শ্রাউড অভ তুরিনের সম্ভাব্য গতিপথ
আজকের পর্বে আমি আপনাদের এই শ্রাউড অভ তুরিনের ব্যাক ট্রেইল করে এর ইতিহাস জানাবার চেষ্টা করব। সমস্যা হল, এত বেশী ঘাটাঘাটি হয়েছে এই ব্যাপারটা নিয়ে ইতিহাসবেত্তাদের মাঝে আমি নিজেই মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলছি একজনের লেখা ছেড়ে যখন আর একজনের লেখা পড়ছি। তারপরো আমার আন্তরিক চেষ্টা থাকবে সময় পরিভ্রমনের সাথে সাথে এই তুরিনের আলখাল্লার পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া।
আলখাল্লাটির উৎস অনুসরন করতে গিয়ে সব থেকে ডিটেইলস কাজ করছেন বৃটিশ ঐতিহাসিক ইয়ান উইলসন। তার হাতে যে বিপুল দলিল দস্তাবেজ ছিল তা দিয়ে তিনি প্রমান করেন “এডেসা প্রতিকৃতি” র সাথে এই তুরিনের আলখাল্লার সম্পর্ক প্রথম শতাব্দী থেকেই যা ষষ্ঠ শতকে “ম্যান্ডিলিয়ন” নামে পরিচিত ছিল।
বিতর্কিত “গসপেল অভ হিব্রু” অনুসারে যা নাজারেনরা ( নাজারেথের অধিবাসী, যীশুর জন্মস্থান) ব্যাবহার করত রেজোরেকশান (Resurrection) বা পুনরুত্থানের পরে যীশু আলখাল্লাটা “পুরোহিতদের ভৃত্যদের” দেয়া হয়েছিল। এটা সম্ভবতঃ “পুরোহিতদের ভৃত্যদের” দেয়া হয়েছিল বিশেষ কোন সেবা প্রদানের নিমিত্তে। সে সেবা হতে পারে যিশুর পুনুরুত্থনের পর তার সেবার কারনে। তবে পুরোহিতদের ভৃত্যদের বা যাকেই এই আলখাল্লা দেয়া হোক না কেন তারা ছিল যীশুর অনুসারী আর সঙ্গত কারনেই তারা চেয়েছিল এই অমূল্য স্মারককে সংরক্ষিত রাখতে। যাদের কাছে এই আলখাল্লা সংরক্ষিত ছিল বিভিন্ন নথিপত্র ঘেটে দুজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য হিসাবে আসে তাদের একজন ছিল আরমেথিয়ার যোজেফ এবং নিকোডিমাস যারা যীশুর ক্রুশ বিদ্ধ দেহ ক্রুশ থেকে নামিয়ে এনে পাহাড়ের গুহায় সমাধিস্থ করছিলো।
কিন্তু তখনকার পরিস্থিতিতে রোমান শাষকদের দ্ধারা নির্যাতিত হবার কারনে এই আলখাল্লা ফিলিস্থিন বা আশেপাশে রাখা যীশুর অনুসারীরা মোটেও নিরাপদ ভাবলেন না তারা এটাকে উত্তরের প্রতিপত্তিশালী খ্রীষ্টান সম্প্রদায় যারা অ্যান্টিওখ, কোরিন্থ, এফিসাস অথবা এডেসাতে বসবাস করতেন তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
৩২৫ খ্রীষ্টাব্দে চার্চ বিষয়ক ঐতিহাসিক ক্যাসারিয়ার বিশপ ইউসেবিয়াস ( ২৬০-৩৪০ খ্রীষ্টাব্দ) জানান যে যীশু এবং এডেসার রাজা পঞ্চম এ্যাবাগার উক্কামা (দ্যা ব্ল্যাক)র মাঝে চিঠিপত্রের আদান প্রদান হয়েছিল। ইউসেবিয়াসের লেখা থেকে আরো জানা যায় তিনি নিজে এডেসিয়ান মাহাফেজখানায় রক্ষিত এই সব চিঠি প্রাচীন এ্যারামেয়িক থেকে গ্রীকে অনুবাদ করেছিলেন। রাজনৈতিক ভাবে এডেসা এ্যাবাগার বংশের অধীনে খ্রীষ্টপূর্ব ১৩২ থেকে ২১৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
এখানে উল্লেখ্য করা অবান্তর হবে না দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি নবম এ্যাবাগার রাজা মা’নুর অধীনে এ্যাডেসায় চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে এর আগে থেকেই পঞ্চম এ্যাবাগার রাজা উক্কামার সময় থেকেই এ্যাডেসায় একটা ভালো পরিমান খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের বাস ছিল।
