্রত্যাহার করে নিয়ে বাকী পাচ জনের মাঝ থেকে একজন কে খলিফা বানাবেন। অনেকেই মনে করছিলেন তিনি হয়ত হযরত আলী (রাঃ) নাম ঘোষনা করবেন কারন ওই ছয়জনের মাঝে হযরত তালহা এবং হযরত যুবাইর ছিলেন হযরত আলীর পুরানো মিত্র, যারা প্রথম খলিফা হযরত আবু বকরের নির্বাচনের সময় হযরত আলীর পাশে দাড়িয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) হযরত আলীর নাম না ঘোষনা করে তার থেকে ২৫ বছরের বড় হযরত উসমান (রাঃ) নাম ঘোষনা করছেন এবং তার হাতে বাইয়াত গ্রহন করছে। দিনটি ছিল ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ই নভেম্বর। ইসলামের তৃতীয় খলিফা হিসাবে তার ১২ বছরের শাসনকাল শুরু হয়। হযরত আলী (রাঃ) তার হাতে বাইয়াত গ্রহন করেন।
হযরত উসমান (রাঃ) ১২ বছর খেলাফত কালকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়। স্বভাবগত ভাবে প্রচন্ড শান্তশিষ্ট বয়োবৃদ্ধ এই খলিফা প্রথম ছয় বছর খুবই জনপ্রিয় শাসক হিসাবে সবার কাছে গ্রহন যোগ্য ছিলেন। পরবর্তী ছয় বছর ছিল এর উল্টো। এই সময় তিনি একের পর এক বাধার সন্মুখীন হন। খেলাফতের প্রথম দিকে পারস্যর পলাতক সম্রাট ইয়াজদিগার্দের প্রভাব পুরোপুরি খর্ব করেন এবং ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দের ইয়াজদিগার্দ অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নিহত হন। মুসলমানরা কাবুল ও গজনী পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে।
ওদিকে ৬৪৬ সালে হযরত উমর (রাঃ) মৃত্যুর পর বাইজান্টেনিয়ান সম্রাট খ্রিষ্টান সেনাপতি মানাভীলের নেতৃত্ব ৩০০ জাহাজের এক নৌবহর পাঠিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া পুনরায় দখল করে, মিশরের মুসলমান গভর্নর আমর ইবনুল আস তৎকালীন মিশরের রাজধানী ফুসতাত থেকে এগিয়ে এসে পুনরায় নিম্ন (Lower) মিশরের নীল নদের তীরে নাকয়ুস শহরের পাশে খ্রিষ্টান বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌছে সেনাপতি মানাভীলকে পরাজিত করে আলেকজান্দ্রিয়া পুনুরুদ্ধার করে। (আত তাবারী, ৪:২৫০)। এরপর খলিফা উসমান আমরের স্থলে আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবি সারাহ কে মিশরের নতুন গভর্নর নিয়োগ করেন।
আব্দুল্লাহ মিশর থেকে পশ্চিম থেকে তিউনিসিয়া পর্যন্ত বিজয় প্রতিষ্ঠা করেন। ওদিকে সিরিয়ার শাসন কর্তা খলিফা উসমানের চাচাতো ভাই মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান সফলতার সাথে বাইজান্টাইনদের প্রতিহত করে মুসলমানদের প্রথম নৌবহর তৈরী করেন এবং এই নৌবহরের দ্ধারা সাইপ্রাস দ্বীপ দখল করেন। এরপর রোডস দ্বীপও মুসলমানদের দখলে আসে। ৬৪৭ সালে এশিয়া মাইনর থেকে আগত এক বিশাল স্থল বাইজান্টাইন বাহিনীকে খলিফার বাহিনী পরাজিত করে। হযরত উসমানের আমলে “ব্যাটল অভ মাষ্ট”র নৌ যুদ্ধে মুসলিম নৌ বাহিনী বাইজান্টাইন নৌ বাহিনীকে পুরোপুরি পরাজিত করে নৌ পথে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জন করে।
