সবে মাত্র ভার্সিটি থেকে পাশ করে বের হয়েছি। একটা চাকুরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি। প্রচন্ড হতাশায় যখন চোখে অন্ধকার দেখছি তখনই পেয়ে গেলাম চাকুরী নামক সোনার হরিন আর ওখানেই আমার পরিচয় হল ভীস্ম বাবুর সাথে। ভীস্মকুমার ব্যানার্জী। আমরা চাকুরী করতাম একটা ছোট্ট সওদাগরী অফিসে। প্রথমে আমি যখন অফিসে ঢুকি ভীস্ম বাবু আমার এক ধাপ ওপরে ছিলেন কিন্তু আমি খুব শীঘ্রী আমার কর্মদক্ষতার জন্য একই পজিশনে চলে আসি ভীস্ম বাবুর সাথে। সময়টা ১৯৯৫ হবে হয়ত।
আমি যখন ভীস্ম বাবুর সাথে একই পোষ্টে কাজ করছিলাম অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এক আজব মানুষ ভীস্ম বাবু, অফিসের সবাই যখন কাজ না করে নিজের ক্রেডিট নেবার জন্য ষোল আনা ব্যাস্ত ঠিক তখনই ভীস্ম বাবু নিজের ক্রেডিট অন্যের ওপর দিতে ব্যস্ত। সব সময়ই দেখছি কাজে কোন গাফলতি নেই বরং সবার থেকে বেশী ই কাজ করে কিন্তু প্রসংশা বা ক্রেডিট নেবার ব্যাপারে কেমন যেন কার্পন্য। এর পূর্ন সুযোগ নিতাম আমরা যারা ওনার সাথে কাজ করছি। সবাইকেই দেখতাম তরতর করে উঠে যাচ্ছে আর ভীস্ম বাবু একই জায়গায় পরে আছে। আমার আর একটা প্রমোশন খুব কাছে।
না হবার কোন কারন নাই কারন যার ভীস্ম বাবুর মত কলিগ থাকে তার প্রমোশন কেউ আটকাতে পারে না। আর সত্যি বলতে কি আমাদের সেই ছোট্ট সওদাগরী অফিস তরতর করে বাড়তে শুরু করছে। দেশে প্রথম সারির ১০ টার মধ্যে আমরা একটা হয়ে গেলুম। কেউ কিন্তু খেয়াল করল না ভীস্ম বাবুর অবস্থান টা। যেখানে নিজে চিৎকার করে না জানান দিলে কেউ ফিরেও তাকায় না অফিস নামক অ্যা্রেনায়। কে কাকে কি ভাবে ল্যাং মেরে উপরে উঠবে এই সবার থাকে তপস্যা সেখানে ভীস্ম বাবু তো আড়াল করে থাকতে চান। আমি কিন্তু ওনাকে ঠিক নজরে রাখছিলাম। তারপর একদিন-
এক বর্ষনমুখর সন্ধ্যায় আমি যেয়ে হাজির হলাম ভীস্ম বাবুর ছোট্ট বাসায়। এক রুমের এক ঘর। ঘরের কোনে একটা কেরোসিনের স্টোভ এই গ্যাসের যুগেও বুজলাম স্বপাক আহারী। আমাকে দেখে মনে হল আমার প্রতীক্ষায় ছিলেন। কোন অবাক হলেন না। এ ব্যাপারটাও আমাকে একটু ধাঁধায় ফেলল। আমি কখনও ওনার বাসায় যাইনি কিন্তু ঠিকানা জানতাম, কারো বাসায় কোন খবর না দিয়ে গেলে খুব স্বাভাবিক ভাবে গৃহকর্তা একটু অবাক হন যেটা ভীস্ম বাবুর মধ্যে পূর্ন অনুপস্থিত।
সেদিন ছিল ঘনঘোর আষাঢ়। গুরু গুরু মেঘ ডাকছিল।আমাকে দেখে ভীস্ম বাবু বেশ আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন করল। আরো অবাক ব্যাপার মনে হল আমার জন্য উনি রান্নাও করে রেখেছেন না হলে কি ভাবে দু জনার রাতের খাবার উনি দিতে পারলেন যেখানে উনি মাত্র একজন। একথা সেকথার পর উনিই সেই প্রশ্নটি তুললেন যে প্রশ্ন আমি তুলতে চেয়েছিলাম, আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে ততক্ষনে। প্রচন্ড বজ্রপাতে ইলেকট্রিসিটির ট্রান্সফরমার ও বোধহয় বিকল হয়ে গেল।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভীস্মবাবু শুরু করলেন, ‘শের সাব ( যদিও বয়সে আমি ওনার থেকে অনেক ছোট) আমি জানি আপনাকে একটা প্রশ্ন অনেক দিন ধরে খুটে খুটে খাচ্ছে, আজকে আপনি যে আসবেন সেটাও আমি জানতাম’।
‘কি ভাবে ভীস্ম বাবু’ আমার বিস্মিত প্রশ্ন
