তিব্বতের নাম শুনলেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক রহস্যময় দেশ। নিষিদ্ধতার বেড়াজালে আটকানো এক রহস্যময় দেশ। অনেককাল এই দেশে বর্হিবিশ্বের মানুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় এই দেশ সন্মন্ধ্যে মানুষের এক অপার কৌতুহল তৈরী হয়। এখন অবশ্য কিছুটা শিথিল হওয়ায় এই রহস্যের ঘোরটেপ আস্তে আস্তে উন্মুক্ত হচ্ছে।
তিব্বতীদের প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম। এই দেশের প্রধান রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়গুরুকে বলা হয় দালাইলামা। এখানে “দালাই” শব্দের মানে জ্ঞানের সমুদ্র আর “লামা” মানে হল প্রধান। দুটোকে এক করলে দাড়ায় জ্ঞান সমুদ্রের প্রধান।
বৌদ্ধ ধর্ম দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত। একটি হচ্ছে হীনযান (স্থবিরবাদ), অন্যটি মহাযান। এদের মধ্যে মহাযানপন্থীরা বোধিস্বত্ত্ব মতবাদে বিশ্বাস করে। বোধিস্বত্ব(সাধু/সন্ন্যাসী)হচ্ছেন তিনি যিনি জগতের কল্যাণার্থে বারবার জন্মগ্রহণ করেন এবং বিশ্বের সকল জীবের মুক্তিলাভের উপায় করেন। সমস্ত বোধিস্বত্বদের মাঝে সবচেয়ে বেশি পূজিত ও সমাদৃত বোধিস্বত্বের নাম অবলোকিতেশ্বর।
অবলোকিতেশ্বর
অবলোকিতেশ্বর হলেন বোধিসত্ত্বগণের অন্যতম মধ্যে যিনি সকল বোধিসত্ত্বের মধ্যে প্রকাশমান করুণার আধার। মূলধারার মহাযান বৌদ্ধধর্মে ইনিই হলেন সর্বাধিক পূজিত বোধিসত্ত্ব এবং সর্বাপেক্ষা অধিক সমাদৃত। অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে যতক্ষণ এই পৃথিবীতে একটিও প্রাণী বদ্ধ থাকবে ততক্ষণ তিনি নির্বাণলাভ করবেন না। অবলোকিতেশ্বর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন তিব্বতি ভাষায় এনার নাম চেনরেজগ। ইনি হাতে পদ্ম ধারণ করে থাকেন বলে কখনও পদ্মপাণি হিসেবেও অভিহিত হন। আবার ইনিই লোকেশ্বর (অর্থাৎ জগতের প্রভু) নামেও পরিচিত। তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মানুসারে অবলোকিতেশ্বর দলাই লামা, এবং কারমাপা রূপে জীবকুলের মঙ্গলার্থ এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন।
মহাযান ধারার “গেলুগ” উপধারার বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা মনে করেন যে এই অবলোকিতেশ্বরই যুগে যুগে কালে কালে দালাইলামা হয়ে মানুষের রূপ ধারণ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে থাকেন। তাই, তিব্বতের জনসাধারণ দালাই লামাকে তাদের স্থানীয় ভাষায় বলে থাকেন কুনডুন, যার অর্থ “উপস্থিতি”। সময়ের সাথে সাথে মানুষের অগাধ বিশ্বাস ও আস্থার কারনে দালাই লামারা ধর্মগুরু থেকে হয়ে গেছেন রাজনৈতিক গুরুও, হয়ে গেছেন তিব্বতের পার্থিব-অপার্থিব, ইহলৌকিক-পরলৌকিক, এমনকি প্রশাসনিক ক্ষমতারও সবচেয়ে বড় অধিকারী। পঞ্চম দালাইলামা কে তিব্বতের রাজ্যগুলোর একত্রীকরনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তি হিসাবে মানা হয়।
সোনাম গিয়াৎসো
