মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান বিমান-বাহিনী, পিআইএ এবং অন্যান্য বেসামরিক সংস্থা থেকে বেশ কিছু বৈমানিক ও বিমানসেনা পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁরা বিমানবাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা করলেও অর্থনৈতিক কারণে শুরুতেই তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশ সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার ফলে ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীকে কয়েকটি বিমান দেওয়ার আশ্বাস দেয়।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লালের একান্ত সহযোগিতায় অবশেষে আমেরিকায় তৈরি ড্যাকোটা নামে পরিচিত একটি পুরোনো ডিসি-৩ বিমান, কানাডায় তৈরি একটি অটার বিমান এবং ফ্রান্সে তৈরি একটি অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টার পাওয়া যায়। এরপর নয়জন বৈমানিক ও ৪৭ জন বিমানসেনা নিয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। ভারতীয় বিমা নবাহিনীর পক্ষে জোড়হাট বিমানঘাঁটির কমান্ডার গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে যাবতীয় অপারেশন, বেতার যোগাযোগ, কারিগরি ও প্রশাসনিক সহায়তা দেন। যাত্রা শুরুর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পি সি লাল ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এ কে খন্দকার। এই বিমানবহরের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় ‘কিলো ফ্লাইট’। এর অধিনায়ক ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ।
কিলো ফ্লাইটের অধিকাংশ অভিযান পরিচালিত হয় নাগাল্যান্ড থেকে। অভিযানের সুবিধার্থে কিলো ফ্লাইট কলকাতাসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি ভারতীয় বিমানঘাঁটি ব্যবহার করত। উত্তরে ঠাকুরগাঁও থেকে দক্ষিণে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সর্বত্রই কিলো ফ্লাইটের অভিযান পরিচালিত হয়। যুদ্ধকালে অটার ছয়টি এবং অ্যালুয়েট ৪৪টি অভিযান পরিচালনা করে। ড্যাকোটা বিমানটি মূলত পরিবহনের জন্য ব্যবহূত হতো।
অ্যালুয়েট ছিল দুজন পাইলট ও তিনজন আরোহী বহনের উপযোগী একটি ছোট ও পুরোনো বেসামরিক হেলিকপ্টার। যুদ্ধোপযোগী করতে এর দুপাশে সাতটি করে ১৪টি রকেট বহন করার জন্য রকেট পড যুক্ত করা হয়। লাগানো হয় মেশিনগান। এ ছাড়াও করা হয় ২৫ পাউন্ড ওজনের বোমা ফেলার ব্যবস্থা। শত্রুর রাডারকে ফাঁকি দিয়ে অ্যালুয়েট বেশ নিচু দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম ছিল। এর পাটাতনে এক ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের পাত লাগানো হয়, যাতে শত্রুর অবস্থানে নিচু উচ্চতায় উড়ে যাওয়ার সময় তাদের ক্ষুদ্রাস্ত্রের গুলি এর ক্ষতি করতে না পারে।
যুদ্ধে বিমান, নৌ ও সড়কপথের যানবাহনগুলো সচল রাখতে পর্যাপ্ত জ্বালানি তেলের প্রয়োজন পড়ে। সে কারণে পাকিস্তান বাহিনীর যানবাহন চলাচলে বিপর্যয় ঘটাতে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে অবস্থিত পাকিস্তান বাহিনীর মূল দুই তেলের ডিপোকে ডিসেম্বরের শুরুতেই বিমান হামলা করে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। অ্যালুয়েটের জন্য লক্ষ্যবস্তু নির্ধারিত হয় নারায়ণগঞ্জের অদূরে গোদনাইলে অবস্থিত তেলের ডিপো।
৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে আগরতলা বিমানবন্দর থেকে শুরু হয় অ্যালুয়েটের যাত্রা। গোদনাইল পৌঁছাতে অ্যালুয়েটের প্রয়োজন ছিল এক ঘণ্টা। ফ্লাইট পরিচালনা করছিলেন ফ্লাইং অফিসার ড. বদরুল আলম, ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দীন ও স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। যাত্রা শুরুর পর সীমান্ত পেরিয়ে হেলিকপ্টারটি কুমিল্লার উত্তরে ইলিয়টগঞ্জের কাছাকাছি ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কে আসে। এরপর মহাসড়ক অনুসরণ করে দাউদকান্দি হয়ে ডেমরা পৌঁছায়। এখান থেকে দক্ষিণে মোড় নিয়ে গোদনাইলে পৌঁছেই তেলের ট্যাংকের ওপর বোমা ফেলে। মুহূর্তের মধ্যেই ট্যাংকারগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে যায়। পাকিস্তান বাহিনী কিছু বুঝে ওঠার আগেই গোদনাইল ত্যাগ করে অ্যালুয়েট নিরাপদ এলাকায় চলে আসে।
সংগৃহিত
সূত্রঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১:০৫