প্রথম আলো র পুরানো আক’আইভ খুজতে যেয়ে আবার ও পড়লাম। অনেকে হয়ত আগেই পড়ছেন, যারা পড়েন নি তাদের জন্
কাজী আনোয়ার হোসেন (জন্ম ১৯ জুলাই ১৯৩৬)
কাজী আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের পাঠককে রহস্যসাহিত্যমুখী করেছেন। পাঠকের হাতে বাংলা ভাষায় তুলে দিয়েছেন নানা দেশের নানা ভাষার রহস্য ও রোমাঞ্চকাহিনী। ‘মাসুদ রানা’ তাঁর জনপ্রিয়তম সিরিজ। পিছিয়ে ছিল না ‘কুয়াশা’ও। ১৯৬৪ সালে সেগুনবাগিচার এক ছোট ছাপাখানা থেকে সেবা প্রকাশনীর যাত্রা। এখন এর গ্রন্থতালিকা ঈর্ষণীয়। কত ভালোবাসা-নিন্দা, কত সাফল্য-ব্যর্থতা−সব নিয়ে কথা বলেছেন পাঠকের কাজীদা। তাঁর ৭২তম জন্নবার্ষিকী উপলক্ষে এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আসজাদুল কিবরিয়া
আসজাদুল কিবরিয়া: সম্পুর্ণ মৌলিক কাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল আপনার মাসুদ রানা সিরিজ। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দাকাহিনি বা স্পাই থ্রিলার তখন সম্পুর্ণ অজ্ঞাত একটি শাখা। এ রকম একটি শাখায় জীবনের প্রথম কাজটি কীভাবে করলেন? লেখার প্রক্রিয়াটি একটু বলবেন?
কাজী আনোয়ার হোসেন: কুয়াশা লেখা শুরু করেছি। কয়েকটি বইও বেরিয়েছে। এ সময় মাহবুব আমিনের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব। তিনি বইগুলো পড়ে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের ডক্টর নো বইটি আমাকে দেন। ওটা পড়ার পর বিস্িনত ও লজ্জিত হয়েছিলাম। রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যে বাঙালি লেখকেরা যে কতটা পিছিয়ে আছে, বুঝতে পারলাম। ঠিক করলাম, বাংলাতে ওই মানের থ্রিলার লিখব। শুরু হলো বিভিন্ন বিদেশি বই পড়া। কাহিনী সাজাতে মোটরসাইকেলে করে ঘুরে এলাম চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি। সেটা ১৯৬৫ সালের শেষদিকের কথা। এরপর কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম। কিন্তু লিখতে গিয়ে টের পেলাম, ভাষা নেই। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র আমি। সাহিত্যের ভাষা আসে। এ-ভাষায় থ্রিল-অ্যাকশনের দৃশ্য ছবির মতো ফুটিয়ে তোলা বড়ই মুশকিল। তাই লিখছি, কাটছি, আবার লিখছি, পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলছি, আবার লিখছি। এ ধরনের লেখা বাংলা সাহিত্যে ছিল না। ভাষা ও বিষয় কোনোটিই নয়। সে জন্যই চেষ্টা করতে হলো। চেষ্টা-চর্চায় তৈরি হলো ভাষা। সেবার ভাষা। এর মধ্যে কিছুটা রিপোর্টিং স্টাইল আছে। মানে, সহজভাবে বলার চেষ্টা, তার চেয়ে বেশি দৃশ্যপট পাঠকের চোখের সামনে স্পষ্ট ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা।
এভাবে চেষ্টা ও পরিশ্রম করে সাত মাস ধরে লিখলাম মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ধ্বংস-পাহাড়। ১৯৬৬ সালের মে মাসে বাজারে এল বইটি। প্রশংসা-সমালোচনা, নিন্দা-অভিনন্দন−সবই জুটল। এরপর সিরিজের দ্বিতীয় বই ভারতনাট্যম প্রকাশিত হলো। এটা লিখতে প্রায় ১০ মাস সময় লেগেছিল। বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে লিখছিলাম বইগুলো। পরবর্তী সময়ে মউত কা টিলা নামে ধ্বংস-পাহাড়ের উর্দু সংস্করণও হয়েছিল।
আ. কিবরিয়া: আজও বাংলা মৌলিক থ্রিলার সাহিত্যে ধ্বংস-পাহাড় ও ভারতনাট্যমকে ছাড়াতে পারেনি কোনো বই। তার পর থেকেই আপনি অ্যাডাপটেশন শুরু করলেন। মৌলিক থ্রিলার লেখার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আর কেন ও পথ মাড়ালেন না? গত ৪৪ বছরে আর কখনোই কি ইচ্ছে হয়নি নিজের মতো করে, মৌলিক একটি থ্রিলার বা রানা লেখার?
