সময়টা ১৯৯৩ সালের দিকে, জাকির গ্রুপ পূর্নতা পেয়ে গেল। জাকিরের সাথে যোগ হল তার বন্ধু সূর্যসেন হলের সেক্রেটারি মামুন। মামুন, জাকির ছিল আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র। কিন্তু চেইন অভ কমান্ড অনুযায়ী জাকির ছিল বস। জাকির তার গ্রুপের ছেলেদের কাছে পীর হিসাবে মান্য হত। আমি নিজে দেখেছি এক ছেলে জাকিরের নামে কি যেন বলল জাকিরের এক লেফটেন্যান্ট আড়াল থেকে তা শূনে ফেলে এরপর ওই ছেলের কপালে নেমে আসে সীমাহীন নির্যাতন।
জাকিরের পরে যাদের অবস্থান ছিল, তারা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল তাদের নাম কিং খালেদ (মুজিব হল), গুরু রুনু (এফ রহমান হল), ডন ( জহুরুল হক হল), টিটু (মহসিন হল), ডগ শিশির (মহসিন হল), মিলন (এফ এইচ হল)। অবস্থান গত ভাবে জাকিরের পরেই ছিল রুনু আর খালেদ। রুনু ছিল ওই সময়ের খুব টাফ ফাইটার। ভীষন একটা শীতল ছেলে। সারাক্ষন তার একমাত্র কাজ ছিল রাইফেলগুলো ঘষা মাজা করা। চোখ দুটো ছিল সাপের মত। শীতল। খালেদ ছিল সবচেয়ে হ্যান্ডসাম। ভীষন ষ্টাইলিশ। ১৯৯২ সালে ছাত্র লীগের সাথে এক ফাইটে রাইফেল হাতে গুলি করা অবস্থায় ওর ছবি এসেছিল জনকন্ঠ পত্রিকায়। খালেদ ছিল কেমিষ্ট্রির ছাত্র। মিলন ছিল ম্যাথ এর ছাত্র।
এদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারনে এক সময় আমার কপালেও দূর্ভোগ নেমে আসে। আমি তখনও মুজিব হলে যদিও আমি জিয়া হলে অ্যাটাচড। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ততদিনে আবার রতন গ্রুপ ধীরে ধীরে মুজিব হল দখল করে নেয়। জাকির গ্রুপের সবাই তখন জিয়া হলে। আমি তখন মুজিব হলের ২১৯ এ থাকি।
একদিন সন্ধ্যায় দেখলাম মুজিব হলের সেক্রেটারি জুলমত ৭ জন ছেলে নিয়ে আমার রুমে এসে সরাসরি এক টা ৩০৩ কাটা রাইফেল আর একটা কাটা শটগান আমার দিকে তাক করে পরিস্কার গলায় হুকুম করে এখনই মুজিব হল ছেড়ে দিতে হবে। এর মধ্যে একজন রাইফেলের কক করে বসল আমার পায়ের দিকে তাক করে। তখন পায়ে গুলি করা খুব কমন একটা রেওয়াজ ছিল। বিভিন্ন কারনে ওরা আমাকে সেটা করল না আমিও সুরসুর করে বের হয়ে একদম জিয়া হলে যেখানে আমার বন্ধুরা ছিল। পরে গোপনে অন্যদের দিয়ে আমার বেডিং নিয়ে আস লাম জিয়া হলে।
খালেদ রুনু, মিলন, ডন, টিটু, ডগ শিশিরের পরে ছিল আসাদ, জাহিদ, অরিফ, সুজন, নান্না, পলাশ, শিমুল। ভার্সিটিতে এরা উপরে উল্লেখিতদের পরের ব্যাচে পড়াসুনা করত। আমি নিজে দেখছি ওই সময় এই সব ক্যাডারদের হিরোজিম ছিল ব্যাপক। ক্যাম্পাস দিয়ে এর যে পাশ দিয়ে যেত সাধারন ছাত্র ছাত্রীরা অন্য পাশ দিয়ে যেত। ক্যাম্পাসের যে কোন ক্যান্টিন ছিল এদের জন্য ফ্রি।
অরুন দা মধুদার ছেলে এক অসামান্য চরিত্র। একদিন লিখব দাদা কে নিয়ে। সবার সাথেই খুব ভাল ব্যাবহার করত। কিছুদিন আগে অরুনদার সাথে দেখা করতে গেলাম অনেক কথা হল, অরুন দা সেই পূর্বের মত তার কাউন্টারে নিয়ে ঘন্টা খানেক আড্ডা দিল আমার সাথে।বলল দাদা বৌদি কে নিয়ে আসবেন। কেন যেন দাদা আমাকে খুব ভাল জানতেন এখন ও জানেন। আপনাদের জন্য একটা ইন্টারেষ্টিং তথ্য জানেন কিনা দেখুন। প্রতিদিন রাতে মধুর ক্যান্টিনের বয় বেয়ারাদের বিচার সভা হয় সারা দিনে কে কয়টা কাপ ভাঙ্গছে, কার নামে কাষ্টমার অভিযোগ দিছে এগুলোর দিনের বিচার দাদা রাতে করে। শাস্তি অনুযায়ী কারো কারো কপালে চড় চাপ্পড় জুটত।
