গতকাল আমার পোষ্ট দেবার পর কিছু কমেন্ট আসছে, সে কমেন্টগুলোর উত্তর আমি পরে দেব, তার আগে কিছু কথা বলে নেই। খ্রিষ্টান ধর্মের ব্যাপারে কিছু লিখতে গেলে নিউ টেষ্টামেন্টের উদ্ধৃতি দিতেই হয় কারন নিউ টেষ্টামেন্ট বা বাইবেল হল খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ। সে ধর্মের প্রচারক হিসাবে তারা যীশুকে মানে। যদিও যীশু জন্ম নিয়েছিল এক ইহুদী পরিবারে এবং তার জীবদ্দশায় তার প্রচারিত ধর্ম সেভাবে প্রসার লাভ করেনি। পরে সে ধর্ম মুলতঃ যীশুর শিষ্য পল বা পলৌসের হাত ধরেই ব্যাপক প্রচার পায় যদিও প্রথম দিকে এই পল ছিল মারাত্মক খ্রিষ্টান বিদ্বেষী যা আমার পূর্ববর্তী বিভিন্ন পোষ্টে অসংখ্যবার বলেছি। দেখুন রোম যখন পুড়ছিলো নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিল ।
এইবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে, খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস্য ঈশ্বরপুত্র যীশু আর মুসলমানদের রাসুল ঈশা (অঃ) একই ব্যাক্তি হিসাবে স্বীকৃত। কিন্তু বাইবেলের যীশু এবং পবিত্র কোরান শরীফের ঈশা (অঃ) এর মাঝে যদি আপনি যোগ সুত্র টানতে যান তবে আমি বলব তেল আর পানি এক করার এক বোকামিতে নিমজ্জিত আছেন। বাইবেলে বর্নিত যীশু আর কোরানে বর্নিত ঈশা (অঃ) এর মাঝে মিল অতি সামান্য। যদিও দুইজন কিন্তু একই ব্যাক্তি। আমি এখানে পোষ্ট দিচ্ছি খ্রিষ্টান ধর্মের আলোকে যীশুকে নিয়ে এখানে কেউ যদি যীশু এবং ঈশা (অঃ) তুল্য বিচার করতে যান এই পোষ্টের সাপেক্ষে তবে সেটা হবে আপনার একান্ত নিজস্ব প্রচেষ্টা এখানে আমাকে প্রশ্ন করার কিছু নেই। মনে রাখবেন এখানে আলোচিত হচ্ছে খ্রিষ্টানদের ধর্ম প্রচারক জেসাস কে নিয়ে।
আসি তৃতীয় প্রসঙ্গে, অনেকেই এগুলোকে রূপকথা বা বানানো বলে অনেকটা ব্যাঙ্গোক্তি করছেন, এক্ষেত্রে আমার ব্যাখ্যা হল প্রতিটা ধর্মাবলাম্বীকে আমি সন্মানের সাথে দেখি, আমি যা লিখছি সেগুলো খ্রিষ্টান ধর্মের আলোকে লিখছি, আবার যখন মোজেসকে নিয়ে লিখব বা লিখছি তখন আপনাকে বুঝতে হবে আমি মোজেস বলতে ইহুদী ধর্মাবলাম্বীদের নবী মোজেসের কথা বলছি তাদের ওল্ড টেষ্টামেন্ট বা তোরাহ এর আলোকে। আপনি যদি এখন আমাকে এই মোজেসের সাথে মুসলমানদের নবী হযরত মুসা (অঃ) এর তুল্য বিচার করে আমাকে ব্যাখ্যা দিতে বলেন তবে সে ক্ষেত্রে আমি অপারাগ কারন ইহুদীরা যেভাবে মোজেসকে তাদের ধর্মে তুলে ধরেছে, মুসলমানদের মুসা (অঃ) তার থেকে অনেক অনেক ভিন্ন তাই একই ব্যাক্তি হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে তুলনা করতে যাওয়া আমার কাছে অনেকটা অপরিপক্কতার নিদর্শন অথবা অন্য ধর্মাবলম্বীকে খাটো বা ভুল প্রমান করতে যাবার প্রয়াস, যেটা আমি কোন অবস্থাতেই চাইব না। আমি ব্যাক্তিগতভাবে এর পক্ষপাতি না।