এই দালাইলামা নির্বাচন নিয়ে আজকে আমার পোষ্ট। বর্তমান দালাইলামা হিসাবে যিনি স্বীকৃত তিনি দালাইলামাদের চর্তুদশ অধঃস্তন। ১৫২৮ সালে মোঙ্গল শাসক আলতাই খান তিব্বতের লাসা অঞ্চলের সোনাম গিয়াৎসো কে সর্বপ্রথম দালাই লামা উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সোনাম গিয়াৎসোর পূর্ববর্তী দুইজনকে প্রথম ও দ্বিতীয় দালাই লামা ঘোষণা করা হয়। ফলে, সর্ব প্রথম দালাই লামা উপাধি পেয়ে থাকলেও দালাই লামাদের কার্যকালক্রমে সোনাম গিয়াৎসো এর অবস্থান গিয়ে দাঁড়ায় তৃতীয় স্থানে।
একজন দালাই লামার মৃত্যু হলে শুরু হয় নতুন দালাই লামা খোঁজার অভিযান। তিব্বতীয়রা বিশ্বাস করে নতুন কোনো মহাপুরুষ হয়ে ঠিকই আবার পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন অবলোকিতেশ্বর । তাদের কাজ শুধু খুঁজে বের করা। নতুন দালাই লামা খুঁজে পাওয়া গেলে তাঁকে নিয়ে আসা হয় আশ্রমে। তারপর আশ্রমের বৌদ্ধ ভিক্ষু সন্ন্যাসীরা সেখানে উপযুক্ত করে তৈরী করতে থাকেন তাদের নতুন দালাই লামাকে। ১৯৩৩ সালে ত্রয়োদশ দালাই লামার মৃত্যু হলে, শুরু হয় চতুর্দশ দালাই লামার অনুসন্ধান।
ত্রয়োদশ দালাইলামা থুবতেন গিয়াৎসোর
১৯৩৩ সালে ত্রয়োদশ দালাইলামা মারা যাবার আগে তার পরবর্তী নবজন্মের সময় এবং স্থানের ব্যাপারে কিছু কিছু ইঙ্গিত দিয়ে যান। পোটালা প্রসাদ যেখানে দালাইলামাদের আবাস স্থল সেখানে ত্রয়োদশ দালাইলামার মৃত্যুর পর তার দেহ ঐতিহ্যবাহী উপবেশনের মাধ্যমে দক্ষিন দিকে মুখ করে স্থাপন করা হত, কিন্তু এক দিন সকাল বেলা দেখা গেল তার মুখ পুর্ব দিকে ঘুরে আছে।
পোটালা প্রসাদ
পোটালা প্রসাদের যে মন্দিরে তার দেহ উপবেশিত ছিল সেখান থেকে উত্তর পূর্ব দিকে খুব একটা দূরে না, একটা কাঠের স্তম্ভে তারা আকৃতির এক রহস্যময় ফার্ন গাছের আবির্ভাব হয়।
এইসব আলামত দেখা গেলে মুখ্য লামারা এক যজ্ঞের আয়োজন করে এবং একজন ভিক্ষুকে সম্মোহিত করে তাকে দৈববানী প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে ব্যাবহার করে। ভিক্ষু বললেন উত্তর পুর্ব দিক থেকে এক সারি উজ্জ্বল মেঘ লাসার দিকে এগিয়ে আসছে, লাসা হল তিব্বতের রাজধানী, কিন্তু এই লামা পুরোহিতরা পরের দু বছর আর কোন আলামত দেখতে পায় না।
পবিত্র হ্রদ লাহমোর লাটসোই
অবশেষে ভারপ্রাপ্ত প্রধান লামা আরো ইঙ্গিত পাবার জন্য লাসা থেকে ১৪৪ কিলোমিটার দূরে চা’খোর গয়ালের কাছে অবস্থিত পবিত্র হ্রদ লাহমোর লাটসোই তে তীর্থ যাত্রা করে। তিব্বতীরা বিশ্বাস করে এই হ্রদের স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে ভবিষ্যত দেখা যায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত লামা সেখানে ধ্যান করে দিব্য মানশ্চক্ষ্যে দেখতে পারেন, একটি তিন তলা বিশিষ্ট মঠ যার চুড়া গুলো সোনা দিয়ে বাধানো, যার পাশে একটা ছোট চীনা ধাচের খামার বাড়ি। যার ছাদ সবুজটালির। এই পুরো দৃশ্যপটের ওপর উপরিস্থাপন করা রয়েছে, তিনটি তিব্বতী অক্ষর “আ” “কা” এবং “মা”। দায়িত্বপ্রাপ্ত লামা এই ঐশী দৃশ্য দেখে লাসায় ফিরে আসেন এবং নবজন্ম প্রাপ্ত লামার খোজে প্রস্ততি নিতে থাকেন।
