পদার্থবিদরা এত দিন জানতেন বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডে চার ধরনের বল কার্যকর আছে। এর হল ইলেকট্রনের গতি নিয়ন্ত্রনকারী তড়িৎ চুম্বকীয় বল, পরমানুর কেন্দ্রে প্রোটনদের ধরে রাখার জন্য প্রবল বল, তেজস্ক্রিয় বিকিরনে সক্রিয় ক্ষীন বল, এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে পরিচিত মধ্যাকর্ষন বল। পাশাপাশি ইদানিং নতুন এক বলের কথা খুব শোনা যাচ্ছে এ্যান্টি গ্রাভিটি (প্রতি মধ্যাকর্ষন) বল।
২০০১ সালের ৪ এপ্রিল বাল্টিমোরে মেরিল্যান্ডে স্পেস টেলিস্কোপ ইনিষ্টিটিউটের সভায় ভাষন দেবার সময় তরুন জোর্তিবিজ্ঞানী এ্যাডাম রিস (পরে ২০১১ সালে জোর্তি পদার্থবিদ্যায় নোবেল লাভ করেন) দেখালেন হাবল দিয়ে তোলা ব্রহ্মাণ্ডর কিছু আলোকিত অংশের ছবি। “হাবল ডায়াগ্রাম” নামে পরিচিত এই বিশেষ চিত্রে তারকা এবং ছায়াপথের দূরত্বের এবং গতির হিসাব দেয়া আছে। রিসের গবেষনায় দৃশ্যমান বিশ্ব এবং কৃষ্ণ গহ্বর কিভাবে রহস্যময় বিকর্ষক শক্তির প্রভাবে কিভাবে পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
প্রায় দু বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন তার পর্যাবেক্ষনের কথা জোর্তিবিজ্ঞানে সাড়া ফেলছিল। সে সময় নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি জনিয়েছিলেন, “ আমাদের ব্রক্ষ্মান্ড তার আগের মুহুর্তের থেকে বেশী ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ যেন ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে সব কিছু। তিনি ও তার দল ১১০০ কোটি বছর আগের এক সুপারনোভা বিস্ফোরনের পরীক্ষা করে দেখেছেন, সেখান থেকে দেখতে পান ৭০০ কোটি বছর আগে যে হারে ব্রহ্মাণ্ড বিকাশিত হচ্ছিল আজকের পৃথিবী বিকাশিত হচ্ছে তার তুলনায় ১৫% বেশী।
লরেন্সের বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির অন্য একটি গবেষক দল থেকেও সল পার্লামারিও একই পর্যবেক্ষন সমর্থন করেন। ১৯১৭ সালে আইন ষ্টাইন রিলেটিভিটি আবিস্কারের সময় খেয়াল করছিলেন সময়ের সাপেক্ষে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সময়ের সাপেক্ষে স্থির নয় হয় বাড়ছে নয় সংকুচিত হচ্ছে। সে সময় স্থির বিশ্বের ধারনা প্রচলিত ছিল। আইনষ্টাইন তার রিলেটিভিটি ইক্যুয়েশানে একটি বাড়তি ধ্রুবক যোগ করে ব্রহ্মাণ্ডকে স্থির দেখানোর চেষ্টা করেন। এই ধ্রুবককে “কসমোলজিক্যাল ধ্রুবক” বলা হয়, যা গ্রীক অক্ষর লামডা (Λλ) দ্ধারা প্রকাশ করা হয়।
আইনষ্টাইনের গবেষনাপত্র প্রকাশের প্রায় এক যুগ পর এডউইন হাবল তার দূরবীক্ষনে অনেক ছবি এবং তথ্য ঘেটে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ব্রহ্মাণ্ড স্থিতিশীল নয়। তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধির হার পৃথিবী থেকে সেই ছায়াপথের দূরত্বের ওপর নির্ভরশীল। হাবলের সুত্রে এই নির্ভরশীলতার ধ্রুবকটির মান প্রতি দশ লক্ষ আলোকবর্ষ দুরত্বে সেকেন্ডে প্রায় ৫০ কিলোমিটার। অর্থ্যাৎ পৃথিবী থেকে এক কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বের কোন ছায়াপথ পৃথিবী থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। এর মানে হল যে ছায়াপথ পৃথিবী থেকে যত দূরে সে তত জোরে পৃথবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। একে হাবল কনষ্ট্যানন্ট বলে।
মাইকেল টার্নার ১৯৯০ সালে এক বর্ধিষ্ণু মহাবিশ্বের মডেল প্রস্তাব করেন। তার সূত্র অনুসারে ৫% সাধারন বস্তু যা সাধারন চোখে দেখা যায়, ২৫% অদৃশ্য শীতল কৃষ্ণ বস্তু (ডার্ক ম্যাটার) যাদের অস্তিত্ব কেবল অনুভব করা যায় এবং ৭০% শক্তি নির্ভর করে আইনষ্টাইনের রিলেটিভিটি সুত্রের লামডার ওপর। মনে রাখা দরকার ভর শক্তি E=mc2 সমতুল্যতা সূত্র মেনে চলে। তাই শক্তিকে ভরে এবং ভরকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভআইনষ্টাইনের লামডার এক গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা হল বিকর্ষক (এ্যান্টি গ্রাভিটি) শক্তির সাথে ভারসম্য সৃষ্টিতে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ব। এই মহাবিশ্বের বৃদ্ধি থামাতে যে পরিমান গড় ঘনত্ব (average density) দরকার তাকে বিজ্ঞানীরা বলেন “সঙ্কট ঘনত্ব”। বর্তমান বিশ্বের গড় ঘনত্ব এবং সঙ্কট ঘনত্বের অনুপাত কে গ্রীক লেটার ওমেগা (Ωω) দ্ধারা প্রকাশ করা হয়।