খলিফা উসমানের এই সব বিজয় কৃতিত্ব সব কিছু বিষাদময় হয়ে যায় তার নিহত হবার ঘটনার মধ্যে দিয়ে, ভালো মানুষী, গোত্র রাজনীতি, ক্ষমতার ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হয় ইসলামের তৃতীয় খলিফা। ৮২ বছরের এই বৃদ্ধ খলিফার যে নিষ্ঠুর ভাবে নিহত হয়েছিল তার সাথে এক মাত্র কারবালার ঘটনা তুলনীয়। কিন্তু সেভাবে কোন দিন ইতিহাসে খিলাফতের এই তৃতীয় খলিফার মৃত্যু নিয়ে মানুষকে প্রচার করা হয় নি, কারন কারবালার ঘটনা নিয়ে যারা মাতামাতি করে তাদের কাছে হযরত উসমান (রাঃ) এবং মুয়াবিয়া ছিল সম্পূর্ন শত্রুপক্ষ। তারপরো আমার কাছে অবাক লাগে ভাবতে সাধারন মানুষের কাছে উসমান (রাঃ) মৃত্যু ঘটনা অনেকাংশে এড়িয়ে যাওয়া হয়। তার মৃত্যুর ঘটনায় যাবার আগে ধাপে ধাপে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাবে উসমান (রাঃ) শেষ ছয় বছরের ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করব, যদিও পুরা ঘটনা অনুধাবন করতে এত স্বল্প পরিসরে লেখা হয়ত অনেক ধোঁয়াশা তৈরী করবে, তবে আমি চাইব এ থেকে কেউ যদি মুল ঘটনা আরো বিস্তারিত জানতে আগ্রহী হয় তবেই স্বার্থকতা।
উসমান (রাঃ) এর খিলাফত কালে পুর্ব পশ্চিম সব দিকে বিজয় অর্জিত হওয়ায় সব দিক দিয়ে গনীমতের মাল রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আসতে থাকল এবং উদার হৃদয় উসমান (রাঃ) সেগুলো সবাইকে বিলি বন্টন করা ছাড়াও মুসলিম সৈন্যরাও যথেষ্ট সম্পদের মালিক হয়ে দাড়ায়, যার কারনে তারা ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে ওঠে এবং ইসলামের খেদমত বাদ দিয়ে নিজেদের দিকে নজর দেয়া শুরু করে। পাশাপাশি উসমান (রাঃ) কোমল আচরন বিভিন্ন প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উচ্চাকাঙ্খী হতে সাহায্য করে। পাশাপাশি উসমান (রাঃ) শাসনামলের শেষ দিকে অনেক বড় বড় বিজ্ঞ সাহাবী ইন্তেকাল করেন, আবার অনেক বড় বড় সাহাবী উসমান (রাঃ) অনুমতি নিয়ে মদিনা ত্যাগ করেন। ফলে তারা কোন স্থানে গমন করলে তাদের কেন্দ্র করে তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক সুক্ষ্ম বিভক্তির তৈরী হয় (দেখুন আমীরুল মোমেনিন উসমান ইবনু আফফান লেখক ডঃ যুবাইর মুহাম্মদ এহসানুল হক পৃঃ ৩৩৪)
ওদিকে হযরত উসমান ছিল কুরাইশ বংশের বনু উমাইয়া গোত্রের আর হযরত আলী ছিল বনু হাশিম গোত্রের। এছাড়াও পূর্ববর্তী দুই খলিফা বনু হাশিম গোত্রের লোক হওয়ায় আরবীয় গোত্র বিভেদ ধুমায়িত হতে শুরু করে। ওদিকে প্রথম দুই খলিফাকে অকুরাইশ নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জে পড়তে না হলেও হযরত উসমানের কোমল স্বভাবের কারনে অকুরাইশ নেতৃত্বও চাঙ্গা হতে শুরু করে যা শুরু হয়েছিল হযরত আবু বকরের খেলাফতের সময় মদিনার খাযরাজ গোত্রের নেতা সাদ বিন উবাইদাকে খলিফা না করার মধ্যে দিয়ে। এক পর্যায়ে এই কুরাইশ শাসনের বিরোধিতা কেবল উমাইয়া শাসনের বিরোধিতায় রূপ নেয় যার মাধ্যমে অকুরাইশ এবং কুরাইশ বংশের উমাইয়া গোত্র বাদে সবাইকে এক ছাতার নীচে নিয়ে আসে।
