টীকাঃ এই লেখার প্রথম পর্ব ইসরাইলিয়দের ইতিহাস যেভাবে তাদের উৎপত্তি (প্রথম পর্ব) ২৯শে নভেম্ভর দিয়েছিলাম মানে প্রায় এক মাস আগে, এর পর এত দিন লাগল দ্বিতীয় পর্ব দিতে কারন প্রথমতঃ তথ্যের অপ্রতুলতা, দ্বিতীয়তঃ যে সব তথ্য পাচ্ছিলাম বিভিন্ন বই পত্র এবং জার্নালে তাতে একটার সাথে আর একটার গড়মিল আমাকে নাজেহাল বানিয়ে ছেড়েছে, অবশ্য প্রায় প্রত্যেক লেখক স্বীকার করে নিয়েছেন তাদের লেখা অনেকাংশে ঐতিহাসিক প্রমান ছাড়া “তালমুদ” লেখকদের দেয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করে তৃতীয়তঃ জায়গার নামের বানানের ভিন্নতা বিভিন্ন জায়গায় মেলাতে গিয়ে আমাকে হিমশিম খেতে হয়েছে, শেষে বিভিন্ন ম্যাপ এবং লেখা দেখে যতদূর সম্ভব আমি এক করার চেষ্টা করছি। লেখাটা লিখতে আমার অনেক কষ্ট গেছে, কিন্তু একটা ভালো লাগাও কাজ করছে এই পর্ব শেষ করে। পরের পর্বের কাজ আবার শেষ হলে আপনাদের সামনে নিবেদন করব।
টাইটাস ফ্লাভিয়াস জোসেফারে রোমান জিউশ হিষ্টোরিয়ান (আনুমানিক ৩৭-১০০ খ্রিষ্টাব্দ) মতে প্রধান উপাসনালয়টি ছিল পয়তাল্লিশ ফিট লম্বা এবং পনের ফিট চওড়া, এবং পূর্ব পশ্চিমে গঠিত। দেয়াল গুলো ছিল পনের ফিট উচু এবং ছাদ ছিল ঢালু। ভেতরে দুটো রুম ছিল যা একটি সুন্দর নকশা করা পর্দা দ্ধারা আলাদা থাকত...... রূপা এবং কাসার তৈরী খুটি দ্ধারা এটি তৈরী ছিল। দরবারের দৈর্ঘ্য ছিল একশত ফিট এবং প্রস্থ ছিল পচাত্তর ফিট। ইহুদীদের এই প্রথম উপাসনালয়টি এমনভাবে তৈরী ছিল যেন প্রয়োজনে যে কোন জায়গা থেকে আর এক জায়গায় বহন করা যায়। ইসরাইলীরা যেখানে যেত এটিকে সাথে করে নিয়ে যেত।
বুনো অঞ্চলের মাঝ দিয়ে যাবার সময় বারোটি গোত্র নিজেদের জন্য চারটি প্রধান পতাকা তৈরী করেন যার নীচে তারা অবস্থান করত। যার কথা বাইবেলে বলা হয়েছে এইভাবে, “ইসরাইলের প্রতিটি ব্যাক্তি নিজেদের পতাকার তলে দাঁড়াবে।”
The Ark of the Covenant
আর্ক অভ কভেন্যান্ট ছিল একটি সিন্দুক, যার মাঝে থাকত পাথরের তৈরী দুটি শিলালিপি, যাতে লেখা হয়েছিল ঈশ্বরের দশটি নির্দেশ। শিলালিপি ছাড়াও এর মাঝে থাকত সোনালী প্লেট ভর্তি মান্না, এ্যারনের লাঠি এবং কভেন্যান্ট রাখার টেবিল। এটি তৈরী হয়েছিল শিটিম কাঠ দিয়ে, এবং ভেতর বাইরে মোড়ানো ছিল সোনার পাত দিয়ে, এটা ছিল প্রায় তিন ফিট নয় ইঞ্চি লম্বা, দুই ফিট তিন ইঞ্চি চওড়া এবং একই উচ্চতা বিশিষ্ট। দুই পাশে দুটি করে চারটি সোনার রিং ছিল যার মাঝ দিয়ে লাঠি ডুকিয়ে বহন করা হত। এই বহন করার কাজ ছিল লেভিয়দের ওপর। এর ঢাকনা ছিল খাটি সোনার তৈরী, যার ওপর ছিল ছড়ানো পাখা সহ দেবদূতের মূর্তি।