আসি চতুর্থ প্রসঙ্গে, ধর্ম একান্ত বিশ্বাসের ব্যাপার। যার যার ধর্ম তার কাছে বিশ্বাসের চুড়ান্ত রূপ বিধায়ই সে সেই ধর্ম পালন করছে। এখানে ধর্ম বিশ্বাসের বিপরীতে আর এক দল মানুষ আছে যারা ধর্ম বিশ্বাস করেনা অবিশ্বাসী, তাদের কাছে ধর্ম বিশ্বাসটা বোকামী বা অযৌক্তিক। সেটাও কোন সমস্যা না। কিন্তু অবিশ্বাসী যখন বিশ্বাসীকে তার বিশ্বাসে আঘাত করে ধর্মকে হেয় করে তখন সেটা কোন রূপ বুদ্ধিমানী বা যৌক্তিক সে বিষয় আমি এখনো অনুধাবন করতে পারিনি।
পঞ্চম এবং শেষ ব্যাপার, কেন আমি এই সব নিয়ে লিখি? ব্যাক্তি জীবনে আমি একজন মুসলমান। তাত্ত্বিকভাবে যে অর্থে ধার্মিক বুঝায় আমি ঠিক সে অর্থে নিজেকে ধার্মিক বলে দাবী করার যোগ্যতা রাখিনা। তবে ধর্ম আমার কাছে এক অপার রহস্য বলেই মনে হয়, তাই নিজের জ্ঞান বাড়ানোর জন্য সামান্য কিছু পড়াশুনা করি এবং সেখান থেকে মাঝে সাঝে বিভিন্ন জায়গা থেকে এক করে এখানে পোষ্ট লেখার চেষ্টা করি, কেউ কেউ হয়ত এখানে আমাকে বলবেন এই সব জানা বা লেখার মাধ্যমে আমি নিজে অধার্মিক কাজ করছি, কিন্তু আমি নিজে এব্যাপারে দ্বিমত পোষন করি এই কারনে যে, এই সব জানলেই যে আমার বিশ্বাস হালকা হয়ে যাবে সে ভয় আমার অন্তত নেই, অনেকটা হাসের মত পানিতে সাতার কেটেও গায়ে পানি লাগে না। নিজের বিশ্বাস এত ঠুনকো না যে অন্য ধর্ম নিয়ে জানলেই বা পড়লেই নিজ ধর্মে আস্থা হারাব।
আসি মুল পোষ্টে। গত কাল পোষ্ট দিয়েছিলাম (যীশুর রহস্যময় বাল্যকালঃ মিশর অবস্থান কাল বার বছর পর্যন্ত) সেখানে মথির গসপেলের দ্বিতীয় অধ্যায়ের একটা উদ্ধৃতি দিয়েছিলামঃ
“রাজা হেরোডের আমলে যিহুদীয়া দেশের বেথেলহেম শহরে যীশুর জন্ম হয়, সেই সময় প্রাচ্য দেশ থেকে কয়েকজন জ্যোতিষী জেরুজালেম শহরে আসে। তারা জানতে চাইল ইহুদীদের যে রাজা জন্ম গ্রহন করেছেন তিনি কোথায়? প্রাচ্যের আকাশে তার জন্মের প্রতীক তারার উদয় আমরা দেখেছি। আমরা এসেছি তাকে প্রনাম করতে” (মথি ২:১-২)
এই পয়েন্টে এক বিজ্ঞ ব্লগার তার মন্তব্যর একাংশে দিয়েছেন “কোন তারকা কোথায়ও স্হির হয় না; মানুষ সামান্য কয়টি তারকাকে চেনেন: সন্ধ্যা তারা, শুকতারা, ধ্রূব তারা। এগুলোকে পৃথিবী থেকে একই সময়ে একই স্হানে দেখা যায়।” উনার এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে দেখলাম এর প্রতি মন্তব্য এত বড় হয়ে যায় যে, তা দিয়ে একটা পোষ্টই দেয়া যায়, সেই সুবাদে এই পোষ্ট লেখা। এখানে যা লেখা হবে তার প্রেক্ষাপট হবে জ্যোতিষি শাস্ত্র। ব্যাক্তিগত ভাবে আমি নিজে এই শাস্ত্র বিশ্বাস করিনা, কিন্তু জানার জন্য ওই পোষ্ট দিয়েছিলাম, এখন উনি আমাকে যে প্রশ্ন করছেন তার জবাব দিতে গেলে এ্যাষ্ট্রোনোমি আর এ্যাষ্ট্রোলজির সমন্বয় করতে হয়, যা আমার জন্য খুবই কঠিন একটা বিষয়। এই বিষয়ে আমার জ্ঞান প্রায় শুন্যের কোঠায়, তাও চেষ্টা করব জবাব দেবার। বিভিন্ন অন্তর্জাল ফিচার পড়ে যেটুকু জ্ঞান পেয়েছি তা অনেকটা নিম্ন রূপঃ