খলিফা উসমানের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সুচনা হয়েছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরন হয়ত কোন দিন পাওয়া যাবে না, তবে বেশির ভাগ ঐতিহাসিকের মতে উসমানের শাসনের মাঝামাঝি সময় থেকে যুদ্ধ প্রিয় বেদুঈন আরবদের সামনে দখল করার মত আর কোন উল্লেখ্য যোগ্য দেশ না থাকায় তারা যেমন অলস হয়ে পড়ছিলো তেমনি গনীমতের প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছিল যা তাদেরকে খলিফার বিরুদ্ধ চারনে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রেখেছিলো।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম মিউজিয়ামে গত বছর থেকে সযত্নে সংরক্ষিত হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতম হাতে লেখা কোরআনের অংশবিশেষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই হস্ত-লিখন কোরআন লিখিত হয় হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশাতেই।
খলিফা যখন বিভিন্ন প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের ডাকলেন তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অসন্তোষ এবং বিদ্রোহের কারন জানতে তখন বসরার শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ বিন আমেরের উক্তি থেকে এর সত্যতা পাওয়া যায়, তিনি বলেন, আমার মতে এই সব লোকদের জিহাদে নিয়োজিত রাখাই শ্রেষ্ঠতর প্রতিকার। নিষ্কর্মা বসে থাকার দরুন তাদের মাথায় এ ধরনের ফাসাদ এবং কুবুদ্ধির উদয় হয়েছে। তারা যখন জিহাদে লিপ্ত হবে তখন আপনা আপনিই এই সব বিক্ষোভ বিশৃঙ্খলার অবসান হবে (দেখুন ইসলামের ইতিহাস, প্রথম খন্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, ইবনুল কাসির খন্ড ২ পৃঃ ৪২৭)
ওদিকে খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত মিশরের শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবি সারাহ ৬৫১ সালে দুজন প্রভাবশালী মানুষের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন এদের একজন হল হযরত আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর অন্যজন হুজায়ফা। এক পর্যায়ে তারা প্রকাশ্যে গভর্নরের বিরুদ্ধচারন করে এবং খলিফার প্রতি দোষারোপ করেন যাদের প্রতি খোদ রাসুলুল্লাহ অসন্তুষ্ট ছিলেন তাদের কে তিনি (উসমান রাঃ) বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর নিয়োগ করছেন। (দেখুন ইসলামের ইতিহাস, প্রথম খন্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ)
খলিফার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ছিল যা ঐতিহাসিক মাসুদী, অধ্যাপক পি কে হিট্টী, উইলিয়ম মুইর, ভন ক্রেমার এরা সমর্থন করেন। বাস্তবতা হল সে সময় উমাইয়া বংশের কিছু মানুষ ক্ষমতাধর হয়ে উঠছিলো বিভিন্ন ভাবে যদিও তাদের যোগ্যতা ছিল, কিন্তু তারা কেউ কেউ কোন না কোন ভাবে খলিফার আত্মীয় ছিলেন (অবশ্য সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া খলিফার আত্মীয় হলেও সে হযরত উমরের সময় থেকেই নিয়োগপ্রাপ্ত ছিল)। ওদিকে কুফায় মালিক আশতার খলিফার বিরোধিতায় মাঠে নামেন। হাশেমীদের পক্ষে কথা বলা শুরু করে। কুফা এবং বসরায় খলিফার বিরোধিতায় হযরত আলীর সমর্থকরা দিন দিন শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অনেকেই হযরত আলীকে খিলাফতের প্রকৃত হকদার দাবী করে। এভাবে কুরাইশ শাসনের বিরুদ্ধবাদীরা কুরাইশ গোত্রের অভ্যান্তরীন রাজনীতির ভেতর থেকে অকুরাইশ প্রতিপক্ষ এবং কুরাইশ প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক মাঠের এক কাতারে এসে আশ্রয় নেয়।