ইউসেবিয়াসের লেখা থেকে উল্লেখ্য পাওয়া যায়, রাজা পঞ্চম এ্যাবাগার উক্কামা জেরুজালেমে যীশুর কাছে দুত পাঠিয়েছিলেন তার চুলকানির উপশমের জন্য। সেক্ষেত্রে যীশু নিজে যেতে না পারলেও থাড্ডিয়াস (এ্যারামিক ভাষায় “অ্যাড্ডাই”) নামে এক শিষ্য কে পাঠান এক চিঠি দিয়ে তাতে তিনি উল্লেখ্য করেন যে এই শিষ্যই (থাড্ডিয়াস) তাকে সুস্থ্য করে তুলবেন এবং তার শহরকে কোন এক আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
১৮৫০ সালের দিকে নিম্ন মিশরের মরুভুমিতে ন্যাট্রন উপত্যাকায় ওয়াদি এল ন্যাট্রনের কাছে এক প্রাচীন আশ্রমে প্রাচীন এ্যারামিক ভাষায় যার মাঝে অন্যতম ছিল এ্যাবাগার লিজেন্ডের অরেকটা ভাষ্য যা আজ “ডকট্রিনা এ্যাড্ডাই” নামে পরিচিত। ষষ্ঠ শতকের শেষ নাগাদ (৫২৭ – ৬০০ খ্রীষ্টাব্দ) এভাগরিয়াস স্কোলাস্টিকার ভাষ্যের সাথে যা হুবহু মিলে যায়। ৯৪৫ সালে বাইজেনটাইন সম্রাট সপ্তম কনষ্ট্যানটাইন পারফিরোজেনিটোসের ফ্যারেস চ্যাপেলে এডেসা প্রতৃকৃতির (শ্রাউড অভ তুরিন) অবগুন্ঠন উন্মোচনের উপলক্ষ্যে আয়োজিত আনন্দপর্বে অভিভাষন পর্বেও ইউসেবিয়াসের কথাকেই সমর্থন করে। এই সময়ের বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ পর্যালোচনা ইয়ান উইলসন এই মর্মে উপনীত হন, যীশু শুধু থাড্ডেয়াসকেই না নিজের কোণ এক অলৌকিক প্রতিকৃতিও পাঠিয়েছিলেন।
পঞ্চম এ্যাবেগার উক্কামা কে থাড্ডেয়াস সুস্থ্য করার পর এডেসায় রাজা সহ প্রায় সব নাগরিক যীশুর প্রতি বিশ্বাস আনেন। ডকট্রিনা অ্যাড্ডাই তে থাড্ডিয়াসের এই ধর্মোপদেশের সময়কাল পরিস্কার উল্লেখ্য আছে, এডিসান গননা অনুযায়ী সে সময়টা বছর ৩৪৩ অথবা খ্রীষ্টীয় ৩৩ সাল। যে সালে যীশুকে ক্রশ বিদ্ধ করা হয়েছিল। এটাও ধারনা করে নেয়া অমুলক না যে থাড্ডেয়াস এডেসায় গিয়েছিলেন যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার পরেই। সেক্ষেত্রে অনেক গুলো ছিন্ন সুতা এক সাথে মিলে যায়।
সে সময় কাফনের কাপড় অশুভ বলে পরিগনিত হত তাই থাড্ডেয়াস আলখাল্লাটাকে কয়েক ভাজে ভাজ করে তার এডেসীয় সহ ধর্মী স্বর্নকার এ্যাগাই এর সহযোগিতায় একটি সোনার ফ্রেমে বাধাই করে দেয়। ১১০ সেমি লম্বা ৫৪.৫ সেমি প্রস্থ বিশিষ্ট সোনার ফ্রেমে বাধাই করা ওই আলখাল্লায় শুধু যীশুর মুখই দেখা যেত। ৯৪৫ সালের কনসষ্ট্যান্টিপোলের ভাষন অনুযায়ী উক্কামা নগর তোরনে ওই সোনা দিয়ে বাধান প্রতিকৃতি স্থাপন করেন।
৫০ খ্রীষ্টাব্দে অ্যাবাগার মারা গেলে তার ছেলে পঞ্চম মা’নু সাত বছর দেশ শাষন করে মারা যান এরপর এ্যাবাগারের দ্বিতীয় পুত্র সপ্তম মা’নু শাষনে আসেন সপ্তম মা’নু খ্রীষ্ট ধর্ম ছেড়ে পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে যায় এবং খ্রীষ্টানদের ওপর নির্মম নির্যা্তন চালায়। ৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দের কনসষ্ট্যান্টিপোলের ভাষন অনুযায়ী সে সময় এডেসার খ্রীষ্টধর্মর নেতা ছিলেন এ্যাগাই (যিনি সোনার ফ্রেম দিয়ে আলখাল্লাটি বাধাই করে দিয়েছিলেন) তিনি প্রতিকৃতিটি তোরনের ফাকা স্থানে লুকিয়ে ফেলেন। সপ্তম মা’নু প্রতিকৃতিটি খুজে না পেয়ে এ্যাগাই সহ অনেক খ্রীষ্টান কে হত্যা করেন। সেটা ৫৭ খ্রীষ্টাব্দে। এরপর প্রায় ৫০০ বছর এই প্রতিকৃতির কোন খোজ পাওয়া যায় না।
