সেবার শীতটাও পড়ছিলো বেশ মারাত্মক ভাবে। আমাদের গ্রামে এত শীত নাকি কেঊ কখন ও দেখেনি শীতের পড়ন্ত বিকেল। একে তো ঠান্ডা তার ওপর কুয়াশা দশ হাত দূরের কিছু দেখা যায় না। মাগরিবের আযান দিয়ে ফেলছে। আমারা বাড়ীর পুরুষরা দরজার পুকুর পাড়ে সবাই অযু করছি নামায পড়ব বলে। এর মধ্যে মজনু কাকু আমাকে বলল “ও শের দেখ তো বাবা ওই খাল পাড় দেয়া কেডা আসতেছে”?
একটু ভাল করে ঠাহর করে দেখলাম ঠিকই তো এক লম্বা অবয়ব কুয়াশার মধ্য থেকে আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে। কাছে এসে সবাই কে ভারাট গলায় সালাম দিল আর নিজের পরিচয়ে বলল তার নাম সৈয়দ আবদুর রহমান। অনেক দূর থেকে এসেছে। যদি আজকে রাত আমরা অনুমতি দেই তো সে আমাদের বৈঠক খানায় কাটিয়ে দিতে পারে এশার নামাযের পর। আমাদের বৈঠকখানা মসজিদের সাথেই।
সৈয়দ আবদুল রহমান সাহেবের একটু বর্ননা দেই। প্রায় ষাট বছরের মত বয়স। লম্বায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। মুখের দাড়ি প্রায় বুক পর্যন্ত এসে ঠেকছে। আর ছিল তার চোখ। আজব রকমের এক প্রশান্ত চোখ। এই রকম দীঘীর জলের মত শান্ত পবিত্র চোখ আমি কারো দেখিনি, জাগতিক মোহ থেকে মুক্ত না হলে এই ধরনের প্রশান্তি চোখে থাকেনা। কাধে একটা ঝোলা, আর গায়ে ছিল একটা হাটু পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবী যে পাঞ্জাবীতে কমপক্ষে পনের ষোলটা সেলাই দেয়া।
গ্রাম গঞ্জের মানুষের কিন্তু এখনও এই আন্তরিকতা আছে কেউ এসে আতিথেয়তা চাইলে কিন্তু না করে না।হেমায়েত কাকু আন্তরিকতার সাথে ওনাকে বলল এশার নামযের পর আমাদের সাথে খেয়ে বৈঠক খানায় রাত কাটাতে পারবে।
আমাদের মসজিদখানা কিন্তু সবে ওই বছরই নতুন বানানো হয়েছে। বাড়ীর নামে মসজিদের নাম ও হয়ে গেছে ‘তহশিলদার বাড়ীর মসজিদ’। আমরা মসজিদের জন্য একজন হুজুর খুজছিলাম যিনি কিনা আমাদের নিয়মিত ই মাম হিসাবে নাময পড়াতে পারেন। হেমায়েত চাচা আমাদের বাপ চাচাদের মধ্যে সবার বড়। তাই তিনিই বাড়ীর মুরুব্বী হিসাবে সৈয়দ সাহেবের খানা দানার ইন্তেজার করে বৈঠকখানার তালা খুলে দিলেন। আর বললেন সকালে সবাই মসজিদে ফযরের নামাযের সময় হাজির হবে।
ওইদিন যেন কি হল আমাদের নিয়মিত মুয়াজ্জিন ফরাজী কেন যেন ওই দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারল না তার পরিবর্তে অন্য কারো সুরেলা আযানে বাড়ীর সবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। যে যার মত ঘুম থেকে উঠে যেয়ে দেখলাম সৈয়দ সাহেব আযান দিয়ে এক মনে কোরান পড়ছে। সৈয়দ সাহেবের আযানের ধ্বনি আর কোরান পড়ার গলা শুনেই হেমায়েত চাচা এর অন্যান্য চাচাদের মধ্যে চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। সবার অনুরোধে সৈয়দ সাহেবই ওইদিন ফযরের নামাযের ইমামতি করল।