১৯৭২ সালে সানায় প্রাপ্ত হাতে লেখা কোরানের অংশ বিশেষ যা ৬৭১ সালের পূর্বে লেখা
এই খানে রাজনীতির খেলা নতুন দিকে মোড় নেয়, এই মতবাদের মুল কথা হল প্রত্যেক নবীই একজন “অসি” বা প্রতিনিধি রেখে যান। আর এ অনুযায়ী ইসলামের নবীর প্রতিনিধি হল হযরত আলী। অথচ মুসলমানরা হযরত আলীকে রেখে ইতিমধ্যে তিন জন খলিফা নিয়োগ করেছেন, এখন সবার উচিত হযরত আলীকে সাহায্য করা এবং বর্তমান খলিফাকে পদচ্যুত করা। এই মতবাদের মুল প্রবক্তার নাম আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা। এ মতবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে সাবা মদীনা থেকে কুফা এবং বসরা ভ্রমন করে। কুফার মালিক আশতার এ মতবাদ লুফে নেন, বসরার খলিফা বিরোধীরাও সাবার সাথে যোগ দেয় এর পর সাবা সিরিয়া গেলে সেখানে সুবিধা করতে পারে না কারন সিরিয়ার মানুষরা খলিফার অনুগত ছিল। সাবা এরপর মিশর ভ্রমন করলে সেখানে সে খলিফা বিরোধীদের পেয়ে সেখানে অবস্থান করে।
সাবা প্রচার করতেন, “আমি তাদের প্রতি আশ্চর্য বোধ করি, যারা বলে ঈসা ফিরে আসবে কিন্তু মুহাম্মদ ফিরে আসবে না। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “নিশ্চয় যিনি আপনার উপর কুরআনকে বিধানস্বরূপ দিয়েছেন, অবশ্যই তিনি তোমাকে প্রত্যাবর্তনস্থলে ফিরিয়ে নেবেন”। সুরা কাসাস: (৮৫) অতএব ঈসার তুলনায় মুহাম্মদ ফিরে আসার বেশী হকদার। এক হাজার নবী ও এক হাজার ওসি ছিল, আলী হচ্ছে মুহাম্মদের ওসি। অতঃপর সে বলে : মুহাম্মদ সর্বশেষ নবী আর আলী সর্বশেষ ওসি”। (“তারিখে তাবারি” : খঃ ৪ পৃঃ ৩৪০) (পাঠক খেয়াল করুন শিয়া ধারার উৎপত্তি কিন্তু শুরু হল)
বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে মূল্যবান নিদর্শনের তালিকায় এবার যোগ হলো- হজরত উসমান (রা.)-এর সময়ের হাতে লেখা পবিত্র কোরআন ‘মাসহাফে উসমানি’র একটি ছায়ালিপি।
খলিফা উসমানের বিরুদ্ধে আরো কতগুলো অভিযোগ বিস্তার লাভ করে তার মাঝে অন্যতম ছিল পবিত্র কুরান ধ্বংস করা (নাউজুবিল্লাহ)।হযরত উসমান খলিফা হবার পর বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন খিলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে কুরান পাঠের ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। হযরত হুযায়ফা ইবনে ইয়ামন নামে জনৈক সাহাবী উসমান (রাঃ) কে জানান যে তিনি বসরা, কুফা, রাই, সিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল ভ্রমন করে দেখছেন যে একেক অঞ্চলের লোক এক এক রকম ভাবে কুরান তেলাওয়াত করছে। হযরত উসমান (রাঃ) প্রমাদ গুনলেন। তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের কুরানের পান্ডুলিপি তলব করলেন এবং দেখেন যে সত্যিই একটির সাথে অন্যটির যথেষ্ট অমিল। তিনি হযরত আবু বকরের সময়ের সংগৃহিত হযরত যায়িদ বিন সাবিত (রাঃ) সংকলিত কুরানের পান্ডুলিপি অনুসরনের নির্দেশ দেন (দেখুন খোলাফায়ে রাশেদীন, জীবন ও কর্ম লেখক মোহাম্মদ নাছের উদ্দীন অধ্যায় ৭)
কোরআনটির দৈর্ঘ্য ১০ ইঞ্চি। প্রস্থ ১ ফুট। উচ্চতা ৩ ইঞ্চি। ওজন সাড়ে ৭ কেজি। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৭২।