এই প্রস্ততির গুরুত্বপূর্ন অংশ হল লামাদের ভবিষ্যতবানী এবং নির্দিষ্ট দিন ক্ষন ঠিক করে অনুসন্ধান শুরু করা। অবশেষে ১৯৩৭ সালে কয়েকটা অভিযাত্রী দলে বিভক্ত হয়ে লাসা থেকে ঐশী নির্দেশিত পূর্ব দিকে পবিত্র শিশু বা পুর্নজন্ম প্রাপ্ত দালাইলামার খোজে বের হন লামারা। প্রতিটা দলের সাথে দেয়া হয় পূর্ববর্তী লামার ব্যাবহৃত কিছু জিনিসপত্র যা নতুন লামা চিহ্নিত করতে প্রমান হিসাবে কাজ করবে, সে বিষয়ে পরে আসছি।
টাকসার গ্রাম
তাত্ত্বিক ভাবে এই পুর্ব দিকে হাজার কিলোমিটার দুরেও নতুন দালাইলামার পূর্ন জন্ম ঘটতে পারে। আক্ষরিক অর্থে চর্তুদশ দালাইলামা খুজতে গিয়ে তাই ঘটে। তিব্বতের সীমানা ছাড়িয়ে চীনা শাসনাধীন আমাডো জেলার টাকসার অঞ্চলে। লামাতন্ত্রের সংস্কার সাধনকারী সঙ পার জন্ম স্থান এই আমাডো জেলায়। অভিযাত্রী দল বেশ কয়েকজন সম্ভাবনাময় প্রার্থী খুজে পান কিন্তু কোন জনই দৈব বর্ননা অনুযায়ী এবং দালাইলামা নির্বাচনকারী পরীক্ষায় উত্তীর্ন হতে পারে না। অবশেষে এক তীব্র শীতের রাতে.......
টাকসারের এই বাড়ীতে জন্ম গ্রহন করেন চর্তুদশ দালাইলামা
টাকসার গ্রামের কাছে কুমবুমে এক অভিযাত্রী দল একটি মঠ দেখতে পায়, যেটা তিনতলা বিশিষ্ট, যার ছাদ গুলো কারুকার্য ময়, পাশেই একটা চীনা ধাচের খামার বাড়ি যার ছাদগুলো সবুজাভ নীল নক্সা করা। যা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান লামার দৈব বানীর সাথে খাপ খেয়ে যায়।
উচ্চ পদস্থ দুইজন লামা নিজেদের পরিচারকের ছদ্মবেশ নিয়ে একজন অপেক্ষাকৃত যুবক লামাকে নিজেদের প্রধান বানিয়ে সেই বাড়ীতে যায়, উদ্দেশ্য আর কিছুই না যাতে অনর্থক উত্তেজনা এড়ানো যায় এবং পুর্নজন্ম নেয়া লামার পরীক্ষা নেয়া। স্থানীয় মঠের দুজন প্রধানকে সাথে নিয়ে লাসা থেকে আগত তিন জনের ছোট্ট দল টি নির্দিষ্ট বাসায় গিয়ে কড়া নাড়ে।
পরিচারকের ভুমিকা নেয়া দুই উচ্চ পদস্থ লামা যাদের একজন লাসায় অবস্থিত সেরা মঠের লামা খিউটসাঙ রিনপোচেকে রান্ন ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়, অন্য ভিক্ষুকে সন্মানের সাথে মুল বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়। রান্না ঘরে বাসার ছোট ছেলেরা খেলা করছিলো, সেখানে খিউটসাঙ রিনপোচে বসার সাথে সাথে দুই বছরের এক ছোট ছেলে ঝাপ দিয়ে তার কোলে পড়ে।
বাচ্চা ছেলেটি খিউটসাঙ রিনপোচের কোলে উঠেই তার গলায় ঝুলানো জপ মালাটা টেনে নিতে চায় এবং নিজের বলে দাবী করে, বস্ততঃ ওই জপ মালাটা ছিল মৃত ত্রয়োদশ দালাইলামা থুবতেন গিয়াৎসোর। লামা খিউটসাঙ বাচ্চাটিকে বলে সে তাকে জপমালাটা অবশ্যই দেবে কিন্তু তাকে বলতে হবে সে কে – জিজ্ঞাস করতে যা দেরী দুই বছরের বাচ্চাটা আধো আধো স্বরে বলে ওঠে “সেরা আগা” মানে সেরা মঠের লামা। খিউটসাঙ মানে সেরা মঠের লামা তখন পরিচারকের ছদ্মবেশে তাই তাকে চেনার কোন সুযোগই ছিল না দুই বছরের বাচ্চার। এই সব লামারা কমবেশী অলৌকিক ঘটনার সাথে পরিচিত কিন্তু সেও চমকে ঊঠল দুই বছরের বাচ্চার উত্তরে, কিভাবে সে বুজল সে সেরা মঠের লামা?