কা. আ. হোসেন: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘এই যে আপনি অ্যাডাপটেশন শুরু করলেন, আর কখনও মৌলিক লিখতে পারবেন না।’ এটাও বলেছিলেন যে ভালো লেখা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানতাম যে আমি পারব। আর ইচ্ছে তো অবশ্যই রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হয়েছে সময়স্বল্পতা।
আসলে ধ্বংস-পাহাড় ও ভারতনাট্যম প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের কাছ থেকে চিঠির পর চিঠি আসতে থাকল−আরও দ্রুত বই চাই। আর আমি তো বই লিখে ও প্রকাশ করে জীবিকা নির্বাহের কাজটি শুরু করেছি। একজন লোক একাধারে লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক ও ব্যবসায়ী। তাই নিয়মিত প্রকাশনা নিশ্চিত করতে বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে মাসুদ রানা লেখা শুরু। আমি কিন্তু এখানে কোনো রাখঢাক করিনি। তাই আজও বইয়ের গায়ে স্পষ্টভাবে লেখা হয় ‘বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে’। রানার কাহিনী সংগ্রহ করা হয়েছে অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিন, জেমস হেডলি চেজ, রবার্ট লুডলাম, উইলবার স্িনথ, ক্লাইভ কাসলার, হ্যামন্ড ইনস, ডেসমন্ড ব্যাগলি, ইয়ান ফ্লেমিংসহ অসংখ্য লেখকের বই থেকে। কিন্তু এই অ্যাডাপটেশন এতটাই নিজেদের মতো সাজিয়ে করা হয়েছে যে কোত্থেকে কাহিনীগুলো এল তা আর ভাবতে ইচ্ছে করে না। যখন খুশি মূল থেকে সরে গিয়েছি বলেই গিলটি মিয়া, ইদু মিয়া, সোহেল, অনীতা গিলবার্টের মতো চরিত্রগুলোর সৃষ্টি হতে পেরেছে।
আবার, আমার মনে হয়েছে, রানার একটা প্রতিপক্ষ দরকার, ঈর্ষা করার মতো কাউকে দরকার এবং সেটা মেয়ে হলে ভালো হয়। সেই থেকে সোহানার আগমন। মেজর জেনারেল রাহাত খান সোহানাকে অসম্ভব স্েমহ করেন, ভালোবাসেন। রানা ভেতরে ভেতরে ঈর্ষান্বিত হয়ে ভাবে, ‘ঠিক আছে, ও-ই থাক। আমি চলেই যাব।’ আবার সোহানা মনে করে, রানাকেই বিসিআই চিফ বেশি পছন্দ করেন। ফলে দুজনের মধ্যে একটা হিংসাহিংসি কাজ করে। পাঠকদের কারও কারও মধ্যে এ ধারণাও হলো যে সোহানা রানার বউ হতে চলেছে। তাই ‘সোহানা ভাবি’ সম্বোধন করে অনেক চিঠিপত্রও এসেছে। দাবি এসেছে, পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে রানা সোহানাকে নিয়ে যাক। আসলে ওরা দুজন তো সহকর্মী। প্রেমিকা-বান্ধবীও ছিল, কিন্তু যেহেতু দুজনই এসপিওনাজে আছে, সেহেতু ঘর বাঁধতে পারে না।
কখনো কখনো মাসুদ রানার মনটা হঠাৎ বিষণ্ন হয়ে যায়। ওর মনে পড়ে, কবে একটা কবিতা পড়েছিলাম, ‘কাছে এল পূজার ছুটি/রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপাফুলের রং।’ সমুদ্রের ধারে অস্তগামী সুর্য দেখে প্রকৃতির বিশালত্বের কাছে নিজেকে তার খুবই ছোট মনে হয়। জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পায় না। এ ধরনের চিন্তার সঙ্গে বাঙালি যুবকেরই মিল পাওয়া যাবে। জেমস বন্ড বা অন্য কোনো বিদেশি থ্রিলারে এসব থাকে না।