এর সব কিছুই হযরত যায়েদের নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে করা হয়। ৬৫১ সালে তিনি সব হযরত যায়িদের পান্ডুলিপি রেখে বাকী সব পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন, এবং সব জায়গায় হযরত যায়িদের পান্ডুলিপির নকল পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন। এক মাত্র কুফার হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ খলিফার পাঠানো পান্ডুলিপি গ্রহন করেনা তিনি নিজস্ব সংগৃহিত কিরাতের ওপর অনঢ় থাকেন। বিদ্রোহীরা এক্ষেত্রে খলিফাকে ব্লাসফেমী আইনে অভিযুক্ত করেন এবং গোড়া এবং ধর্মান্ধ সমর্থকদের সমর্থন লাভ করে।
প্রসঙ্গতঃ এখানে খুব জরুরী একটা বিষয় উল্লেখ্য করি, অনেক জায়গায়ই দেখবেন এই প্রসঙ্গে যারা ইসলাম নিয়ে বিতর্ক টানতে পছন্দ করে তারা দেখবেন কোথাও কোথাও বলে কোরানের নাকি ৭ টি ভার্সন আছে, মুলত এটা ৭ টি ভার্সন না একে আরবীতে হারফ বলে হারফ মানে উপভাষা। তারা বলতে চান যে কুরআন ঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়নি এবং সাহাবীগণ আল কুরআনকে পরিবর্তন করে ফেলেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। এই ৭ হারফ নিয়ে কোন বিভ্রান্তিতে পড়বেন না। হাদীসে আছে “নিশ্চয়ই কুরআন কে সাত হারফে নাযিল করা হয়েছে, সুতারাং সেটি তোমার কাছে সহজ মনে হয়, সেভাবে তিলওয়াত কর।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৪১৯) এখানে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লেখার সুযোগ নাই, বিভিন্ন তাফসীরে এর বিশদ বর্ননা আছ। অন লাইনেও বেশ কিছু আর্টিকেল পাবেন এ ব্যাপারে।
৬৫৫ সালে খলিফা উসমান হজ্ব সমাপনান্তে মদিনায় অভিযোগকারীদের নিয়ে এক বৈঠকে বসেন সেখানে হযরত আলী, হযরত তালহা, হযরত যুবাইর হযরত মুয়াবিয়া উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম উঠে দাড়িয়ে তার বক্তব্যে বলেন, “তার (খলিফা) সম্পর্কে মানুষের মুখে নানা কথা শোনা যায়, যদি আপনারা এব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে পৌছান তবে প্রকাশ্যে বলেন, আমি তার জবাব দেব। হ্যা আমি এ কথাও বলে দিতে চাই যদি কারো খলিফা হবার সাধ জাগে তবে তার বা তাদের মনে রাখা উচিত যে, শেষ পর্যন্ত পেছন ফিরে পালানো ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কিছুই জুটবে না।" হযরত আলী মুয়াবিয়ার শেষ কথাটির ওপর কড়া হুশিয়ারি দিয়ে আর কোন কথা না বলে বসে পড়েন। (দেখুন ইসলামের ইতিহাস, প্রথম খন্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ)। বৈঠকে কোন সিদ্ধান্ত হয় না। হযরত উসমান নিজের পক্ষে বিভিন্ন অভিযোগকারীদের অভিযোগের জবাব দেন। কিন্তু তা কতজনকে কতটুকু সন্তুষ্ট করে তা বুঝা যায় না।
বৈঠক শেষে হযরত মুয়াবিয়া সিরিয়া গমনের আগে হযরত উসমান কে তার সাথে সিরিয়া যেতে বলেন কিন্তু তিনি মদিনা ছেড়ে সিরিয়া যেতে অস্বীকার করেন কারন সেটা হত তার নৈতিক পরাজয়। এব্যাপারে অনেক আলোচনা বিভিন্ন জায়গায় দেখবেন (দেখুন খোলাফায়ে রাশেদীন, জীবন ও কর্ম লেখক মোহাম্মদ নাছের উদ্দীন)