প্রথমেই আপনার মনে রাখতে হবে যীশুর জন্ম সাল নিয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায় নি, এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত, যদিও খ্রিষ্টীয় মতে যীশুর জন্ম সাল কে প্রথম খ্রিষ্টীয় বর্ষ হিসাবে ধরা হয়, তবে এনিয়ে চুড়ান্ত মতবিরোধ আছে ঐতিহাসিকদের মধ্যে। তবে যীশু জন্ম নিয়েছিল খ্রিষ্ট পূর্ব ৭ সাল থেকে ১ লা খ্রিষ্টাব্দের মাঝে এনিয়ে কোন মতবিরোধ নেই।
আধুনিক কালে এ্যাষ্ট্রোনোমি অনেক উন্নত। খুব সহজ কিছু হিসাব নিকাশ করে হাজার হাজার বছর আগের নক্ষত্র তারার অবস্থান কি ছিল তা নির্নয় করা খুব একটা কঠিন কিছু না। জোহান কেপলার এর সময় সেই ষোড়শ শতাব্দীতে এ সহজ হিসাব করা সম্ভব ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৭ সালে বৃহস্পতি আর শনির একই লাইনে আসা বা সমপাতন হওয়ার ফলে যে নতুন জ্যোতিস্ক (পড়ুন নক্ষত্র) সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই বিখ্যাত বেথেলহেমের তারা। যদিও পরবর্তীতে কেপলারের এই নতুন জোতিস্ক তৈরী হওয়ার ধারনা বাতিল হয়ে যায় কারন দুটো গ্রহের সমপাতন হলে কোন নতুন জ্যোতিস্ক তৈরী হয় না। কিন্তু এটা এখন প্রমানিত যে খ্রিষ্ট পূর্ব ৭ সালে শনি এবং বৃহস্পতি এক লাইনে চলে এসেছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ৭ সালে পাইসেস নক্ষত্রপুঞ্জে, শনি এবং বৃহস্পতির মাঝে তিনবার সমাপাতন ঘটে (এর সাথে জ্যোতিষ শাস্ত্র জড়িত)। মজার ব্যাপার হল পাইসেস মানে হল মাছ এবং প্রথম দিকে যীশুর প্রতীক হয়ে ওঠে এই মাছ এবং খ্রিষ্টানরা নিজেদের চেনার জন্য গোপন প্রতীক ছিল মাছ। এই ধরনের সমপাতন জ্যোতিষ শাস্ত্রের এই পাইসেস বা মাছ চিহ্নে প্রতি ৭৯৪ বছরে একবার ঘটে। এই সময় শনি এবং বৃহস্পতি কাছাকাছি আসার কারনে রাতের আকাশে এক জোড়া উজ্জ্বল আলোর বলয় হিসাবে দেখা যেত।
খ্রিষ্টপূর্ব ৮ সালের শেষের দিকে বৃহস্পতি এবং শনি পশ্চিম আকাশে কেবল সন্ধ্যাবেলা দেখা যেত। খ্রিষ্টপূর্ব ৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সুর্যরশ্মির কারনে বৃহস্পতিকে আর দেখা যায় না। মে ২৯, খ্রিষ্ট পূর্ব ৭ সালে দুটো গ্রহ ১° বিচ্যুতিতে প্রায় একই কৌনিক দূরত্বে দেখা যায়, সেই বছর একই ঘটনা ঘটে ২৯ শে সেপ্টেম্বর এবং ৪ ই ডিসেম্বর। এর মানে দাড়ায় প্রায় দেড় বছর যাবত সুর্য অস্ত গেলে গ্রহ দুটোকে উজ্জ্বল ভাবে আকাশে দেখা যেত যা সেই সময় তাদের মাঝে ৩° র বেশী পার্থক্য ছিল না। এখানে কাকতলীয় ভাবে মথির গসপেলেও এই নক্ষত্রেরও তিনবার উল্লেখ্য করা হয়েছে। এখানে সেই তিনবার কখন কখন এসেছে তা উল্লেখ্য করে আপনাদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাব না। কেউ ইন্টেরেষ্টেড হলে মথির গসপেল দেখে নিতে পারেন। প্রায় বছর খানেক ধরে এই তারাদ্বয় মাঝ রাতে সর্বোচ্চ স্থানে পৌছাত।