এখান থেকে আবার যাত্রা শুরু করেন মোজেস, এবং পারানের জঙ্গলে পৌছানোর পর বারোটি গোত্র থেকে একজন করে মোট বারোজন কে বেছে নেন, তাদের পাঠানো হয় পারান জঙ্গলের কাছে কেনান দেশটি ঘুরে দেখতে।
চল্লিশ দিন পর তারা কাদেশ বারনিয়ায় ফিরে আসে যেখানে এই চল্লিশ দিন ইসরাইলীরা ভ্রমন করে পৌছায়। যেটি বর্তমান প্যালেষ্টাইনের দক্ষিন পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত। তাদের মাঝে ক্যালেব এবং জোশুয়া যারা সবার পরে ফিরে এসেছিলেন তারা বলেন যে, “আমাদের উচিত এখনি গিয়ে এই দেশ দখল করা, কারন সেই সামর্থ্য আমাদের আছে, ঈশ্বর যদি আমাদের সহায় থাকেন তবে তিনি আমাদের এই দেশ দান করবেন যেখানে দুধ ও মধু প্রবাহিত হচ্ছে।” কিন্তু তাদের গোত্রের অনেকেই ক্যালেব এবং জোশুয়ার এই পরামর্শ অগ্রাহ্য করে এর সাথে নিজেদের নেতাদের দোষারোপ করতে থাকেন। উপরন্ত তারা বলতে থাকেন এর থেকে ফেরাউনের দাসত্ব করাও অনেক ভালো।
মোজেস তাদের কে অনেক বুজাল যে তাদের উচিত কাদেশ দখল করে নেয়া, কারন স্বয়ং জিহোভা তাদের সহায়। তাদের হতাশ হবার কোন কারন নেই, কিন্তু ইসরাইলীরা মোজেসের কথাও গুরুত্ব দিল না। বরঞ্চ তারা রেগে গিয়ে ক্যালেব এবং জোশুয়াকে পাথর মেরে হত্যা করতে উদ্যত হল।
হিব্রু জাতির এই অবাধ্যতায় “জিহোভা” ভীষন রাগন্বিত হন এবং তাদের প্লেগ দিয়ে ধ্বংস করতে চাইলেন, তখন মোজেস তার জাতির জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চান, মুসার কথা তার সৃষ্টিকর্তা শুনলেন তবে শর্ত সাপেক্ষে, সে বলল, “ তোমার কথায় আমি এদের কে ক্ষমা করলাম ঠিকই কিন্তু তারা কাদেশে প্রবেশ করতে পারবে না বরং আগামী চল্লিশ বছর তারা মরুভুমিতে ঘুরে ঘুরে মারা যাবে, তবে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এবং ক্যালেব ও যোশুয়া এই দেশে প্রবেশ করতে পারবে।”
প্রায় চল্লিশ বছর মোজেস ইসরাইলীদের নিয়ে মরুভুমিতে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে তারা কাদেশ এলাকায় আবারো এসে হাজির হয়, তবে এখানেও তাদের শান্তি মেলে না, পানির কুয়ো গুলো ছিল শুকনো খটখটে। ফলে পানির তেষ্ঠায় তারা মারাত্মক কষ্ট পায়। এই কষ্ঠ যে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্তের জন্য ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারন করে সেটা তারা স্বীকার না করে তাদের নেতাদের ওপর দোষ দিতে থাকে এবং নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অনীহা প্রকাশ করে।