ওই সময় তৎকালীন ইসলামী দুনিয়া পাঁচটি গুরুত্বপূর্ন কেন্দ্রে বিভক্ত ছিল। সেগুলো হল ইরাকের কুফা, সিরিয়া জর্ডান ফিলিস্তিনের প্রানকেন্দ্র দামেস্ক, মিশরের রাজধানী ফুসতাত, ইরাকের আর এক সমৃদ্ধ নগরী বসরা এবং আরব উপদ্বীপের প্রান কেন্দ্র মদীনা। এক মাত্র সিরিয়া ছাড়া খিলাফতের অন্যান্য কেন্দ্র গুলো খলিফাকে অপসারনে অথবা হত্যায় বদ্ধ পরিকর হয়। এই সময় “হুব্বে আলী” বা "আলী প্রেম" কথাটি একটি স্লোগানে পরিনত হয়। লেখার এই পর্যায়ে এসে আমাকে লেখা আরো সংকুচিত করতে হচ্ছে, যদিও প্রথম থেকেই সেটা হচ্ছিল। কারন আমাকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে আমি কোন বই বা প্রবন্ধ লিখছি না আমি ব্লগে লিখছি। সেক্ষত্রে অনেক ঘটনা বাদ দিয়ে হযরত উসমানের মৃত্যুর দিকে দৃষ্টি দেই।
লেইডেন ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরীতে রক্ষিত কোরান শরীফের পাতা ৬৫০-৭০০ খ্রিঃ
কুফা, বসরা ও মিশর থেকে তিনটি সেনাবাহিনী খলিফাকে উৎখাতের লক্ষ্যে মদিনার দিকে অগ্রসর হয়, এই তিন ভাগে হযরত আলী, হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম আর এক দল ছিল হযরত তালহার অনুসারী। তিনটি দল মদিনার উপকন্ঠে পৌছে তিন দলের প্রতিনিধিরা মদীনায় অবস্থানরত যার যার পছন্দের নেতাকে খলিফা হতে অনুরোধ করে। কিন্তু ওই রকম পরিস্থিতিতে উপরোক্ত তিন জনের কেউই বাইয়াত গ্রহনে রাজী হন না। এরপর কিছু ঘটনা ঘটে যার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহীরা যে যার এলাকায় ফেরত যেতে শুরু করে কিন্তু কিছু দূর যাবার পর এক চক্রান্তের কারনে আবার মদিনা ফেরত আসে এবং হযরত আলীকে খলিফা হবার জন্য চাপ দেয়। হযরত আলী রেগে গিয়ে বলেন, “এরূপ কাজে আমি কি করে তোমাদের সাহায্য করতে পারি” তখন তারা বললঃ “কিন্তু আপনিই তো পত্র দিয়ে আমাদের জানিয়েছিলেন যে আমরা যদি ফিরে আসি তবে আপনি আমাদের খলিফা উৎখাতে সাহায্য করবেন।” হযরত আলী উপস্থিত জন সাধারনের কাছে এ ধরনের কোন চিঠি লেখা অস্বীকার করেন এবং রাগ করে মদিনা ছেড়ে “আহজারুয যায়ত” নামক স্থানে চলে যান।
এক পর্যায়ে বিদ্রোহীরা তাকে (খলিফাকে) অবরোধ করে প্রায় ত্রিশ দিন খলিফাকে পদত্যাগের জন্য চাপ দেয় কিন্তু খলিফা রাজি হয় না। (কেন হয় না তার নানা বিধ কারন আছে যা এখানে স্থানাভাবে আলোচনা করা সম্ভব না) এর পর টানা দশ দিন তাকে গৃহে অবরুদ্ধ করে ফেলে এমন কি তার খাবার এবং পানি সরবারহ বন্ধ করে দেয়।
উসমান (রা) গৃহবন্দী হয়ে পড়লেন। ঘরের চারপাশে বিদ্রোহীরা। যত দিন যেতে লাগলো, তত বিদ্রোহী জড়ো হতে লাগলো বাহিরে, আগুনও ধরিয়ে দিল। মদিনা থেকে অনেক স্থানীয় মানুষ মক্কায় হজ্ব করতে গিয়েছে আগেই। তাই কাছের মানুষও কম উসমান (রা) এর। বিদ্রোহীরা বুঝতে পারলো, হজ্ব শেষ হয়ে গেলেই পুরো সাম্রাজ্য থেকে আসা হাজিরা উসমান (রা) এর পক্ষে মদিনা ছুটে আসবে, এর আগেই যা করবার তা করতে হবে। উসমান (রা) এর অনুসারীরা তাদের বিরুদ্ধে লড়ার অনুমতি চাইলো। কিন্তু তিনি মানা করলেন। এক মুসলিম আরেক মুসলিমের রক্ত ঝরাতে পারে না। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা) এবং আলী (রা) এর দুই পুত্র হাসান (রা) ও হুসাইন (রা) গেট বন্ধ করে পাহারা দিতে লাগলেন।