এইবার খিউটসাঙ বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করে তাদের মালিক মানে যে যুবক লামাকে তারা তাদের প্রভু বানিয়ে আনছেন তার নাম কি? সে উত্তর সেয় “লবসাঙ”। বাস্তবিকই যুবক লামার নাম ছিল “লবসাঙ সিওয়াঙ”! এইবার পরিচারকের ছদ্মবেশ নেয়া দুই উচ্চপদস্থ লামা সারা দিন বাচ্চাটিকে অবজার্ভ করতে থাকে। তারা মোটামুটি নিশ্চিত তারা তাদের পুর্নজন্ম নেয়া দালাইলামা কে পেয়ে গেছে, কিন্তু তখনো কিছু পরীক্ষা বাকী আছে।
চোদ্দতম দালাইলামা তার পিতামাতা সহ
এই পর্যায়ে তারা বাচ্চাটির বাবা মা র কাছ থেকে কিছু অদ্ভুত তথ্য পায়। বাচ্চাটি যখন তার মায়ের গর্ভে তখন তখনো কিছু বিস্ময় কর ঘটনা ঘটে। তীব্র শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়ে অন্তঃস্বত্বা গৃহবধু বসে আছে তার স্বামীর শিয়রে। তিব্বতের এই অঞ্চলটাতে গত কয়েকবছর ধরে ফসল হয়না বললেই চলে। অন্য আর সব গৃহস্থের মত এই গৃহবধু আর তার স্বামীও কষ্টে-সৃষ্টে দিন পার করে দিতে থাকে। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একেবারেই অসুস্থ হয়ে পড়ে গৃহস্বামী। চারদিকের লক্ষণ দেখে গৃহবধুর মনে দানা বাঁধতে থাকে অশুভ আশঙ্কা। একে একে মারা যাচ্ছে ঘরের মুরগী, আস্তাবলের ঘোড়া আর মাঠে বাঁধা ইয়াক। এর মাঝেই একদিন হঠাৎ ভোর রাত্রির খানিকটা আগেই ঘুম ভেঙ্গে উঠে যেতে হয় তাদেরকে। তাদের ঘর আলো করে এসেছে ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান।
চোদ্দতম দালাইলামা তারা পরিবার সহ লাসায়
সন্তানের মুখ দেখা তাদের জন্য এবারই প্রথম নয়, এর আগে তাদের ঘরে আরো আট জন সন্তানের জন্ম হয়েছে। তিনি তার পিতা মাতার নবম ও দ্বিতীয় পুত্র সন্তান ছিলেন। যদিও তার মোট চৌদ্দ জন ভাই বোন জন্ম নেয় কিন্তু বেচে ছিল মাত্র সাত জন বাকীরা শিশু বয়সেই মারা যায়। নবজাতক জন্ম নিয়েই তারস্বরে কান্না করবে তেমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এই প্রথম তাদের কোনো সন্তান জন্ম নেয়ার পর কান্না করে উঠেনি।
এরকম অদ্ভুত জিনিস তিব্বতের এই সুউচ্চ পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত টাকসার অঞ্চলের লোকজন আগে কখনো দেখেনি। সেই না হয় মেনে নেয়া গেল, কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার হলো, ছেলে জন্মের পর থেকেই তার পিতা দিনে দিনে সুস্থ হতে শুরু করেছে, প্রতিদিনই ঘরের চালে এসে বসছে দুটো কাক, কিছুক্ষণ পরেই কাকদুটো চলে যাচ্ছে। প্রতিদিন যেন রুটিন করে এসে তারা দেখে যাচ্ছে সদ্যজাত এই অবাক শিশুটিকে। টাকসার অঞ্চলে কে না জানে, একমাত্র দালাইলামাদের জন্মের পরই জোড়া কাক এসে উপস্থিত হয় ঘরের চালে। সাধারণ ঘরে জন্ম নেয়া, দালাইলামাদের মত যার জন্মের পর ঘরের চালে জোড়া কাক এসে বসে, সেই অবাক শিশুটির পিতা নিজের এই ছেলের নাম রাখলো “লামো”, সুরক্ষাকারী।
দুই বছর বয়সী দালাইলামা
