গত কিছুদিন ধরে খুব হৈ চৈ হচ্ছে আগামীকাল পৃথিবী ধবংস হয়ে যাবে। যাক তা নিয়ে মাথ না ঘামাই। যে হেতু কালকে পৃথিবীর শেষ তাই আসুন জেনে নেই পৃথিবীর শুরুটা কেমন ছিল
নক্ষত্র-বিশারদরা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন, বহু বছর আগে আমাদের পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহ সূর্যেরই একটি অংশ মাত্র ছিল। আর সূর্য তখন ছিল ভয়ঙ্কর উত্তপ্ত জ্বলন্ত একটি অগ্নিপিণ্ড মাত্র। তারপর যেভাবেই হোক, সূর্যের থেকে এর কিছু অংশ বিচ্যুত হয়ে গিয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়লো বায়ুতে। কিন্তু পিতা সূর্যকে ছেড়ে যেতে তারা পারলো না। তাই ঠিক যেন একই সুতায় গাঁথা মালার পুঁতির মতো সেই অংশগুলো আবদ্ধ হয়ে রইলো_ শুরু হলো তাদের সূর্যকে ঘিরে পথপরিক্রমা। পুরো হল আমাদের পৃথিবীর ভূমিষ্ট হাবার পালা।
সৃষ্টির প্রথম অবস্থায়, আমাদের এই পৃথিবীটাও ছিল প্রচণ্ড উত্তপ্ত বাষ্পে পরিপূর্ণ। কিন্তু বিশাল সূর্যের তুলনায় তো আকৃতিতে তা অনেক ছোট! তাই একটু একটু করে শীতল হতে শুরু করলো। তারপর ভয়ঙ্কর উত্তপ্ত বিরাট সূর্যের তাপও আস্তে আস্তে কমে এলো_ কিন্তু তাই বলে তা দু'চার হাজার বছরে সম্ভব হয়নি, লেগেছিল কোটি কোটি বছর।
সেই তুলনায় ঠাণ্ডা হতে আমাদের পৃথিবীর নিশ্চয় অনেক কম সময়ই লেগেছিল। সৃষ্টির সেই ঊষালগ্নে, যেদিন আজকের এই পৃথিবীটা ছিল শুধু জ্বলন্ত এক অগ্নিপিণ্ড সেদিন এর বুকে_ না মানুষ, না পশুপাখি, না গাছপালা; কোনো কিছুর পক্ষে বাস করা সম্ভব হয়নি। কেমন করেইবা হবে! সামান্য গ্রীষ্মকালেই যদি তাপমাত্রা একটু বেড়ে যায়, তো আমাদের অবস্থাটা এখানে কী হয় ভেবে দ্যাখেন তো? তাহলে কল্পনা করতে পারেন সেই জ্বলন্ত অগি্নবলয় থেকে খসে যাওয়া, সেদিনের এই পৃথিবীরূপী এক টুকরো অঙ্গারের ভয়াবহ উত্তাপের কথা!
সূর্যের একটি কণিকা থেকে যেমন সৃষ্টি হলো আমাদের পৃথিবী তেমনি আবার পৃথিবীর একটি টুকরো থেকে জন্ম নিলো চাঁদ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছোট-বড় অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে চাঁদকেই মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে আপন। এবার বিজ্ঞানীরাও সুর মেলালেন কথাটির সঙ্গে। বলছেন, সেই পৃথিবী থেকেই চাঁদের সৃষ্টি।
চাঁদের সৃষ্টি নিয়ে এই তত্ত্ব নতুন। তত্ত্বটি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী সারাহ্ স্টুয়ার্ট ও মাটিজা। তাঁদের গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশ করেছে বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স। তাঁরা বলছেন, চাঁদ একসময় পৃথিবীর অংশ ছিল। পরে মহাজগতের অন্য একটি বড় বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষে পৃথিবীর একটি অংশ ছিটকে পড়ে চাঁদের সৃষ্টি।
নতুন গবেষণাটি পৃথিবী ও চাঁদের উৎপত্তির ব্যাপারে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব থেকে ভিন্ন। প্রচলিত তত্ত্ব হচ্ছে, পৃথিবীতে সবেগে আছড়ে পড়া বিশাল কোনো বস্তুর উপাদান থেকে চাঁদের জন্ম।
সারাহ্ স্টুয়ার্ট ও মাটিজার দাবি, চাঁদের যখন সৃষ্টি হয়, পৃথিবী তখন অনেক বেশি দ্রুত গতিতে আবর্তিত হতো। একটি দিন মাত্র দু-তিন ঘণ্টা স্থায়ী ছিল। পৃথিবী ও চাঁদের গাঠনিক ও রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে মিল থাকার বিষয়টি ব্যাখ্যা করবে তাঁদের এই তত্ত্ব।
এ বিষয়ে হার্ভার্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়া ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, দ্রুত গতিতে পৃথিবীর আবর্তনের কারণে মহাজগতের কোনো ভারী বস্তুর সঙ্গে তার সংঘর্ষ হয়। এই বড় ধরনের সংঘর্ষ থেকে চাঁদের সৃষ্টি হয়।
যাই হোক, আমাদের পৃথিবীটা তো দিব্যি ঠাণ্ডা হতে শুরু করলো। অবশ্যই তা বহু বছরের সাধনার ফল। আর বাইরেটা যদিওবা আস্তে আস্তে একটু একটু করে ঠাণ্ডা হলো, কিন্তু এর ভেতরের দিকটা প্রচণ্ড উত্তপ্তই রয়ে গেলো। তার প্রমাণস্বরূপ আজও যদি আপনি কোনো কয়লার খনির ভেতরে নামেন তো অনুভব কর্বেন ভয়ঙ্কর গরম। আর যতই গভীরে নামবেন ততই দেখবে্ন উত্তাপও ক্রমেই বাড়ছে। এ থেকেই কি কথাটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না_ পৃথিবীর গভীর প্রদেশ আজও জ্বলন্ত ও উত্তপ্ত!