আ. কিবরিয়া: অ্যাডাপটেশনের এই ধারা কি শেষ পর্যন্ত আমাদের রহস্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছে? ভারতের পশ্চিমবঙ্গে খারাপ হোক ভালো হোক, রহস্যসাহিত্যের একটা নিজস্ব ধারা চালু হয়েছে। কারও কাছ থেকে ধার না করেই তাঁরা নিজেদের মতো করে লেখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু, ৪৪ বছর ধরে রহস্যসাহিত্যের চর্চা করার পরও বাংলাদেশে মৌলিক রহস্যসাহিত্যের কোনো বিকাশ হয়নি বললেই চলে। এ বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
কা. আ. হোসেন: বাংলাদেশে মৌলিক রহস্যসাহিত্যের বিকাশ না হওয়ার প্রধান কারণ, আমি বলব, আমাদের অভিজ্ঞতার অভাব; বিশেষ করে স্পাই থ্রিলারের ক্ষেত্রে। আমাদের তো এসপিওনাজের তেমন কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। ইয়ান ফ্লেমিং নৌবাহিনীর ইন্টেলিজেন্সে ছিলেন। অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিনও ছিলেন গুপ্তচর, যুদ্ধেও গেছেন। সমারসেট মমও গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন। এ রকম আরও অনেক বিদেশি লেখক ছিলেন ও আছেন, যাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও বিস্তর পড়াশোনা আছে। আমাদের তা কোথায়?
আর রহস্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার কথা বলছ? আমি তো মনে করি, পাঠক কিছুটা সমৃদ্ধ হয়েছে অ্যাডাপটেশনের ফলেই। একটা জমজমাট কাহিনিকে যতখানি সম্ভব বাঙালি পাঠকের উপযোগী করে পরিবেশন করা হচ্ছে। অসংখ্য অজানা তথ্য জানতে পারছে পাঠক। তার পরও অবশ্য কিছু ভুলত্রুটি থেকে যায়। একবার এক সেনা কর্মকর্তা চিঠি লিখে জানালেন, মাসুদ রানা সিরিজের কোনও এক বইতে বোমা বিস্কোরণের পদ্ধতির যে বর্ণনা দিয়েছি তা ভুল। তিনি সঠিক পদ্ধতিটি বিস্তারিত লিখে পাঠালেন।
পশ্চিমবঙ্গে মৌলিক রহস্যসাহিত্য লেখার চেষ্টা হচ্ছে ঠিকই, তবে তার মান যে খুব উঁচু, তা আমি বলব না। অল্প কিছু নিঃসন্দেহে ভাল, কিন্তু বেশিরভাগই ছেলেভোলানো, জুজুর ভয় দেখানো সাদামাটা কাহিনি। তাঁরা মৌলিকত্বের দাবি করলেও, জেনে রাখো, ওখানেও প্রচুর অ্যাডাপটেশন হয়েছে ও হচ্ছে। শশধর দত্তের দস্যু মোহন তো দ্য সেইণ্ট-এর ছায়া অবলম্বনে। আর্থার কোনান ডয়েলের কাহিনি এদিক ওদিক করে নিয়ে নীহাররঞ্জন গুপ্ত কত কীই না লিখেছেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ঝিন্দের বন্দী লিখেছেন প্রিজনার অব জেন্ডা অবলম্বনে। কিন্তু কেউ স্বীকার করেননি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদ্মানদীর মাঝি লেখার আগে পদ্মাপারের জেলেদের সঙ্গে মাসের পর মাস কাটিয়েছেন। আমরা কয়জন পারব ও রকম পরিশ্রম ও একাগ্রতায় কাজ করতে? এভাবে বাণিজ্যিক লেখা সম্ভব নয়।