এর পর মোজেস স্রষ্টার কাছে পানির জন্য প্রার্থনা করলে স্রষ্টা তাকে কাদেশ পাহাড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে পানি পান করান, এবং মোজেস এবং এ্যারন কে জানান যে তারা তাদের প্রতিশ্রুত ভুমিতে যেতে পারবে না।
কিন্তু এখানেও ইজরাইলী বা হিব্রুরা মোজেসের কথা না শুনে নিজদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিশ্রুত দেশে যাবার প্রস্ততি নিতে থাকে। এদোনের রাজার কাছে তারা দূত পাঠিয়ে তার রাজ্যের ভেতর দিয়ে যাত্রা করার অনুমতি চায়, কিন্তু সে অনুমতি রাজা তাদের না দিলে তারা ঘুর পথে রওনা হন।
আরবের এদোমে অবস্থিত হোর পর্বতের কাছে পৌছে এ্যারন মারা যায় যখন তার বয়স একশ তেইশ বছর এবং তার স্থালাভিষিক্ত হন তার পুত্র এলিয়েজার। এর পর ইজরাইলীরা দক্ষিন দিক দিয়ে মোয়াবের পুর্বে হাজির হন। এখানে হেসবোনের রাজা শিহোনের সাথে ইজরাইলীদের যুদ্ধ হয়, এবং এখানে ইজরাইলীরা বিজয়ী হয়, ফলে হেসবোন ইজরাইলীদের দখলে আসে ওদিকে বাসানোর রাজা অগ শিহোনের পক্ষ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে কিন্তু এখানেও ইজরাইলীদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় অগ পরাজিত হয়। ফলে জর্দানের পূর্ব পাশের অর্নন থেকে হার্মন পর্যন্ত পুরো এলাকায় হিব্রু বা ইজরাইলী জাতির দখলে আসে।
এর পর ইজরাইলীরা মোয়াব রাজ্যে প্রবেশ করলেও তা দখলের কোন চেষ্টা করেনা এই মোয়াব ছিল লুতের বংশধররা। এখানকার রাজার নাম ছিল বালাক। তিনি হিব্রুদের দিন দিন প্রতাপশালী হওয়া পছন্দ করছিলেন না কিন্তু অনেকটা নিরুপায় হয়ে তাদের সহ্য করে যাচ্ছিলেন কারন ততদিনে ইজরাইলীরা কিছুটা সুসংহত হয়ে উঠছিলো। মোয়াব এবং পার্শ্ববর্তী মিদিয়ান জাতি ছিল পাপাচারে পরিপূর্ন। এদের স্ংস্পর্শে এসে একেশ্বরবাদী ইজরাইলীরা ব্যাভিচার এবং ব্যাল (প্রাচীন পাগান দেবতা) পুজা শুরু করে। পাপের শাস্তি হিসাবে স্রষ্টা তাদের মাঝে প্লেগ দিয়ে পুতুল পুজারীদের ধ্বংস করে দিলেন।
এখানে জিহোভা মোজেসকে বললেন মিদিয়ান জাতিকে ধ্বংস করে দেবার জন্য। স্রষ্টার এ আদেশ শোনার পর ইজরাইলীরা মিদিয়ান আক্রমন করে এবং তাদের ধ্বংস করে দেয়। অতঃপর ইহুদীদের বারোটি গোত্রের ভেতর তিনটি গোত্রে রিওবেন, গাদ এবং ম্যানোসের হাতে দখলকৃত অর্নন নদীর তীর থেকে হার্মান পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত মুসা ঈশ্বরের নির্দেশে অর্পন করে। এদিকে ঈশ্বরের নির্দেশকৃত নির্বাসনের চল্লিশ বছর প্রায় শেষ হয়ে যায় এবং এর মাঝে মুসা ইজরাইলীদের অনেক উপদেশ দেয় এবং তাদের হাতে ঈশ্বরের বানী সম্বলিত একটি গ্রন্থ তুলে দেয়। যা ইজরাইলীদের কাছে “তালমুদ” নামে পরিচিত। এখানে ইজরাইলীদের ঈশ্বরের বিভিন্ন নির্দেশ এবং আইন লেখা ছিল।