জাকির ছিল বিরাট ফাউল। ও ফাউল জাকির নামেও পরিচিত ছিল ক্যাম্পাসে। একটা ঘটনা এখনো মনে আছে ততকালীন বিমান প্রতিমন্ত্রীর মেয়ে মনে হয় নাম ছিল মেহনাজ ( স্মৃতি যদি ভুল না করে)। অহংকারী আর দেমাগী হিসাবে পরিচিত ছিল। একদিন ওই মেয়ে জাকিরের এক ছোট ক্যাডারকে গালি দিয়ে বসল। জাকিরের হাতে ছিল এয়ারগান। ক্যাম্পাসে তখন এয়ারগান দিয়ে বেলুন ফুটো করার খেলা চলত। ওই মেয়ের পেছনে কোমড়ের নীচে (আমি খুব ভদ্র ভাবে বললাম) গুলি করে দিল। দূর থেকে ঠিক নিশানায় লাগল। মেয়ে যতনা আঘাত পেল কিন্তু লজ্জা পেল তার থেকে বেশী। এরপর অনেক দিন ওই মেয়ে ক্যাম্পাসে আসেনি।
এই গ্রুপ যখনি ক্যাম্পাসে যেত কমপক্ষে ৪/৫ টি রাইফেল সাথে থাকত। অস্ত্র গুলি আলাদা ক্যারি করা হত। হলে অতিরিক্ত অস্ত্র লুকানোর জায়গা হিসাবে ব্যবহৃত হত লন্ড্রী আর ক্যান্টিন। জিয়া হলে এদের মুল কক্ষ ছিল ২২১। এ ছাড়া আরো ২/৩ টি রুম ছিল। আমি জিয়া হলে জায়গা পেলাম ৫২৩ এ। ৫২৩ এ আমার রুম মেট ছিল মঞ্জু এখন এডিশনাল ডিষ্ট্রিক্ট জজ, ইউসুফ ভাই বিসিএস দিয়ে এখন ADM। দেলোয়ার ভাই ব্রাক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার।
যাই হোক ক্যাডারদের কথা বলি। আমি হলে ক্যাডারদের বন্ধু হিসাবে কখন ও আমাকে কোন মিছিল মিটিং য়ে যেতে হয়নি। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার পর হলে মিছিল হত দেখতাম খালেদ, মিলন বা রুনু কোমর থেকে রাইফেল বের করে ফাকা আওয়াজ করছে, সব রুম থেকে ছেলেরা উৎসবের আমেজে হলের করিডোরে নেমে আসল। স্লোগান শুরু হয়ে যেত ক্যাডার বা কোন রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে “অস্ত্র শিক্ষা একসাথে চলবে না, চলবে না” বলে। হায় সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ তার থেকেও বিচিত্র এই দেশের মানুষ।
১৯৯৬ সালে নির্বাচন চলে আসল। আমি জীবনের প্রথম ভোট ওইবার দেই। তার কিছুদিন আগে খালেদা জিয়া মাগুরার বিতর্কিত উপনির্বাচনে তার দল কে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে পাশ করিয়ে আনে। আমার ভীষন খারাপ লাগল। ইউ ল্যাব স্কুলে ভোট দিয়ে জিয়া হলে সমস্ত ক্যাডার বন্ধুদের পরিস্কার করে জানালাম আমি আমার ভোট কিন্তু নৌকায় দিয়ে এসেছি।
খালেদ লাফ দিয়ে উঠল, “মানে, কি বলছিস তুই?”
“শোন খালেদ আমি রাজনিতি করি না তোদের পছন্দ করি, সত্যি কথা তোদের সাথে থাকতে থাকতে ছাত্রদলের প্রতি একটা দূর্বলতা এসেছে কিন্তু আমি আমার মাথা বেচে দেই নি। খালেদা জিয়া অন্যায় করেছে তার জবাব আমি ভোটে দিয়ে আসলাম। লাফ দিস না বসে থাক, আমি দেখতে চাই আওয়ামীলীগ কি করে দেশের জন্য”। শান্ত ভাবে বললাম।
পাশ থেকে শুনলাম ডনের হুয়াংকার “তুই বেঈমানী করছিস আমাদের সাথে থেকে আওয়ামীলীগ কে ভোট দিছিস কেন”
“ডন, শের যা করছে ওর বুদ্বিতে করছে, চিল্লাবি না একদম চুপ” রুনুর শীতল গলা আমার পাশ থেকে বলে উঠল।
হ্যা আমি ছাত্রদলের ক্যাডারদের সাথে থেকেও আমি ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ কে ভোট দিয়েছিলাম আর তা প্রকাশ ও করছিলাম। কারন আমি তোদের পছন্দ করি হয়ত তোদের পার্টিকেও কিন্তু আমি কারো কাছে মাথা বেচে দেইনি আমি, আমার দেশের জন্য যাকে ভাল মনে করব তাকেই ভোট দেব। আমার কাছে আমার দেশ সবার আগে। কিন্তু এখন আমি ভাবি কাকে ভোট দেব? আমার দেশে ভাল কেউ নেই, আমাকে পছন্দ করতে হবে দুইটা খারাপের মধ্যে কোনটা কম খারাপ। (চলবে)
পরের পর্ব সমুহঃ
আমার দেখা ঢাকা ভার্সিটির অস্ত্রবাজরা - ৩য় পর্ব
আমার দেখা ঢাকা ভার্সিটির অস্ত্রবাজরা -শেষ পর্ব