আ. কিবরিয়া: আমরা জানি, একাধিক গোস্ট লেখক মাসুদ রানা লেখেন। এঁদের নাম বলবেন কি? বই নির্বাচন থেকে পুরো লেখার প্রক্রিয়াটি একটু বলুন।
কা. আ. হোসেন: আড়ালে থেকে মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজের বই যাঁরা লিখেছেন তাঁদের অনেককেই তুমি চেনো। বিভিন্ন সময় যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা কমবেশি প্রাপ্তিযোগের প্রত্যাশাতেই লিখেছেন। তাঁরা সবাই বড় লেখক। অন্যের নামে লিখলেও নিজের নামে বই লেখার ক্ষমতা যে তাঁদের নেই, এমন তো নয়। তাঁদের নাম বলে দিয়ে তাঁদের প্রতি অবিচার করা কি ঠিক হবে?
যিনি রানার কাহিনি লিখতে আগ্রহী, তিনি প্রথমে কোনো একটি ইংরেজি বইয়ের কাহিনি সংক্ষেপ জমা দেন। কাহিনি পছন্দ হলে আলোচনার মাধ্যমে তাঁকে বুঝিয়ে দিই কীভাবে কাহিনি এগোবে, রানা কীভাবে আসবে, কী করবে ও কী করবে না। মাসখানেক পরিশ্রমের পর তাঁর লেখা শেষ হয়, তখন পান্ডুলিপিটি আমি পড়ি। যেসব জায়গায় সংশোধন ও পরিবর্তনের প্রয়োজন, সেগুলো চিহ্নিত করে টীকাসহ লেখককে ফেরত দিই। তিনি আবার ঠিকঠাক করে দিলে চুড়ান্তভাবে আর একবার দেখি ও সম্পাদনা করি। এসবে আমার লেগে যায় পনেরো দিনের মতো। তার পরই রানা বই আকারে ছাপা হয়।
আ. কিবরিয়া: কোনো লেখকের পান্ডুলিপিই সম্পাদনা ছাড়া সেবা প্রকাশনী থেকে বই হিসেবে প্রকাশিত হয় না। এ জন্য একটি সম্পাদকমন্ডলীও আছে। সম্পাদনার বিষয়টি কেন গুরুত্বসহকারে নিয়েছিলেন?
কা. আ. হোসেন: সম্পাদনার প্রয়োজন আছে। সবার লেখাতেই ভুল-ভ্রান্তি থাকে, আমারটাতেও। একজনের লেখা আরেকজন পড়লে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি শুধরে যায়। কিন্তু আমার পক্ষে একা সব পান্ডুলিপি দেখা ও সংশোধন করা একটা পর্যায়ে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অথচ ভাষাসহ বইয়ের সার্বিক একটা মান ধরে রাখা প্রয়োজন। সে জন্যই সম্পাদক খুঁজতে হলো। তবে এখন আর সেভাবে সম্পাদনা হচ্ছে না। যে পারিশ্রমিক দিতে পারি, তাতে কেউ সম্পাদনা করতে আগ্রহী নন। আবার কাজটা সম্পাদনানির্ভর থাকলে লেখকও যথেষ্ট যত্নবান হন না। কেউ কেউ আবার অন্যের সম্পাদনায় সন্তুষ্টও হতে পারেন না। তাই এখন সেবায় রানা ও তিন গোয়েন্দা ছাড়া অন্য লেখা যিনি লিখছেন, তাঁকে যথেষ্ট শ্রম দিয়ে নির্ভুলভাবে লেখার চেষ্টা করতে হচ্ছে। আমি চোখ বুলিয়ে দিই। তবে বই প্রকাশ হওয়ার পর পাঠকের প্রতিক্রিয়াই লেখকের পরবর্তী বই ছাপা হবে কি হবে না, তা নির্ধারণ করে। একসময় যাঁরা পান্ডুলিপি সম্পাদনা করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন কবি আবু কায়সার, কবি সাযযাদ কাদির, রওশন জামিল, আসাদুজ্জামান, সেলিনা সুলতানা, ইফতেখার আমিন, কাজী শাহনুর হোসেন প্রমুখ।
আ. কিবরিয়া: মাসুদ রানা সিরিজের সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর নাম বলবেন?