যাই হোক পরদিন লাসা থেকে আগত তিন জন ভিক্ষু আবার টাকসার থেকে রওনা দেয় লাসা অভিমুখে বাকী সব গুরুত্বপূর্ন লামাদের নিয়ে আসার জন্য, কিন্তু তখনো তারা লামোর বাবা মার কাছে খোলসা করে বলেনি লামোকে নিয়ে তারা কি ভাবছে? কিছুদিন পর যখন লাসা থেকে আনুষ্ঠানিক পোষাক পরিহিত উচ্চ পদস্থ এক দল লামা টাকসার কুমবুমে লামোদের বাড়ীতে ফিরে আসে তখন চমকে উঠল লামোর বাবা মা। তবে তখনো তারা জানত না তাদের এই নবম সন্তান হতে চলছে তিব্বতের সব চেয়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক আধ্যাত্মিক ব্যাক্তি।
বর্তমানে কুমবুম মঠ
তারা ভাবছিলো কিছুদিন আগে তাদের বাড়ীর পাশ্ববর্তী কুমবুম মঠের একজন প্রধান লামা মারা গেছে তাদের সন্তান বোধ হয় সেই কুমবুম মঠের প্রধান লামার পুর্নজন্ম প্রাপ্ত লামা। পুর্ন জন্মপ্রাপ্তরা সাধারনতঃ তাদের পূর্ব জন্মের বিভিন্ন বস্তু বা ব্যাবহৃত জিনিসপত্র চিনতে পারে, আবার এমন অনেক কিছু বলে যা সাধারনতঃ তাদের পূর্নজন্ম প্রাপ্তরাই জানে।
লাসা থেকে আগত চার প্রধান “বোনপোস” এবার নির্ধারিত পরীক্ষা নেবার প্রস্তুতি নেয়, তারা লামোর সামনে দুটো কালো জপমালা ধরে যার একটি ব্যাবহার করতেন ত্রয়োদশ দালাইলামা থুবতেন গিয়াৎসোর। কোন রকম দ্বিধা না করেই লামো আসল জপমালাটি তুলে নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে নাচতে থাকে। এইবার দ্বিতীয় পরীক্ষা: লামোর সামনে দুটো ঢোল রাখা হয় যা যজ্ঞের সময় ব্যাবহৃত হয়, এর একটি দেখতে খুব সুন্দর সোনার কারুকাজ করা অন্যটি খুব সাধারন যেটা মৃত ত্রয়োদশ দালাইলামা ব্যাবহার করতেন। ছেলেটি এবারো নির্ধিদ্ধায় সাধারন ঢোলটি বেছে নেয় এবং যজ্ঞে যেভাবে বাজানো হয় সেভাবে তালে তালে বাজাতে থাকে।
সবশেষে তৃতীয় পরীক্ষাঃ তার সামনে দুটো ছড়ি রাখা হয়, লামো এইবার ভুল করে। ভুল ছড়িটি তুলে নেয়, উপস্থিত লামাদের চোখে তখন বিস্ময়, কিভাবে এই ভুল লামো করল এত গুলো পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে? তবে এটা সাময়িক, অল্পক্ষনের মাঝেই সে ভুল ছড়িটি রেখে আসল ছড়িটি তুলে নেয়। খিউটসাঙ রিনপোচে সাথে সাথে সবার ভ্রান্তি দূর করে বলে ওঠে ওই ছড়িটিও কিছুদিন প্রয়াত ত্রয়োদশ দালাইলামা ব্যাবহার করেছিল পরে সেটি তিনি লামা কিউসাঙকে দান করেছিলেন। সবার চোখ তখন আনন্দে ঝলমল করছে। এখানে একটা বিষয় প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্যযোগ্য এই ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হবার আগে আলোচ্য শিশুটির বয়স কমপক্ষে দুই বছর হতে হবে।