ওমেঘার মান একের বেশী হলে ব্রহ্মাণ্ড তার নিজের ভরে সংকুচিত হয়ে এক বিন্দুতে পরিনত হবে একেই বিজ্ঞানী হকিন্স “বিগ ক্রাঞ্চ” বলেছেন। আবার ওমেগার মান একের কম হলে ব্রহ্মাণ্ড প্রসারিত হতে থাকবে কখনো থামবে না। সময়ের সাথে সাথে এই গতি বৃদ্ধ পাবে।
ওমেগা, হাবলের ধ্রুবক এবং লামডার মাঝে এক সম্পর্ক আছে। পরীক্ষার মাধ্যমে এই তাত্বিক সম্পর্কটি বিজ্ঞানীরা মিলিয়ে দেখতে চাইছেন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জোর্তিবিজ্ঞানী আলেক্স ফিলিপ্পেনকো তার বলেছেন, আমার যতই চেষ্টা করিনা কেন, লামডার মান কোন অবস্থাতেই শুন্য নয়। অর্থ্যাৎ মহাকর্ষ শক্তির বিপক্ষে আর একটা বিকর্ষক শক্তি মহাবিশ্বে কাজ করেছে। সুপারনোভা কসমোলজি প্রকল্পে পার্লমাটারের তত্বাবধানে ৪০ টি সুপারনোভা বিশ্লেষান করেন। তাদের বিশ্লেষানে কসমোলজিক্যাল কনষ্ট্যান্টের সুস্পষ্ট প্রমান মিলেছে।
১৯৯৮ সালের ফেরুয়ারী মাসের বিখ্যাত সায়ান্স ম্যাগাজিনের এক সাক্ষাৎকারে ব্রায়ান স্পিট বলেছেন তার দল ৯৯% নিশ্চিত ব্রম্মান্ডের বৃদ্ধিতে কোনওভাবে এ্যান্টি গ্রাভিটেশনাল শক্তির যোগান আছে, সম্ভবত এই শক্তির উৎস সৃষ্টিতত্বের লামডা। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জোর্তিবিদ রিচার্ড এ মুলারের মতে এটি এ শতকের সব থেকে বড় আবিস্কার এখন পর্যন্ত।
ব্রম্মান্ডের স্ফীত বৃদ্ধির হার থেক এ্যান্টি গ্রাভিটি শক্তির অস্তিত্বের প্রমান ছাড়াও ব্রহ্মাণ্ডর ৬৫% এর হিসাব পাওয়া গেছে, সে হিসাবে বর্তমান ব্রহ্মান্ডের বয়স ১৪০০ কোটি বছর। এখানেই শেষ নয়। কোয়ান্টম বলবিদ্যা অনুযায়ী লামডা যে এ্যান্ট গ্রাভিটেশনলা শক্তির যোগান দেয় তা এক ধরনের “অবাস্তব” ভার্চুয়াল কনার সৃষ্টি হয় এবং খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। অঙ্ক কষে দেখা গেছে ইলেকট্রনের সমান ভরের সমান এই অবাস্তব কনার আয়ু ১০-২১ সেকেন্ড, মানে একের পিঠে একুশটা শুন্য দিলে যা হয় সেকেন্ডের তত ভগ্নাংশ। বিশেষজ্ঞরা এই নতুন অবাস্তব কনার নাম দিয়েছেন এক্স ম্যাটার। গত বিশ শতকে যা ছিল শুধু অনুমান নির্ভর আজ তা অনেকাংশে বাস্তব।
২০০১ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে ব্রুক হেভেন ন্যাশনাল লাইব্রেরীর এ্যাসোসিয়েটস ডিরেক্টর টমাস বি কার্ক জানালেন তাদের গবেষনাগারে এই এই অবাস্তব কনাদের খুজে পাওয়া গেছে। একাজে বিশেষ ধরনের অল্টারনেটিং গ্রেডিয়েন্ট সিনক্রোটন যন্ত্র ব্যাবহার করা হয়। ই-৮২১ নামে এই পরীক্ষায় কয়েকশো কোটি মিউওন কনা শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে পাঠিয়ে বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন মিউওনের কম্পাঙ্ক মেপে অজানা এক ক্ষন স্থায়ী কনার সন্ধান পাওয়া গেছে, যা প্রচলিত বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। “এই অসাধারন আবিস্কারের মাধ্যামে বাস্তব কিভাবে সৃষ্টি হয় তার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আরো গভীর হবে” বলেছেন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেরাল্ড গ্যাব্রিয়েল।
তবে কি মানুষ এ্যান্টিগ্রাভিটি ফোর্স আবিস্কারের মাধ্যমে এক নতুন জগত উন্মোচিত করবে? এ ব্যাপারে এখনো শেষ কথা বলার সময় আসে নি। আরো অপেক্ষা করতে হবে, আমরা না হয় অপেক্ষাই করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:১৫