কা. আ. হোসেন: শত্রু ভয়ংকর, বিস্নরণ, মুক্ত বিহঙ্গ, আই লাভ ইউ, ম্যান ও অগ্নিপুরুষ।
আ. কিবরিয়া: মাসুদ রানার মাধ্যমে আপনি কিছুটা খোলামেলা যৌনতা নিয়ে এলেন। রক্ষণশীল সমাজে এটা তো অনেক বড় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল। সমালোচনা সামলেছেন কীভাবে?
কা. আ. হোসেন: কাহিনিতে চাটনি বা বাড়তি মজা হিসেবেই মাসুদ রানায় যৌনতা এসেছিল। এ নিয়ে চারদিক থেকে সবাই যেভাবে মার মার করে উঠেছিল তাতে মনে হতে পারে, বাংলা সাহিত্যে আগে কখনো যৌনতা ছিল না। যাঁরা নিজেদের বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক ও অভিভাবক মনে করতেন, তাঁদের ভেতর থেকেই প্রতিবাদ-সমালোচনা বেশি এসেছিল। অথচ সুলেখক সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখায় যৌনতার ছড়াছড়ি ছিল। আমি যে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ উল্লেখ করে দিয়েছি, সেটাও আমার দোষ হলো। উল্টো বলা হলো, এ জন্যই ছোটরা আরও বেশি পড়ে। সেই নিষিদ্ধ আপেলের প্রতি স্বভাবজাত আকর্ষণ!
মাসুদ রানার তৃতীয় বই স্বর্ণমৃগ প্রকাশিত হওয়ার পর সচিত্র সন্ধানী পত্রিকায় তীব্র সমালোচনা বেরোয়। তাতে লেখা হলো, কলম কেড়ে নিয়ে আমার হাতে আগুনের সেঁকা দেওয়া ও পল্টন ময়দানে বেঁধে জনসমক্ষে আমাকে চাবুক মারা দরকার। আমি তখন সচিত্র সন্ধানীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করলাম। জিততে পারিনি অবশ্য। তারা তখন প্রভাবশালী বন্ধু-বান্ধবের সহায়তায় আমার বইটিকেই সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়ে দিয়েছিল।
আসলে মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম দিকের বইগুলোয় যতটা যৌনতা ছিল, পরের দিকে তা অনেক কমে গেছে। রানা সিরিজের প্রায় ৪০০ বইয়ের মধ্যে প্রথম ১৫-১৬টায় একটু বেশি পরিমাণে থাকলেও পরের বইগুলোয় তা আছে নামমাত্র। একটা পর্যায়ে আমি নিজেই উপলব্ধি করলাম, আমরা একটা ধর্মভীরু ও রক্ষণশীল সমাজে বাস করছি, যেখানে আদিরসের উপস্িথতি একটি আঘাত। যারা পড়ছে, তারা লুকিয়ে পড়ছে। তাই আমি চাটনি কমিয়ে দিলাম। অনেক পাঠক এ জন্য অভিযোগ করেছেন যে, আমি তাঁদের বঞ্চিত করছি। আমি এখনও মনে করি, রস হিসেবে রানায় যৌনতার উপস্িথতি থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সামাজিক পরিমন্ডলটাও বিবেচনা করতে হয়। আর এখন তো মনে হয়, আশপাশে যেভাবে গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের দাপট বেড়েছে, তাতে ও পথে আর যাওয়াই যাবে না। তবে এটাও আমি জোর দিয়ে বলি যে, শুধু যৌনতা দিয়ে পাঠক টানার চেষ্টা আমি করিনি। কাহিনীর বৈচিত্র্য, অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য, রোমাঞ্চই রানাকে যুগের পর যুগ পাঠকপ্রিয়তা দিয়েছে।