উসমান (রাঃ) বলে এই কোরান শরীফকে মনে করা হয়
৬৫৬ সালের ১৭ জুন। যখন বিদ্রোহীরা দেখলো গেটে ভালোই পাহারা আছে, তখন মিসরীয় বিদ্রোহীরা প্রতিবেশীর বাড়ির দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে ভেতরে নেমে পড়ল। গেটের পাহারা দেয়া সাহাবীরা জানলেনও না কী হলো। বিদ্রোহীরা উসমান (রা) এর কক্ষে চুপে চুপে ঢুকে পড়ল। তখন রোজা রাখা উসমান (রা) কুরআন পড়ছিলেন (উপরে সে কুরআনের ছবি আছে), তিনি যখন সুরা বাকারার ১৩৭ নং আয়াতে পৌঁছালেনঃ “অতএব তারা যদি ঈমান আনে, তোমাদের ঈমান আনার মত, তবে তারা সুপথ পাবে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারাই হঠকারিতায় রয়েছে। সুতরাং এখন তাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে আল্লাহই যথেষ্ট। তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী। [ সুরা বাকারা ২:১৩৭ ]
খলিফার কক্ষে সর্ব প্রথম ঢুকেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)এর সন্তান । এই একজন মাত্র সাহাবী কি কারণে যেন এই ফিতনায় জড়িয়ে পড়েছিল, তা বোধগম্য নয়। মুহাম্মদ বিন আবু বকর হযরত উসমান (রা)এর দাড়ি ধরে জিজ্ঞেস করে- হে মূর্খ বুড়ো! কোন ধর্মের উপর আছো তুমি? উসমান (রা)উত্তরে বলেন, ইসলাম ধর্মের উপর আছি। আমি মূর্খ বুড়ো নই। আমি আমীরুল মুমিনিন।
তখন মুহাম্মদ বিন আবু বকর বললেন, তুমি আল্লাহর কিতাবের হুকুম পরিবর্তন করে দিয়েছ।
হযরত উসমান বললেন, এই যে কিতাবুল্লাহ আমাদের সামনেই আছে, ভালো করে পড়ে দেখো।
তখন সে সজোরে দাড়ি টেনে ধরে বলল, আমরা কেয়ামতের দিবসে একথা বলতে চাই না ‘হে আল্লাহ! আমরা আমাদের নেতাদের অনুসরণ করেছি। তারা আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছে।’
আসলে মুহাম্মদ বিন আবু বকর ও তার কিছু বন্ধু মনে করেছিল আমীরুল মুমিনিনকে হত্যা করা বড় পুণ্যের কাজ এবং এই দায়িত্ব পালন করলে নাজাত পাওয়া যাবে। তখন মুহাম্মদকে উদ্দেশ্য করে উসমান (রা) বললেন, বেটা! তুমি যে দাড়ি ধরে টানাটানি করছ সে দাড়িকে তোমার পিতা সম্মান করতেন। এই কথা শোনার সাথে সাথে মুহাম্মদ বিন আবু বকর লজ্জিত হয়ে সরে গেলেন।
এরপর বিদ্রোহীরা তার ঘরে প্রবেশ করে সজোরে মাথায় আঘাত করল। উসমান (রা) এর স্ত্রী নাইলা নিজের দেহ দিয়ে উসমান (রা)-কে রক্ষা করতে গেলেন, হাত উঁচু করে তরবারির আঘাত ঠেকাতে গেলেন। নাইলা-র আঙুলগুলো কেটে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এরপরের আঘাতেই শহিদ হলেন উসমান (রা)। তাঁর দাসেরা তাঁকে বাঁচাতে গেলে একজন নিহত হয়, আর আরেকজন এক বিদ্রোহীকে মারতে সক্ষম হয়। [কথিত আছে, উসমান (রা) এর রক্তে ভেজা কুরআন তাশখন্দের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।]
বিদ্রোহীরা উসমান (রা) এর লাশ বিকৃত করতে চেষ্টা করল। কিন্তু তাঁর স্ত্রী নাইলা আর উম্ম আলবানিন লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা করতে চাইলেন, তারা চিৎকার করতে থাকলেন। বিদ্রোহীরা পালিয়ে যাবার সময় ধনী উসমান (রা) এর বাসা লুট করে যায়, এমনকি মেয়েদের নেকাব পর্যন্ত নিয়ে যায়। যখন গেট থেকে সাহাবীরা এসে পৌঁছালেন ততক্ষণে সব শেষ, তারা কিছু করতে পারলেন না। মাঝখান দিয়ে হাসান (রা) ও মারওয়ান আহত হন।