চাঁদ তো আকৃতিতে আমাদের পৃথিবীর চেয়ে অনেক ছোট, তাই পৃথিবীর চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি তা শীতলও হয়ে গেলো। তাই তো চাঁদের নামকরণ করা হয়েছে শীতল চাঁদ!
তারপর একদিন পৃথিবী শীতলতা প্রাপ্ত হলো। বায়ুতে আর্দ্রতা অর্থাৎ জলীয় বাষ্প আছে, তা ক্রমেই ঠাণ্ডায় গাঢ় হতে হতে জলে পরিণত হলো, আর সম্ভবত তা একদিন বৃষ্টি হয়ে আবার এই পৃথিবীর বুকেই ঝরে পড়লো। সে বৃষ্টি অবশ্য এখন আমরা যে বৃষ্টি দেখি, নিশ্চয়ই তার চেয়ে লাখ লাখ গুণ সাংঘাতিক রকমের ভয়াবহ বৃষ্টি হয়েছিল। সম্ভবত তাকেই আমরা প্রলয় বলে থাকি। কারণ সেই প্রচণ্ড প্রলয়ঙ্কর বারিধারায় পরিপূর্ণ হয়ে গেলো ধরণীর বুকের সব গহ্বর।
পৃথিবী ঠাণ্ডা হওয়ার পর মহাসমুদ্রের জলও ঠাণ্ডা হতে লাগলো আস্তে আস্তে_ তারপর পৃথিবীর কোলে আর মহাসাগরের জলে প্রাণীর পক্ষে বসবাস করা সম্ভব হয়ে উঠলো।
আজ থেকে ৪০০ কোটি থেকে ২৫০ কোটি বৎসর আগ পয’ন্ত পৃথিবীর সমস্ত ভূভাগ এক সাথে ছিল। যা প্যাংগি নামে পরিচিত ছিল। আর সেই মাহদেশকে ঘিরে ছিল আদিমহাসমুদ্র নাম নাম প্যানথালসা।
আজ থেকে ৫২ কোটি বৎসর আগে “প্লেট টেকটোনিক” সুত্রর কারনে ২ ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগের নাম “গন্ডোয়ানা”, যার মধ্যে ছিল আধুনা দক্ষিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারত, অষ্ট্রেলিয়া আর কুমেরু। অন্যটির নাম “লরেশিয়া”, এতে ছিল ইউরোপ, এশিয়া, গ্রীনল্যান্ড এবং ঊত্তর আমেরিকা। মধ্যে ছিল নতুন সাগর যার নাম টেথিস সাগর।
পরে প্লেট টেকটোনিক এর কারনে গন্ডোয়ানা এবং লরেশিয়া ভেংগে ধীরে ধীরে আজকের মহাদেশ, মহাসাগর গুলোর সৃষ্টি হয়। লরেশিয়া থেকে ভেঙ্গে উত্তর আমেরিকা, এশিয়া ইউরোপ আলাদা হয়ে যায়। গন্ডোয়ানা থেকে দক্ষিন আমেরিকা আফ্রিকা আলাদা হয়ে যায়। রুপ নেয় আমাদের পরিচিত পৃথিবী।
চলুন দেখি প্লেট টেকটোনিক থিওরী কি?