আ. কিবরিয়া: অনেকেই তো আপনাকে উৎসাহ দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন।
কা. আ. হোসেন: কবি আহসান হাবীব একসময় আমাকে প্রচুর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি আধুনিক ও মুক্তমনের মানুষ ছিলেন। রানা লেখার পর যখন খুব সমালোচনা হচ্ছে, তখন তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, ‘যে যা বলে বলুক, আপনি চালিয়ে যান।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সুসাহিত্যিকেরা লিখুক তো একটা ধ্বংস-পাহাড়! অতখানি খাটুনি করতেই পারবে না।’ তিনি আমার লেখা ছেপেছেন দৈনিক বাংলায়। স্েমহভাজন শাহরিয়ার কবির আমাকে দিয়ে গল্প লিখিয়েছে বিচিত্রায়। গল্প লিখতে আমি খুব আনন্দ পেতাম। কাজী মোতাহার হোসেন, অর্থাৎ আব্বুর উৎসাহও ছিল। তিনি আমাকে অনুবাদ করতে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই কিছু অনুবাদ কর। তোর হাতে ভালো আসবে।’ আসলে মাসুদ রানা লেখার পর যে তীব্র সমালোচনা হতে থাকল, তাতে তিনিও বোধ হয় একটু বিচলিত হয়েছিলেন। সুফিয়া কামাল অনেককেই বলেছিলেন, ‘নওয়াবকে ধরতে পারলে পিট্টি লাগাব।’ হ্যাঁ, উৎসাহ পেয়েছি আমার প্রয়াত সেজো বোন খুরশীদা খাতুনের কাছে। সেই স্কুলের ছাত্রাবস্থায় আমার বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখার গোড়াতে পরিচর্যার কাজ করেছিলেন তিনি।
আ. কিবরিয়া: সেবা প্রকাশনীর বইয়ের শেষে আপনি ‘আলোচনা বিভাগ’ চালু করলেন। এটাকে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর একটি মাধ্যম হিসেবে এনেছিলেন আপনি। এ ধারণাটি কীভাবে মাথায় এসেছিল?
কা. আ. হোসেন: রানা নিয়ে যখন তুমুল নিন্দা-সমালোচনা ও পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, তখন ভাবলাম, আমারও কিছু বলার কথা আছে; বিশেষ করে পাঠকের কাছে। প্রচুর চিঠি আসছিল। তাই চালু হলো ‘আলোচনা বিভাগ’। পাঠকেরা আমাকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন, সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছেন। রানার প্রথম দিকের বইগুলোর প্রথম সংস্করণ উল্টে দেখলে তুমি এর প্রমাণ পাবে। এর মাধ্যমে আমি পাঠকের আরও কাছে পৌঁছলাম। পাঠকেরা বিভিন্ন মুডে চিঠি লিখতেন, প্রশ্ন করতেন। অনেক বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন পেয়েছি, পেয়েছি চমৎকার পরামর্শ। সমালোচনাও এসেছে। আমিও বিভিন্নভাবে সে-সবের জবাব দিয়েছি।
আ. কিবরিয়া: মাসপয়লা নামে যে পত্রিকাটি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, সেটাই তো রহস্যপত্রিকায় রূপ নিল। শুরুটা কীভাবে হলো?
