অতীতে ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্যে ‘বাঈ’ শব্দ দ্বারা ধ্রুপদী নৃত্য-গীতে পারদর্শী সম্ভ্রান্ত মহিলাদের বোঝানো হত৷ খুব ছোট থাকতেই তারা ওস্তাদদের কাছে তালিম নিয়ে নৃত্যগীত শিখতেন৷ শিক্ষা শেষে শাস্ত্রীয় নৃত্যগীতকে পেশা হিসেবে নিলে লোকে তাদের ‘বাঈ’ শব্দটির সম্মানসূচক ‘জি’ শব্দটি জুড়ে দিত, তখন তাদের নামে শেষে ‘বাঈজি’ শব্দটি শোভা পেত৷ বাঈজিরা সম্রাট, সুলতান, বাদশা, রাজা-নবাব ও জমিদারদের রঙমহলে শাস্ত্রীয় নৃত্যগীত পরিবেশন করে বিপুল অর্থ ও খ্যাতিলাভ করতেন৷ অর্থ আয়ের জন্য তারা যেমন বাইরে গিয়ে ‘মুজরো’ নাচতেন, তেমনি নিজেদের ঘরেও মাহফিল বসাতেন৷
খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতায় বাইজিদের আগমন ঘটতে থাকে। অযোধ্যায় বিতাড়িত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহর কলকাতার মেটিয়া বুরুজ এলাকায় নির্বাসিত জীবনযাপনকালে সেখানে যে সংগীত সভার পত্তন ঘটে, তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক বাঈজির আগমন ঘটে। বেশির ভাগ বাঈজিই রাগসংগীত ও শাস্ত্রীয় নৃত্য বিশেষত কত্থকে উচ্চশিক্ষা নিতেন। বাইজিদের নাচ-গানের আসরকে মুজরো বলা হয়, আবার তাকে মেহফিল বা মাহফেলও বলা হয়ে থাকে। মেহফিলে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অংশগ্রহণ ছাড়াও কোনো কোনো বাইজি রাজা-মহারাজা-নবাবদের দরবার থেকে নিয়মিত মাসিক বেতন পেতেন। বাইজিদের নাচ-গানে মোহগ্রস্ত হওয়ার কারণে কোনো কোনো নবাব-রাজা-মহারাজা বা ধনাঢ্য ব্যক্তির পারিবারিক ও আর্থিক জীবনে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি হয়েছে।
ফরাসী চিত্রকর বেলেনস এর আঁকা এক বাঈজী
ঢাকায় বাইজিদের নাচ-গান শুরু হয় মুঘল আমলে। সুবাহদার ইসলাম খাঁর দরবারে (সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম পর্ব) যারা নাচ-গান করতেন তাদের 'কাঞ্চনী' বলা হতো। উনিশ শতকে ঢাকার নবাব নুসরাত জং, নবাব শামসুদ্দৌলা, নবাব কমরুদ্দৌলা এবং নবাব আবদুল গণি ও নবাব আহসানুল্লাহর সময় বাইজিদের নাচ-গান তথা মেহফিল প্রবলতা পায়। তারা আহসান মঞ্জিলের রংমহল, শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল, দিলকুশার বাগানবাড়িতে নৃত্য-গীত পরিবেশন করতেন। ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যেসব বাইজি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাদের মধ্যে লক্ষ্মৌর প্রখ্যাত গায়ক ও তবলাবাদক মিঠুন খানের নাতি সাপান খানের স্ত্রী সুপনজান উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকায় ছিলেন।
১৮৭০-এর দশকে ঢাকার শাহবাগে নবাব গণির এক অনুষ্ঠানে মুশতারী বাই সংগীত পরিবেশন করে প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবদুল গফুর খানের নজরে পড়েছিলেন। ১৮৮০-এর দশকে শাহবাগে এলাহীজান নামে আরেক বাইজির নৃত্য ও করুণ পরিণতির দৃশ্য দেখেছিলেন হাকিম হাবিবুর রহমান। নবাব গণির দরবারে নাচ-গান করতেন পিয়ারী বাই, হীরা বাই, ওয়ামু বাই, আবেদী বাই, আন্নু নান্নু ও নওয়াবীন বাই। শেষোক্ত তিন বোন ১৮৮০-এর দশকে ঢাকার নাটক মঞ্চায়নের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ঢাকার অন্য খ্যাতিমান বাইজিদের মধ্যে ছিলেন বাতানী, জামুরাদ, পান্না, হিমানী, আমিরজান, রাজলক্ষ্মী, কানী, আবছন প্রমুখ। এছাড়া কলকাতা থেকে মাঝেমধ্যে ঢাকায় মুজরো নিয়ে আসতেন মালকাজান বুলবুলি, মালকাজান আগরওয়ালী, জানকী বাই, গহরজান, জদ্দন বাই, হরিমতী প্রমুখ।