৫৯৩ সালে চার্চ বিষয়ক ঐতিহাসিক ইভাগ্রিয়াসের ভাষ্যে আলখাল্লাটার উল্লেখ্য পাওয়া যায়। এরপর আবার ইয়ান উইলসন ব্যাখ্যা করেন, ৫২৫ সালে এক ভয়ংকর বন্যার পর সম্রাট জাষ্টিনিয়ানের আদেশে এডেসা পুর্নগঠনের সময় ফ্রেমে বাধানো আলখাল্লাটি আবার পাওয়া যায়। বিশপ ইউলেসিয়াসের ভাষায়, “খুজে পাওয়া প্রতিকৃতিটা নিশ্চিতভাবে কোন মানুষ্য সৃষ্টি না”। এর পর এই প্রতিকৃতিটা একটা রূপার সিন্দুকে হাজিয়া সোফিয়া ক্যাথেড্রালে নিয়ে আসা হয়। এখানে এসেই এই এডেসার প্রতিকৃতি বা শ্রাউড অভ তুরিন “ম্যান্ডিলিয়ন” নামে অভিহিত হয়। যা অত্যন্ত পবিত্র এক ধর্মীয় উপকরন হিসাবে স্বীকৃতি হয়।
৬৩৯ সালে আরবরা এডেসা দখল করে নিলে আলখাল্লাটাও তাদের দখলে আসে। জনৈক ধনাঢ্য খ্রীষ্টান গিমিয়া পরিবারের এ্যাথেনসিয়াস এটা আরবদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে শহরের ভুগর্ভস্থ কোন এক চার্চে লুকিয়ে রাখে। এই সময় এর নাম “ম্যান্ডেলিয়ান” নামে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করে (অপেক্ষাকৃত নতুন ল্যাটিন শব্দ ম্যানটেলিয়ান থেকে আগত যার মানে এক টুকরা কাপড় যা দিয়ে নিদেনপক্ষে মস্তক পাগড়ী বানানো যায়)।
ষষ্ঠশতকে ম্যান্ডেলিয়ান আবিস্কারের পর খ্রীষ্টের আকা অবয়বেরও পরিবর্তন আসে, এর আগে খ্রীষ্টের আকা ছবি ছিল তরুন, দার্শনিক, সম্রাট আবার কখনো অজাতশ্মশ্রু মেষপালক হিসাবে কিন্তু ম্যান্ডেলিয়ন আবিস্কারের পর এর ওপর প্রাপ্ত প্রতিকৃতির সাথে সামঞ্জ্যস্যপূর্ন শ্মশ্রু মন্ডিত খ্রীষ্টের ছবি আকা শুরু হয়। ষষ্ট শতকের পর ঐতিহাসিকরা যীশুর অবয়বের ১৫ টা (উইলসন) থেকে ২০টা (ভিগনন, উএনশ্চেল) দর্শনীয় বৈশিষ্ট চিহ্নিত করেন।
ভিগননের চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য
অষ্টম শতকে, তৃতীয় লিও পূর্ব রোমান সম্রাজ্যের রাজা হন তিনি ছিলেন প্রতিমা বিরোধী। এদিকে এডেসাবাসী লিও সিংহাসনে বসার সাথে সাথেই ম্যান্ডেলিয়ন কে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলে। এর ষাট বছর পর প্রতিমাবিরোধীরা চার্চ কর্তৃক আনুষ্ঠানিক ভাবে তিরস্কৃত হলে ম্যান্ডেলিয়নকে কনসষ্ট্যানটিয়ানপোলে নিয়ে আসার জোর প্রচেষ্টা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সম্রাট রোমানাস লিকাপিনাসের শাসন কালে ৯৪২ সালের ১৫ ই আগষ্ট আলখাল্লা কনসষ্ট্যানটিয়ানপোলে আসে। এবং পরবর্তী ২৫০ বছর ব্লাচারনাই চার্চে সংরক্ষিত হয়।
এরপর ১২০৩ সালে ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহন কারী ফরাসী যোদ্ধা রবার্ট ডি ক্ল্যারি লিখছেন যে তিনি কনসষ্ট্যানটিয়ানপোলের ব্লাচারনাই চার্চে আলখাল্লাটা দেখছেন। ইনি ছিলেন একজন নাইট টেম্পলার ছিলেন। এখান থেকে ম্যান্ডেলিয়নের আবার হাত ঘোরা শুরু হয় যা পরবর্তী পর্বে লিখব। এখানে হয়ত নাইট টেম্পলারদের নিয়েও কিছু লিখতে হতে পারে। আসলে এত বড় ইতিহাস ব্লগের এই স্বল্প পরিসরে আটানো যে কি মুশকিল তা লিখে বুজানো যাবে না। তবুও লিখতে যখন বসেছি এর শেষ দেখে নেব।
সাথে থাকুন।
চলবে
সুত্রঃ প্রথম পর্বের নীচে এছাড়াও নেটের বিভিন্ন আর্টিকেল।