কা. আ. হোসেন: সাংবাদিক রাহাত খানের তাগাদায় এটি প্রকাশের পরিকল্পনা হয়। হাশেম খান, রনবী (রফিকুন নবী), শাহরিয়ার কবির ও আরও অনেককে নিয়ে আলোচনায় বসলাম সেবা প্রকাশনীতে। আজকের সেগুনবাগিচায় যে জায়গাটিতে তিনতলার ওপরে লাইব্রেরিতে কাজ করি, ১৯৬৯-৭০ সালে সে জায়গাতেই ছোট একটি টিনের ঘরে ছিল সেবা প্রকাশনীর কার্যালয়। আমি নাম দিতে চেয়েছিলাম মাসপয়লা, কিন্তু অন্যদের তা অপছন্দ। সম্ভবত রনবী বললেন, ‘রহস্য-রোমাঞ্চ নিয়ে যখন হচ্ছে, তখন এর নাম রহস্যপত্রিকাই হোক।’ সেটাই হয়ে গেল। হাশেম খান নামের লোগো-নকশা করলেন। ওই সময় তিনি নিয়ে এলেন অধুনালুপ্ত বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীকে। তিনি ‘শাচউ’ নামে লেখা শুরু করেছিলেন রহস্যপত্রিকায়। রাহাত খান ইত্তেফাক-এ যোগ দেওয়ায় আর তেমন সময় দিতে পারেননি। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে রহস্যপত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এতে লিখেছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, বুলবন ওসমান, মাহবুব তালুকদার, সাযযাদ কাদির, আবু কায়সার, বুলবুল চৌধুরী, রনবী, খোন্দকার আলী আশরাফ প্রমুখ।
শাহরিয়ার কবির ছিলেন সহযোগী সম্পাদক। তিনি নিয়ে এসেছিলেন সাযযাদ কাদির, হুমায়ুন কবির ও মুনতাসীর মামুনকে। পরবর্তী সংখ্যাগুলোয় লিখেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও লায়লা সামাদ। ওই সময়টা বড়ই জমজমাট ছিল। চারটি সংখ্যা বের হওয়ার পর অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলে রহস্যপত্রিকার প্রকাশনা স্থগিত হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর সবাই বিভিন্ন কাজে বিভিন্নভাবে ব্যস্ত হয়ে গেল। শাহাদত চৌধুরী বিচিত্রায়, শাহরিয়ারও ওখানে। কারও হাতে সময় নেই। এক যুগের বেশি সময় পরে তিন গোয়েন্দা সিরিজের লেখক রকিব হাসান রহস্যপত্রিকা বের করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। তাঁর প্রবল উৎসাহে তাঁকেসহ নিয়মিত উপন্যাস লেখক শেখ আবদুল হাকিম ও নিয়মিত অনুবাদক নিয়াজ মোরশেদকে সহকারী সম্পাদক করে ১৯৮৪ সালে নতুন উদ্যমে রহস্যপত্রিকার প্রকাশনা আরম্ভ হয়। আসাদুজ্জামান হলেন শিল্প সম্পাদক। তিনি হাশেম খানের নকশাটি খানিকটা অদলবদল করে রহস্যপত্রিকার নামের লোগোটা করলেন। আসাদুজ্জামান বছরখানেক পর বিসিএস করে সরকারি চাকরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় চলে গেলেন। তখন কিছুদিনের জন্য দায়িত্ব নিলেন সিরাজুল হক। তারপর যোগ দিল শিল্পী ধ্রুব এষ। শেখ আবদুল হাকিম, রকিব হাসান বা নিয়াজ মোরশেদ কেউই এখন আর রহস্যপত্রিকার সঙ্গে নেই। সে জায়গায় এসেছে কাজী শাহনুর হোসেন ও কাজী মায়মুর হোসেন।
আ. কিবরিয়া: কেউ কেউ বলছেন সেবার অনুবাদের মান পড়ে যাচ্ছে। বাস্কারভিলের হাউন্ড, রিটার্ন অব শি, থ্রি কমরেডস, অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট-এর মতো ক্লাসিকগুলোর যে চমৎকার অনুবাদ পাঠক পেয়েছে, এখন আর সে রকম পাচ্ছে না। নিয়াজ মোরশেদ, আসাদুজ্জামান, জাহিদ হাসানের মতো ধারালো অনুবাদককেও তো আর সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না।