নাচ গান ও রূপের নেশায় ঊচ্চমান অর্জন হলেও কোন পুরুষ শিল্পী কিন্তু এই সব বাইজির সাথে এক আসরে বসতে চাইতেন না। কলকাতার একটি আসরে মোস্তারী বাই পূরবী রাগে খেয়াল গেয়ে সুরের মদিরায় শ্রোতাদের এমন আচ্ছন্ন করেছিলেন যে ওই আসরে পরবর্তী শিল্পী বিখ্যাত ফৈঁয়াজ খা, এনায়েত খা ও হাফেয খা মঞ্চে উঠতেই অস্বীকৃতি জানলেন।
ইন্দোররাজ শিবাজী হোলকারের সভায় বিখ্যাত বীনাকার স্বয়ং বন্দে আলী খা। বীনা বাজিয়ে সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ করেন সব শ্রোতাদের, শিবাজীর খাস নর্তকী চুন্নাবাঈ কিন্তু ছিলেন সেদিন মুগ্ধ শ্রোতাদের আসরে। খুশী হয়ে রাজা ইনাম দিতে চেয়েছিলেন বীনাকারকে। সুরমুগ্ধ রাজাকে চমকে দিয়ে বন্দে আলী খা ইনাম হিসাবে চেয়ে বসলেন বাঈজী চুন্নাবাইকে।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতায় নিকি বাঈ, আশরুন জিনাত, বেগমজান, হিঙ্গল বাঈ, নান্নিজান বাঈ ও সুপনজান বাঈয়ের নাম শোনা যায়। হেকিম হাবিবুর রহমান তার লেখায় অনেক বাঈজীর নাম বলেছেন যেমন- আবেদি বাঈ, আন্নু, গান্নু, নোয়াবীন, পিয়ারী বেগম, আচ্ছি বাঈ, ওয়াসু, বাতানী, হীরা, লক্ষ্মী, জামুরাদ, রাজলক্ষ্মী, এ ছাড়া সত্যেন সেনের লেখা থেকে জানকী বাঈ ও মালেকাজানের নাম জানতে পারি।
বিখ্যাত গহরজান, জদ্দন বাঈ ও মুশতারী বাঈ ঢাকায় মেহফিল অংশ নিয়েছিলেন। এ ছাড়া বিখ্যাত জিন্দাবাহার লেনের দেবী বাঈজী ও হরিমতি বাঈজীর নাম ও উল্লেখ্য করতে হয়। ঢাকার জিন্দাবাহার লেনের বাসিন্দা বিখ্যাত শিল্পী পরিতোষ সেনের লেখায় হরিমতি বাঈজীর কথা আছে। তিনি লিখেছেন- হরিমতি বাঈজীর ঘর টি আমাদের বারান্দা থেকে পরিস্কার দেখা যায়, প্রতিদিনের অভ্যাস মত সকালে ভৈরবী রাগে গান ধরেছেন ‘রসিয়া তোরি আখিয়ারে, জিয়া লাল চায়’ ঠুংরী ঠাটের গানের এ কলিতে আমাদের জিন্দা বাহার গলি কানায় কানায় ভরে উঠেছে।
নওয়াবীন বাঈজী
সেকালে ঢাকার গানের আসরে ছিল সব সমাজদার শ্রোতার আগমন, ইন্দুবালার একটি মন্তব্য থেকে এ ব্যাপারে ধারনা পাওয়া যায়, কলকাতা থেকে ঢাকা আসার আগে সে কালী ঘাটে যেয়ে মন্দিরে প্রার্থনা করেছিল, মা ঢাকা যাচ্ছি, ঢাকা তালের দেশ, মান রাখিস মা’। ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল ডেভিডসন ১৮৪০ সালে ঢাকার অধিবাসীদের ‘মিউজিক্যাল পিপল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
বাঈজী নাচ ও খেমটা নাচ সেকালে ঢাকার মানূষদের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাড়িয়েছিল। কবি নবীন চন্দ্র সেন তার ছেলের বিয়েতে ঢাকা থেকে বাঈজী আনতে পেরে গর্ব অনুভব করেছিলেন। গান আর নাচে খুব দক্ষ না হলে সে কালে ভাল বাঈজী হওয়া যেত না আর তার সাথে অবশ্যই থাকতে হত রূপের মোহ।
একবার খেতরীর রাজার সভায় উপস্থিত হন স্বয়ং বিবেকানন্দ। সভায় একজন বাঈজী গান গাইবেন, একেতো স্ত্রীলোক তায় আবার বাঈজী বিবেকানন্দ গান শুনতে অস্বীকৃতি জানাল, কিন্তু রাজার অনুরোধে গান শুনতে বসলেন। বাঈজী গাই লেন
প্রভু মোর অবগুন চিতনা ধর
সমদরশি হ্যায় নাম তোমার
এক লহো পুজামে রহত হ্যায়
এক রহো ঘর ব্যাধক পরো
পরলোক মন দ্বিধা নাহি হ্যায়
দুই কাঞ্চন করো।
গান শুনে বিবেকানন্দের চোখে পানি চলে আসে। এরপর সেই বাঈকে বিবেকানন্দ মা বলে সম্ভোধন করেন। যারা মানুষের আনন্দের জন্য নিজেদের বিলিয়ে দিতেন সমাজ তাদের দিত নিত্য বঞ্চনা।
কৃতজ্ঞতাঃ হেকিম হাবিবুর রহমান, ডঃ মুনতাসির মামুন, শামীম আমিনুর রহমান, ইন্টারনেট।
দ্বিতীয় পর্বঃ ঢাকার বাঈজী কাহিনী (দ্বিতীয় পর্ব)
তৃতীয় পর্বঃ ঢাকার বাঈজী কাহিনী (তৃতীয় পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৯:১১