পূর্বোল্লেখিত পোষ্টে (যীশুর রহস্যময় বাল্যকালঃ মিশর অবস্থান কাল বার বছর পর্যন্ত) পূব দেশীয় যে তিন জন (যদিও এই সংখ্যা নিয়ে কনফিউশান আছে) ম্যাজাই বা জ্যোতিষি বা জ্ঞানী ব্যাক্তির উল্লেখ্য করছি তারা যে এক রাতে ওই উজ্জ্বল তারা (যা বেথেলহেম ষ্টার নামে পরিচিত) দেখে পথ চলে নাই আশা রাখি বুজতে পারছেন, প্রায় কয়েক মাস বা হয়ত বছর জুড়ে কষ্টদায়ক ভ্রমন করে তারা বেথেলহেমে পৌছেছে ওই বেথেলহেম ষ্টার দেখে।
এই লেখা পড়ার সময় আপনাকে স্বরন রাখতে হবে বাইবেল কোন ঐশী গ্রন্থ না। মার্ক, মথি, লুক এবং যোহানের গসপেল নিয়ে নিউ টেষ্টামেন্ট বা বাইবেল লিখিত। এর আগে অসংখ্য গসপেল ছিল। “গসপেল” মানে হল সুংবাদ। এই সুংবাদ খ্রিষ্টান ধর্মের প্রথম দিকে দুঃসংবাদ হিসাবে দেখা দিল, কারন এত অধিক গসপেলের ভেতর সবাই দাবী করত তারটা ঠিক, এনিয়ে রক্তারক্তির পর্যায়ে চলে যায়, এ অবস্থায় হিয়েরাপোলিস প্যাপিয়াস, যাকে খ্রিষ্টের বারো শিষ্যের মধ্যে একজন ধরা হয় তিনি ১১০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ গসপেলগুলোকে একটা নিয়মে আনার চেষ্টা করেন কিন্তু তার সে চেষ্টা সাফল্য মন্ডিত হয় না অবশেষে দ্বিতীয় শতকের শেষ নাগাদ ইরেনিয়াস এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়ে সফল হন এবং উপরোল্লিখিত চারটি গসপেল নিয়ে নিউ টেষ্টামেন্ট বানান এবং সন্দেহজনক গসপেল গুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়। তার পরো কিছু কিছু গসপেল সে সময়ের কিছু মানুষ লুকিয়ে ফেলতে সক্ষম যার কিছু কিছু এখন আবিস্কার হচ্ছে।
কেউ সন্দেহজনক গসপেলের লিষ্ট দেখতে চাইলে এই List of Gospels ক্লিক করে এক নজর ঘুরে আসুন। আর আবিস্কৃত সন্দেহজনক গসপেলের নিয়ে আমার আগের একটা লেখা ছিল চাইলে ডেড সী স্ক্রোল এবং এসেন্স সম্প্রদায় করে ঘুরে আসুন।
সুত্রঃ List of Gospels, Pisces and the Christian Fish: astrological symbols in the Gospels and Jesus’ date of birth, The Star of Bethlehem , The Triple Planetary Conjunction of Jupiter-Saturn in 7 BC, Jesus Christ: Astrological Article and Chart, Solar Mythology and the Jesus Story, Can science explain the mystery of the Star of Bethlehem? , Kepler and the Star of Bethlehem, Can science explain the mystery of the Star of Bethlehem? , Star of Bethlehem: The astronomical explanations
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ২:৪৫