চাক্ষুষ এই সব প্রমানের সাথে এইবার যোগ হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত লামার দেখা “আ” “কা” “মা” শব্দ তিনটের ব্যাখ্যা। এখানে “আ” শব্দটির ব্যাখ্যা আসে বাচ্চাটিকে যে জেলায় খুজে পাওয়া গেছে তার নাম “আমডো”। “কা” এবং “মা” মানে টাকসার পাহাড়ের ওপর অবস্থিত লামাদের ক্ষুদ্র একটা আশ্রম যার নাম “কারমা রোলপাই দোরজি” যেখানে মৃত ত্রয়োদশ দালাইলামা কয়েক বছর আগে চীন থেকে ফিরে যাবার সময় বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ত্রয়োদশ দালাইলামার আগমনে সে সময় সে এলাকায় এক বিরাট সাড়া পরে যায়। দালাইলামার সংস্পর্শে সেদিন যারা এসেছিল তাদের মাঝে সেদিন ছিল ছোট লামোর বাবা, তখন তার বয়স ছিল নয় বছর।
এখানে আরো জানা যায়, মৃত দালাইলামা খামার বাড়ীটির দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল হৃদয় মন্তব্য করেছিল “কি সুন্দর আর শান্ত জায়গা”! এবং মৃত ত্রয়োদশ দালাইলামা সেখানে তার ব্যাবহৃত একজোড়া জুতা রেখে যান – অবস্থাদৃষ্টে সবাই এর ভেতর একটি প্রতীকি অর্থ খুজে পায়।
প্রতিনিধি দল পূর্ন সন্তোষ প্রকাশ করে নিজেদের মাঝে আলোচনায় সমাপ্তি টানে এই বলে যে তারা তাদের পুর্নজন্ম প্রাপ্ত দালাইলামাকে পেয়ে গেছে। পুরা ব্যাপারটা তখনো গোপনীয়তার ঘোরটেপে আবদ্ধ রাখা হয়, কারন বৈরী চীনা কর্তৃপক্ষ যদি জানতে পারে তিব্বতের নতুন শাষক পাওয়া গেছে তবে তারা কোন একটা ঝামেলা পাকাতে পারে, চাইকি বাচ্চাটির সুরক্ষার নামে তার সাথে এক দল সেনাও তিব্বতে পাঠাতে পারে।
বৈরী চীনা কর্তৃপক্ষের নাকের ডগা দিয়ে নতুন রাজাকে নিয়ে যাওয়া হবে তিব্বতে। ওদিকে উচ্চপদস্থ লামাদের উপস্থিতিও ততদিনে ওই প্রদেশের চীনা কর্মকর্তারা জেনে গেছে, তাদের কাছে মুল ব্যাপারটা গোপন করে জানানো হল, বাচ্চাটিকে তারা তিব্বতে নিয়ে যেতে চায় একজন সম্ভাব্য লামার উত্তরসুরী হিসাবে। সুযোগ বুজে প্রদেশের গভর্নর মা পুফাঙ ছেলেটিকে নিয়ে যাবার বিনিময়ে দশ হাজার চাইনীজ ডলার দাবী করে। সাথে সাথে লামারা রাজী হয়ে যায়। কিন্তু অচিরেই সমস্ত তোড়জোড় দেখে মা পুফাঙ বুজতে পারে সে আসলে কম দাবী করছে নির্লজ্জের মত দশ হাজারে জায়গায় ত্রিশ হাজার চাইনীজ ডলার দাবী করে। তাতেই রাজী হয়ে যায় লাসা থেকে আগত লামারা।
গোপনীয়তার স্বার্থে বিশ্বস্ত লামাদের মাধ্যমে মুখে মুখে বার্তা চালাচালি হয় হাজার মাইল দূরে দুর্গম আমাডো থেকে লাসা পর্যন্ত কোন রকম চিঠি পত্র ব্যাতীত। এ অবস্থায় প্রভু দালাইলামা এবং তার পরিবারকে কে লাসা পর্যন্ত নিয়ে যেতে বার্তা আদান প্রদান করতে করতে প্রায় দু বছর লেগে গেল। পায়ে এবং ঘোড়ায় চেপে মধ্য তিব্বতের সীমান্ত পর্যন্ত যেতে পুরো দলটির কয়েক মাস লাগে। সেখানে পৌছে লামোর পিতা মাতা দেখেন মন্ত্রীসভার একজন সদস্য তার দলবল নিয়ে ভারপ্রাপ্ত লামার চিঠি সহ অপেক্ষা করছেন তাদের নতুন শাষককে বরন করে নিতে, তখনি তারা জানতে পারে তাদের ছোট শিশুটি আর কেউ না চর্তুদশ দালাইলামা।
চার বছর বয়সী দালাইলামা