‘কি ভাবে? তা হলে শুরু থেকে শুনুন, আমার জন্ম ১৬২৩ খ্রীষ্টাব্দে। আমার বাবা ছিলেন মেবারের মহারাজা প্রতাপ সিং এর রাজপুরোহিত ইন্দ্র কুমার সিং ব্যানার্জী। উনি ছিলেন সিদ্ধপুরুষ। বাদশাহ আকবর যখন মেবার আক্রমন করেন আমার মাও অন্য সব মহিয়ষীর সাথে জহরব্রত পালন করেন, আমার বাবা আমাকে নিয়ে পালিয়ে যান অনেক দূরে এই সূবে বাংলায়। বাংলায় তখন রাজত্ব চলছিল শের খা নামে এক রাজপুরুষের। আমার বাবা সহ্য করতে পারলেন না এই বিদেশী আক্রমন। আরো কঠিন তপস্যায় বসলেন। দেবতার দয়ায় উনি বাক সিদ্ধ পুরুষ হলেন। উনি মারা গেলেন যখন আমি ১৭ বছর কিন্তু মারা যাবার আগে আমাকে আশীর্বাদ করে গেলেন আমি যেন ইচ্ছা মৃত্যু প্রাপ্ত হই আর আমকে বলে গেলেন এই বাংলা যতদিন পর্যন্ত না কালিমা মুক্ত হয় আমি যেন মৃত্যু ইচ্ছা পোষন না করি। পিতৃ আজ্ঞা আমি পালন করছি’। এ পর্যন্ত বলে আমার মুখের দিকে তাকালেন।
আমার মনে তখন অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, কিন্তু কিছুই মুখে আসছিলো না, কিন্তু আমি অনুভব করলাম কেউ যেন আমার মনের ভেতরে অবস্থান করছে। আমার মনের ভেতর থেকে কেউ যেন কথা বলছে সে আমি না।
কি বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই স্বাভাবিক শের সাব। বিশ্বাস না হওয়াই স্বভাবিক। এই যে দেখুন সিপাহী বিদ্রোহে আমি ছিলাম মঙ্গল পান্ডে এই যে দেখুন ভাল করে দেখুন আমার গলায় যে ফাসির দাগ এটা আমার সিপাহী বিদ্রোহের অলংকার। এই যে দেখুন আমার হাতের কব্জিতে দড়ির দাগ আমি ছিলাম ক্ষুদিরাম ওরা আমার হাত পিছন মোড়া করে বেধেছিল, এই যে দেখুন কপালের এই দাগটা এটা আমি পেয়েছিলাম ভাষা অন্দোলনের সময়’।
‘কি ভাষা অন্দোলনে আমি কে ছিলাম? কেন একবার মনে করে দেখেন সেই যে ছোট বাচ্চাটার কথা যে কিনা ভাষা আন্দোলনের সময় মারা গেছিলো রফিক, বরকত, জব্বরের সাথে। এই দেখুন আমার হাতে পায়ে অসংখ্য দাগ এ গুলো আমার স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরব’
‘আর কি দেখাতে হবে শের সাব’? মনে হল ভীস্ম বাবু একটু একটু হাপাচ্ছে। শের সাব আমার বয়স বাড়ে না এই ৪৩ এ আটকে আছে। আর আমি চাইলে অন্য দেহ ধারন করতে পারি। কিন্তু আপনি আমাকে যে দেহে দেখছেন এটাই আমার সত্যিকার দেহ।
আমি মনে মনে বললাম ‘না আর দেখাতে হবে না, আমি আপনাকে একটু ছুয়ে দেখতে চাই। নিজেকে একটু পবিত্র করতে চাই’। আমার হাতে ওপর ভীস্ম বাবুর হাতের ছোয়া পেলাম।
শের সাব, আমি বাবার আজ্ঞা অনুযায়ী মুনুষের কাছে আমার পরিচয় দিতে পারব না আর কেউ যদি আমার পরিচয় জেনেই যায় তবে আমি আর সেখানে থাকব না। কাল থেকে আমি আর অফিসে যাবনা যেহেতু যত দিন এই ধামে বেচে আছি তত দিন আমাকে কিছু একটা করে অন্ন ধারন করে খেতে হবে আমি অন্য কোনখানে চাকুরীর ব্যাবস্থা করে নেব। আপনাকে আমি আশীর্বাদ করছি অনেক বড় হোন।
আমি টের পেলাম ঘুমে আমার দু চোখ ভেঙ্গে আসছে, ভীস্ম বাবু কে সেই আমার শেষ দেখা। পরদিন ভোরে উঠে দেখলাম সামান্য কিছু জিনিস পত্র সেই ভাবে পড়ে আছে আর ভীস্ম বাবু চলে গেছেন।
এখানেই আমার গল্প শেষ হতে পারত। কিন্তু না। আজ এই ২০১৩ সালে এসে আমি নিজ প্রচেষ্টায় বেশ বড় একটা ফার্মের মালিক। বেশ কিছু কর্মচারী আমার অধীনে কাজ করে। এইচ আর আরো কিছু লোক নেবার জন্য আমার কাছে অনুরোধ করছে। আমি অনুমতি দিলাম। এখন ও সেই শুরুর মত আমি নিজে লোক বাছাই করি। দরখাস্ত দেখতে দেখতে একটা দরখাস্তে আমার চোখ আটকে গেলঃ
নামঃ ভীস্ম কুমার সিং ব্যানার্জী
পিতাঃ মৃত ইন্দ্র সিং ব্যানার্জী
বয়সঃ ৪৩
…………………………………
আমি হতবাক হয়ে বসে আছি। কালকেই সেই ইন্টারভ্যূ।
এটা আমার ব্লগে চতুর্থ গল্প। তবে চেষ্টা করছি ঐতিহাসিক তথ্যে সৎ থাকার জন্য।
একটি অলৌকিক প্রেম কাহিনী
জাতিস্মর
আবুর জ্বীনে পাওয়া