কা. আ. হোসেন: এঁরা নামকরা ভাল ভাল বইগুলো অনুবাদ করে এখন যার-যার পেশায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। নতুন লেখক আসছেন, এঁরাও ভাল অনুবাদক; কিন্তু পরে এসেছেন বলে ভাল বইগুলো ফসকে গেছে। এখন দশ হাতে কাজ হচ্ছে। ফলে মান একরকম রাখা তো সম্ভব নয়। তাই অভিযোগ কেউ করতেই পারেন। আমি শুধু বলব, তুলনাটা হচ্ছে কীসের সঙ্গে কীসের, সেটাও বিবেচনা করতে হবে। কাহিনির সঙ্গে কাহিনির, না কি অনুবাদকের সঙ্গে অনুবাদকের? এখন লেখার ধারায় পরিবর্তন এসেছে। ভিন্ন স্বাদের অনুবাদ হচ্ছে। সবাই ব্যস্ত। দুনিয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। রুটিরুজিও কঠিন।
আ. কিবরিয়া: সেবার ব্যবসাপদ্ধতি ও লেখক সম্মানীর যে ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ৪০ বছর আগে, তা আজও প্রায় একই রকম আছে। বাকির কারবার নেই। কমিশন সুনির্দিষ্ট। লেখকের ত্রৈমাসিক কিস্তি আছে। ১৫-২০ বছর পরও লেখক এসে তাঁর জমে থাকা অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে সেবা বা প্রজাপতির পক্ষে এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা শেষ পর্যন্ত কি সম্ভব হবে?
কা. আ. হোসেন: কিছুটা ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্য দিয়ে আমরা এ ব্যবস্থাগুলো চালু করেছিলাম এবং আজ পর্যন্ত ধরে রেখেছি। সেবা ও প্রজাপতিতে কোনো বাকির কারবার নেই। কালি-কাগজ কেনা, বই বাঁধাই ইত্যাদি সব কাজেই নগদ লেনদেন। শুধু জিনিসগুলোর চালান আসার পর দেখে-শুনে-বুঝে নিতে যেটুকু সময় যায়; তারপর পাওনাদার তাঁর অর্থ পেয়ে যান। একইভাবে বাকিতে বই বিক্রি করি না। অনেকের চেয়ে বইয়ের দামও কম, কমিশনও কম। এ নিয়মে কোনো ব্যত্যয় না করায় কাগজ বিক্রেতা থেকে আরম্ভ করে বইয়ের ডিলার−সবারই আমাদের ওপর একটা আস্থা চলে এসেছে। তাঁরাও সহযোগিতা করতে দ্বিধা করেন না।
আর বই বের হওয়ার এক মাস পর বেচাকেনার হিসাবে নির্দিষ্ট হারে লেখককে রয়্যালটি দিয়ে দিই। এরপর তিন মাস অন্তর বিক্রির হিসাবে তাঁর যা পাওনা তা জমা হতে থাকে। লেখক সুবিধামতো সময়ে সেই অর্থ তুলে নেন। যতদিন বই গুদামে থাকবে এবং বিক্রি হবে ততদিন তিনি কিস্তি পেতেই থাকবেন।
আ. কিবরিয়া: আজকের বাংলাদেশে সেবা প্রকাশনী একটি বিশাল প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার কথা। সেবা অনুরাগীরা সেই স্বপ্নই দেখে। সেটি হলো না কেন?
কা. আ. হোসেন: স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক অনেক। মানুষ আগে খেয়ে-পরে বাঁচবে, তারপর না বই কিনবে। সব টাকা যদি খাওয়া-পরার পিছনেই চলে যায়, ইচ্ছে থাকলেও তো বই কেনা যায় না। প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হলে সেবা অনেক বড় হতো। সেটি হয়নি। সে জন্য আক্ষেপও নেই। তবে বাংলাদেশের সুখ-সমৃদ্ধি আসবে, এই স্বপ্ন দেখতে দোষ কী? একদিন সেটা সত্য হতেও তো পারে!
কৃতজ্ঞতা:
http://shabarchive.blogspot.com/2008/07/blog-post.html
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:২৭