নামায শেষে সবার পক্ষ থেকে হেমায়েত চাচা অনুরোধ করলেন সৈয়দ সাহেবকে আমাদের মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব নিতে। কে যেন কেন সৈয়দ সাহেব এক কথায় রাজী হয়ে গেলেন, সেদিন থেকে তিনি আমাদের কাছে হয়ে গেলেন সৈয়দ হুজুর। এই হল আমাদের মসজিদে সৈযদ হুজুরের আগমন কাহিনী।
এই বার শুনুন সৈয়দ হুজুরের জীবন কাহিনী আমদের সাথে থাকা অবস্থায়। সৈয়দ হুজুর প্রায় ই রোজা রাখতেন। শারীরিক পরিশ্রমের কোন কাজে হুজুর সবার আগে এগিয়ে আসতেন। কখনো দেখিনি কোন কাজে তাকে না বলতে। কথা খুব কম বলতেন, মাঝে মাঝে কাজের ফাকে ফাকে গুন গুন করে খোদা প্রেমের কোন গান ধরতেন সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আর হুজুর কিন্তু মসজিদেই থাকতেন। পাঞ্জাবী ওই একটিই ছিল
এখন শুনুন কি ভাবে আমরা সৈয়দ হুজুরকে আমাদের মধ্য থেকে হারালাম।
আমার চাচাতো ভাই আবু ছোট কাল থেকেই একটু আল্লাহওয়ালা মানুষ। আমার জানা মতে ওর নামায কখনও কাযা করতে দেখি নি। কোথাও কোন ইসলামী মাহফিল হলেই সেখানে সে উপস্থিত হবেই। সেবার ভান্ডারিয়ায় বেশ বড় একটা মাহফিল হয়েছিল এখনও আমার বেশ মনে আছে। ভান্ডারিয়া সদর থেকে আমাদের বাড়ী পায়ে হেটে প্রায় তিন ঘন্টা লাগে আর নৌকায় করে যেতে ৭ ঘন্টা। তো সেদিন মাহফিল শেষ হতে হতে মাঝ রাতের কাছাকাছি আর আপনারা তো জানেনই মাহফিল সাধারনত হয় শীতের রাতে।
আবু সেই মাঝরাতে মাহফিল শেষ করে বাড়ীর কাছে আসতে আসতে ঘড়ির কাটা প্রায় তিনটার কাছে চলে এসেছে। দরজার পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে মসজিদ অতিক্রম করে বাড়ীর মধ্যে ঢোকার সময় খেয়াল করল মসজিদের মধ্যে থেকে হালকা আলোর রেশ দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বের হয়ে আসছে। ভাবল হুজুর বোধ হয় আলো জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। আসতে করে দরজা ঠেলা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখল সৈয়দ হুজুর মসজিদের মেঝে থেকে দু হাত ওপরে শুন্যে এক মনে জিকির করছে আর কিছু হালকা সাদা অবয়ব হুজুর কে ঘিরে বসে আছে শুন্যে।
আবুর সংজ্ঞা হারাবার উপক্রম হল। কোনক্রমে কাপতে কাপতে বাড়ী এসে সবাই কে ঘুম থেকে উঠাল আর সবিস্তারে বর্ননা করল মসজিদে সে কি দেখেছে। ঘরে ঘরে ফিসফিসানি শুরু হল আবার হেমায়েত চাচার নেতৃত্বে আমরা মসজিদে গেলাম সেই রাতে। সৈয়দ হুজুর তখনও মসজিদে তবে স্বাভাবিক অবস্থায় বসে আছে।
‘হুজুর আপনি কে’? হেমায়েত চাচা অত্যন্ত তাজিমের সাথে জিজ্ঞাস করলেন।
হুজুর মনে হল কিছুটা বিভ্রান্ত এতরাতে সবাই কে এক সাথে দেখে, ‘ভাই আপনি কি বলছেন আমি তো কিছুই বুজছি না’?
হুজুর আমি আপনাকে জোর হাতে অনুরোধ করি আপনি কে আমাদের বলুন আমরা হয়ত না বুজে আপনাকে কত তকলিফ করছি, বলুন আপনি কে’? হেমায়েত চাচা হাহাকার করে উঠলেন।
হুজুর ততোধিক বিস্মিত হয়ে অনুরোধ করলেন ‘ভাই বলুন কি হয়েছে’?