টানা তিন দিন উসমান (রা) এর লাশ পড়ে ছিল বাসায়। অবশেষে মহানবীর এক জন স্ত্রী উম্মে হাবীবা মসজিদে নববীর সিড়িতে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যে বললেন “হে বিদ্রোহীরা তোমরা যদি উসমানকে সমাহিত করার অনুমতি না দাও তবে আমি রাসুলের পত্নী ঘোষনা করছি যে আমি আমার মাথার চুল উন্মুক্ত করে রাস্তায় নেমে পড়ব এবং আমিই উসমানের লাশ সমাহিত করব।” নবী পত্নীর এই ঘোষনার পর বিদ্রোহীরা কিছুটা নমনীয় হয় এবং লাশ দাফনের অনুমতি দেয়। নাইলা তখন কয়েকজন সমর্থকের সহায়তায় তাঁর দাফন দেবার চেষ্টা করলেন। মাত্র ১২ জন কাছের মানুষ পাওয়া গেল। গোধূলির সময় লাশ নিয়ে যাওয়া হলো, কোনো কফিন বা খাটিয়া পাওয়া যায়নি। তাঁকে কোনো গোসল দেয়া হয়নি, কারণ ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী শহীদদের কোনো গোসল নেই। কাফনের কাপড়ও পরানো হয়নি। যে কাপড়ে তিনি মারা যান, সে কাপড়েই তাঁকে কবরে নিয়ে যাওয়া হয়।
উসমান (রা) এর কবর। ছবিসূত্রঃ Wikimedia Commons
আলী (রা), হাসান (রা), হুসাইন (রা) ও অন্যরা লাশ বহন করলেন। রাতের আঁধারে নাইলা পেছন পেছন আসছিলেন একটি কুপিবাতি নিয়ে। কিন্তু সেটাও নিভিয়ে দিতে হলো যেন বিদ্রোহীরা টের না পায়। মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে পৌঁছানোর পর দেখা গেলো বিদ্রোহীরা টের পেয়ে সেখানে হাজির। তারা মুসলিম কবরস্থানে উসমান (রা)-কে দাফন করতে দেবে না। নিরুপায় হয়ে তাঁকে দাফন করা হলো পেছনের ইহুদী কবরস্থানে। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফারা এই দুই কবরস্থানের প্রাচীর ভেঙে দুই কবরস্থান এক করে ফেলেন, যেন উসমান (রা) মুসলিম কবরস্থানে শায়িত হতে পারেন।জানাজা পড়ালেন জাবির (রা)। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া লাশ কবরে নামানো হলো। দাফনের পর নাইলা কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু নীরবতা বজায়ে রাখবার জন্য তাকে চুপ থাকতে হলো। নীরবেই চলে গেলেন উসমান (রা)। (দেখুন এবং চাইলে ডাউন লোড করে এই মুল্যবান বই দুটো পড়তেও পারেন The Biography of Uthman Ibn Affan (R.A) লেখক Dr. Ali Muhammad Sallaabee এবং Uthman bin Affan (R.A) History of Islam )
হযরত আনাস (রা) বললেন, “হযরত ওসমানের জীবদ্দশা পর্যন্ত আল্লাহর তরবারি কোষবদ্ধ ছিল। তার শাহাদাতের পর অদ্য এই তরবারি কোষমুক্ত হবে এবং কেয়ামত পর্যন্ত উহা কোষমুক্তই থাকবে।” বাস্তবিকই সেই যে তরবারি কোষমুক্ত হয়ে নিজের ভাইদের রক্ত ঝড়ানো শুরু হয়েছে যা অদ্যাবদি চলছে।
নোটঃ এই লেখা গুলো লিখতে গিয়ে আমি ধর্মীয় দৃষ্টিকোন ব্যাবহারের থেকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোনের প্রতি বেশী খেয়ালা রেখেছি, তারপরো কোথাও যদি কোন ভুল কারো কাছে পরিলক্ষিত হয় দয়া করে রেফারেন্স সহ জানালে কৃতজ্ঞতার সাথে ঠিক করে দেব। পরিসরের কারনে অনেক কিছুই বাদ দিয়ে যেতে হয়েছে যা আমার ইচ্ছা কৃত না একান্ত অনিচ্ছাকৃত।
পরবর্তী পর্বঃ খোলাফায়ে রাশেদিন হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৩:৪০