ভূ তাত্তিকদের মতে পৃথিবী একটা পাকা আমের মত, উপরে খোসা (পৃথিবী আবরন, crust), মধ্যে থকথকে শাস (গুরুমন্ডল mantle), একদম ভিতরে আটি (কেন্দ্রমন্ডল Core). মহাদেশীয় আবরন continental crust এবং মহাসাগরীয় আবরন Ocenic Crust নামে পরিচিত। এই মহাদেশীয় আবরন এবং মহাসাগরীয় আবরন সব’দাই আবার গুরুমন্ডল (mantle)এ ভাসমান এবং নিয়ত সঞ্চরনশীল। এটাই প্লেট টেকটোনিক এর মূল কথা।
পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের মতোই মঙ্গল গ্রহেরও টেকটোনিক প্লেট রয়েছে। মঙ্গল গ্রহেও যে টেকটোনিক প্লেটের অস্তিত্ব থাকতে পারে এমন ধারণা অনেক দিন থেকেই গবেষকদের মাঝে ছিল। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যান লিন মার্স রিকনাইসেন্স অরবিটার উপগ্রহের তোলা ১০০ টিরও বেশি ছবি বিশ্লেষণ করে মঙ্গলে টেকটোনিক প্লেটের অস্তিত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি মনে করেন, মঙ্গলেরও হিমালয় ও তিব্বতের মতো ফল্ট সিস্টেম বা চ্যুতি এবং ভূমিকম্প উৎপত্তিস্থল রয়েছে। তার মতে, মঙ্গলে মসৃণ গভীর খাদ রয়েছে, যেখান থেকে চ্যুতির সৃষ্টি, যা অনেকটাই ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালির মতো। পৃথিবীর পর সৌরজগতের মধ্যে এ ধরনের বৈশিষ্ট্যে কেবলমাত্র মঙ্গল গ্রহেই পাওয়া গেছে। টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের কারণেই পৃথিবীর মতো মঙ্গলেও ভূকম্পন হয়। তবে মঙ্গলে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ভূমিকম্প হয়।
গবেষকদের মতে, মঙ্গলে টেকটোনিক প্লেটের সংখ্যা মাত্র ২টি। মঙ্গলের এই টেকটোনিক প্লেট কীভাবে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে বর্তমানে আরও গবেষণা করছেন তারা
অমল দাশ গুপ্তের “পৃথিবীর ঠিকানা” বইটি এক টি অসাধারন বই । যেখানে পৃথিবীর সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে একটি অসাধারণ উপস্হাপনা আছে। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে ৪২০ কোটি বছরের ইতিহাস তথা এইপৃথিবীর সৃষ্টি, মানব জগতের আবির্ভাব, পারিপার্শের পূর্ণতা, মানব জাতির আবির্ভাব ইত্যাদি তুলেধরা হয়েছে মাত্র ২৪ ঘন্টার একটি কল্পিত দিবাদৈর্ঘ্যের মাধ্যমে।
মনে করা যাক ৬০ মিনিট সমান ৩০ কোটি বছর, অর্থাৎ প্রতি মিনিট সমান ৫০ লক্ষ বছর। এখন কল্পনা করা যাক ঠিক রাত বারোটার সময় সৃষ্টিহল রহস্যময় এই পৃথিবীর, তখন পৃথিবী একটি আবর্তমান গ্যাসীয় বস্তুপিন্ড। কোথাও কোন প্রাণের চিহ্ন নেই, আর থাকার কথাও নয় কারণ ঐ ঘূর্ণায়মান বস্তুপিন্ডের তাপমাত্রা ছিল আনুমানিক দশ হাজার কোটি সেন্টিগ্রেড। আস্তে আস্তে এই আবর্তমান পৃথিবী শীতল হতে থাকে। এবং এক সময় তরল হতে হতে তা জমাট বেধেছে। তৈরি হয়েছে পৃথিবীর আদিমতম সমুদ্র।
কিন্তু তখনও প্রাণের উৎপত্তি ঘটেনি সেই মহেন্দ্রক্ষণটির জন্য অপেক্ষা করতে হবে ভোর ছয়টা পর্যন্ত । ঠিক ভোর ছয়টার সময় আদিম সমুদ্রে কতগুলো অনুবীক্ষণ বিন্দুকে আশ্রয় করে প্রথম প্রাণের জন্ম হয়। তারপর শিরদাঁরওয়ালা প্রাণীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে পৌনে নয়টা পর্যন্ত। সকাল নয়টায় উভচর প্রাণীরা মুক্ত বাতাস গ্রহণের উদ্দেশ্যে ডাঙায় উঠে আসে। নয়টা আট মিনিটে জন্ম হয় সরীসৃপের, নয়টা তেইশ মিনিটে ডাইনোসরের, নয়টা পঁচিশ মিনিটে স্তন্যপায়ী আর নয়টা তেত্রিশ মিনিটে জন্ম হয় পাখির। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানষ সৃষ্টি হয়েছে পাখি সৃষ্টির ঠিক তেত্রিশ সেকেন্ড পূর্বে।
উৎসগ'ঃ সেই সব ব্লগারদের আজ সকালে যারা আমাকে ভূল শোধরাতে সাহায্য করছেন
কৃতজ্ঞতাঃ জওহরলাল নেহেরু “ মা মনিকে বাবা” বই থেকে।
অমল দাশ গুপ্ত “পৃথিবীর ঠিকানা”
opnews.in/usa/gondwana-supercontinent-underwent-60-degree-rotation-during-cambrian-explosion-25103
http://www.platetectonics.com/book/page_7.asp
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:০৬