বাধ্য হয়ে হেমায়েত চাচা বর্ননা করলেন আবু কি দেখেছে। অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল তখন দাঁড়ানো থেকে সৈয়দ হুজুর সেজদায় পরে গেলেন আর জোরে জোরে কান্না করে ব লতে লাগলেন, হে আমার রব আমি কি অন্যায় করছি তোমার কাছে, হে আমার পেয়ারী তুমি তো জান ই প্রেমের আনন্দ গোপনে, কেন তুমি তোমার আমার এই গোপন প্রেম সবার কাছে প্রকাশ করে দিলে? কেন কেন’? হাহাকার করে উঠল হুজুর।
‘আমি বুজতে পারছি তুমি আর চাওনা আমি এখানে থাকি তবে তাই হোক আমি আবার তোমার পথে নামলাম, আবার নতুন কোন ঠিকানা তুমিই আমার তৈরী করে দেবে’। কাদতে কাদতে হুজুর বললেন।
তারপর সেজদা দিয়ে উঠে আমাদের বললেন, ‘শুনুন ভাইয়েরা আমি আর এখানে থাকতে পারবনা আমার অন্য কোন খানে ডাক এসে গেছে। আবু এদিকে আস আমি একটু তোমাকে দোয়া করে দেই’। হুজুর আবুর মাথায় হাত রেখে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা পরিস্কার ভাবে দেখলাম আমাদের হ্যারিকেনের আলো গুলো এক পলক ঝিলিক দিয়ে উঠল।
হুজুর আরো বললেন, ‘ আজকের ফযরের নামায পরিয়েই আমি পথে নামব এই তার ইচ্ছে’। বলে উনি ওনার ঝোলাটা গুছাতে লাগ লেন।
আমরা ওনাকে একবারও থাকার জন্য অনুরোধ করলাম না কারন আমরা জানি ওনারা এই সব অনুরোধের উপরে অবস্থান করে। আমরা হুজুরকে হারালাম।
আমাদের মসজিদে আমার চাচাত ভাই আবু এখন ইমামতি করে, সে এখন মসজিদে থাকে। তার গায়ের পাঞ্জাবীটা কিন্তু বেশ কয়েক জায়গায় ছিড়ে গেছে অতি মমতায় সে সেটাকে তালি দিয়ে ব্যবহার করছে, কিছু বললেই বলে আমার আশেকে হুজুর এভাবেই জীবন কাটাচ্ছে আমি কি ভাবে নতুন জামা পড়ব। প্রায় রাতই আল্লাহর নাম নিতে নিতে রাত শেষ করে ফেলে আবু। এই হল আমার প্রেম কাহিনী……।
ভাল কথা আপনারা কি কেউ সৈয়দ আবদুল রহমান নামে কাউকে কোন মসজিদে দেখছেন? কি বললেন কেমন দেখতে……কেন বলি নি? প্রায় ষাট বছরের মত বয়স। লম্বায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। মুখের দাড়ি প্রায় বুক পর্যন্ত এসে ঠেকছে। আর ছিল তার চোখ। আজব রকমের এক প্রশান্ত চোখ। এই রকম দীঘীর জলের মত শান্ত পবিত্র চোখ আমি কারো দেখিনি, জাগতিক মোহ থেকে মুক্ত না হলে এই ধরনের প্রশান্তি চোখে থাকেনা। কাধে একটা ঝোলা, আর গায়ে ছিল একটা হাটু পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবী যে পাঞ্জাবীতে কমপক্ষে পনের ষোলটা সেলাই দেয়া। যদি দেখেন খবরদার কিছু বলবেন না কিন্তু উনাকে…… আমাকে আস্তে করে জানবেন আমি আর একবার ওনার পেছনে দাঁড়িয়ে নামায পড়ব।
হজুর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু আমাদের বুক এখনো ভরে থাকে যখনই আমরা ওনার গল্প বলি। আমরা তাকে দেখেছি, আপনিও কিন্তু খেয়াল রাখবেন………
এটি আমার গল্প লেখার দ্বিতীয় প্রয়াস। প্রথম গল্প জাতিস্মর
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ৭:৫৭