১৯৩৬ সালের ৬ই জুলাই জন্মগ্রহণ করা তিন বছর বয়সী ছোট্ট শিশু লামো ১৯৩৯ সালের ২১শে জুলাই যাত্রা শুরু করে লাসার উদ্দেশ্য, যেখানে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সুনিশ্চিত করবেন কে আসলে সত্যিকারের দালাই লামা। লাসায় আগমন পরবর্তী সমস্ত প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হবার পর, অবশেষে, ১৯৪০ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী মাত্র চার বছর বয়সে টাকসার গ্রামের ছোট্ট ছেলে লামো ভূষিত হয় চতুর্দশ দালাই লামা উপাধিতে; সাথে সাথে দেয়া হয় তার নতুন নাম- তেনজিন গিয়াৎসু।
ভারপ্রাপ্ত দালাইলামা ছিলেন তিব্বতের সুবিখ্যাত এবং ঐতিহাসিক রিটিং মঠের লামা রিটিং রিনপচে
দালাই লামার অনুসন্ধান করা , দালাই লামার অনুপস্থিতি কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সমস্ত কর্মকান্ড পরিচালনা এবং দালাই লামাকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব যার হাতে থাকে তিনি হলেন “ভারপ্রাপ্ত দালাইলামা” ইংরেজীতে যাকে বলে রিজেন্ট । তেনজিনের অনুসন্ধান পরিচালনাকারী ভারপ্রাপ্ত দালাইলামা ছিলেন তিব্বতের সুবিখ্যাত এবং ঐতিহাসিক রিটিং মঠের লামা রিটিং রিনপচে । কিন্তু যুগে যুগে কালে যেখানেই ছিলো ক্ষমতার সুমিষ্ট সুঘ্রাণ, সেখানেই গড়ে উঠেছিলো ষড়যন্ত্রের সুবিশাল কারখানা। ওরাকল বা ভবিষ্যৎবক্তার দোহাই দিয়ে, অপরাপর সভাষদদের মতামতে, রিটিং রিনপচেকে পাঠিয়ে দেয়া হয় দালাই লামাকে ছেড়ে অনেক দূরে। নির্বাচিত হয় নতুন ভারপ্রাপ্ত দালাইলামা।
পরবর্তীতে রিটিং রিনপচে ভারপ্রাপ্ত দালাইলামা পদের দাবী নিয়ে ফিরে আসতে চাইলে বিদ্রোহী আখ্যা দিয়ে বন্দী করা হয়। বন্দী অবস্থায় তার কপালে কি হবে সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না। দালাই লামার পোটালা প্যালেসের বন্দীশালায় বিষ প্রয়োগে মারা যান রিটিং রিনপচে। মৃত্যুর পর দালাই লামা তেনজিন গিয়াৎসুকে জানানো হলে অবাক বিষণ্ন হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তাহলে এখানে বন্দীশালাও আছে? বন্দুক গোলা বারুদও আছে?” অপ্রাপ্তবয়স্ক এই ক্ষমতাধর শিশুটি তখনো বুঝে উঠতে পারেনি, এই ধর্ম কর্ম ছাড়াও পৃথিবীতে আরও একটা ব্যাপার আছে, অচিরেই যার নোংরা প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যেতে হবে তাকেও। অপরিহার্য আর অবধারিত সেই প্রক্রিয়ার নাম- রাজনীতি।
চর্তুদশ দালাইলামা তেনজিন গিয়াৎসু
বর্তমান দালাইলামার বয়স ৮৪ বছর, তিনি ৯০ বছর বয়সে জানাবেন তিনি পুর্ন জন্ম নেবেন কিনা? আর নিলে কোথায়? ততদিন আমরা না হয় অপেক্ষাই করি।
সুত্রঃ Reting Rinpoche , অনেকের ভীড়ে একজন , Life in exile , The Beauty of Death, Dying and Rebirth in Tibetan Buddhist Rituals, Jesus Lived in India , Dalai Lama: A Policy of Kindness , Birth to Exile , Dalai Lama Hints at a Possible End to the Reincarnate Lama System , How to dalailama chosen? সহ আরো অনেক অন্তর্জাল ফিচার। ছবিঃ অন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১১:৪২