এরপর ঈশ্বর মোজেসকে বললেন, তোমার দিন ফুরিয়ে এসেছে যোশুয়াকে আমার কাছে নিয়ে আস তাকে আমার নির্দেশ জানাব। যথারীতি মোজেস যোশুয়াকে নিয়ে নেবো পাহাড়ে আহরন করলে, ঈশ্বর মোজেস এবং যোশুয়াকে বললেন, ঐ দেখ, আমি আব্রাহাম, আইজ্যাক এবং জ্যাকবের কাছে যে দেশে প্রতিশ্রুতি করছিলাম সেই দেশ, তুমি নিজ চোখে দেখলে, কিন্তু তুমি ওখানে প্রবেশ করতে পারবে না।
সেখানেই মোজেসের মৃত্যু হয় একশত বিশ বছর বয়সে, এবং যোশুয়া ইজরাইলীদের পরবর্তী নেতা হয়ে প্রতিশ্রুত ভুমি কেনানের (আধুনিক প্যালেষ্টাইন) দিকে অগ্রসর হয়।
কেনানে যোশুয়া প্রবেশ করলে সে স্থানীয় অধিবাসীদের বিতারন করে কেবল গিবিয়নিয় বাদে, তাদের কে ইজরাইলীদের সেবক বা দাস হিসাবে রাখা হয়। ১৪৪৪ খ্রিষ্টপূর্বে শিলোহ – এ স্থাপন করা হয় উপাসনালয় বা সিনাগগ এবং প্যালেষ্টাইনকে বারোটি ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়। ১৪৪৩ খ্রিষ্ট পূর্বে যোশুয়া মারা যান একশত দশ বছর বয়সে। এরপর প্রায় সাড়ে তিন শত বছর ইজরাইলীরা নিজস্ব গোত্রপতিদের নেতৃত্বে বংশ পরম্পরায় এখানে বাস করে।
Kirjath Jearim
১১১৬ খ্রিষ্টপূর্বে এবেনজার নামক এলাকায় বিতাড়িত প্যালেষ্টানীয়ান এবং ইজরাইলীদের মাঝে যুদ্ধ সংগঠিত হয়, এবং আর্ক অভ কভেন্যান্ট শিলোহ থেকে ইজরাইলী শিবিরে নিয়ে আসা হয়, এখানে প্যালেষ্টাইনীরা ইজরাইলীদের পরাজিত করে এবং আর্কটি প্রথমে আশদদ পরে গাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সবশেষে একে একরনে নিয়ে যায়। ১১১৫ খ্রিষ্ট পূর্বে ইজরাইলীদের অনুরোধে প্যালেষ্টানীয়রা আর্ক টিকে কিরিয়াথ – জিয়ারিম নামক নগরে তাদের কে ফেরত দেয় যার অধিবাসী ছিল ইজরাইলীদের আশ্রিত দাস গিবিয়নীয়রা।
শহরটি জেরুজালেম থেকে নয় মেইল উত্তর পূর্বে অবস্থিত। এই শহরে আবিনাদাব নামক এক লেভিয়র কাছে আর্কটি প্রায় সত্তর বছর রক্ষিত থাকে এর এটিকে জেরুজালেম নিয়ে যাওয়া হয়। শিলোহ থেকে গিবিওন নিয়ে যাওয়া হয় সিনাগগ (তবে কোথাও এই স্থানান্তরের সঠিক সময় জানা যায়নি)। বাইবেলে বলা আছে মোজেস প্রতিষ্ঠিত উপাসনালয় গিবিওনেই ছিল (১০১৭ খ্রিষ্ট পূর্বে)। বাইবেলে আরো বলা আছে সলোমন নিজে এর সামনে স্রষ্টাকে অর্ঘ্য দিতেন। তবে এরপর বাইবেলে আর্কের ব্যাপারে আর কোন তথ্য নেই।
চলবে
সূত্রঃ বিভিন্ন বই, জার্নাল এবং ম্যাপ
প্রাচীন জাতি সন্মন্ধ্যে জানতে ইচ্ছে হলে এখানে দেখতে পারেন ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া জাতি ( হিতাইত জাতি)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ২:০৮