সুর্যোদয়ে শান্ত স্নিগ্ধ বগালেক।
বগা লেক সংলগ্ন গ্রামটার নাম বগা মুখ পাড়া। এটা বমদের গ্রাম। এছাড়া লেকের উলটা দিকে পাহাড়ের নিচে আরেকটা গ্রাম আছে মুরংদের। ওদের ভাষায় বগা মানে ড্রাগন। পাহাড়ি মিথ বলে অনেককাল আগে ফানেল আকৃতির পাহাড়টার মাঝে একটা গর্ত ছিল। একদিন এই গর্ত দিয়ে ভিষন শব্দে একটা বগা বেরিয়ে আসে, ফলে জন্ম নেয় স্বর্গিয় এই পাহাড়ি হ্রদটা।
মিথটার মজার ব্যাপার পাহাড়ের চুড়ায় গর্ত। আর এই গর্ত দিয়ে শব্দে বেরিয়ে আসা বগা বা ড্রাগন (তথা আগুন)। সব উপকথার সাথেই কোন না কোন অতীত জড়িয়ে থাকে। বগা লেকের জন্ম ইতিহাসের উপকথাটা বার বার আগ্নেয়গীরির কথা মনে করিয়ে দেয়।
মাটি থেকে শ-খানেক ফিট উপরে চোঙ্গা আকৃতির পাহাড়। একদম খাড়া গা। অনেকটা আগ্নেয় পর্বতের মত। শুধু চুড়ায় জ্বালামুখের বদলে আছে একটা চমতকার একটা লেক। লেকের পানিতে বড় বড় সব মাছ আর অসংখ্য শাপলা শালুকের দল।
অনেকেই এভাবে বিশ্বাস করে অতীতে এখানে একটা আগ্নেয়গীরি ছিল। আগ্নেয়গীরির অগ্নুতপাতের ইতিহাসটাই বিকৃত হয়ে ড্রাগনের উপকথার জন্ম দেয়। যদি আগ্নুতপাত হয় অবশ্যই এটা এত প্রাচীন কালে যে এখানকার উপজাতী (এরা আদিবাসী নয়) সম্প্রদায় তা দেখেছিল এটা ভাবা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে। তারা দেখেনি কিন্তু আরো প্রাচীনকালে হয়তো কোন লক্ষন পেয়েছিল তারা কিংবা তারো আগের কেউ। যাই হোক, পাহাড়ের সামাজিক ব্যাবস্থা নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই, কিন্তু ইতিহাস নিয়ে খুব বেশী ঘাটাঘাটি হয়নি। শেষবারের মতো অগ্নুতপাতের পড়ে বৃষ্টির পানি জমে এরকম পাহাড়ি হ্রদ হওয়া খুবই সম্ভব। বগা লেক থেকে কেওকারাডং যাবার পথে চোখে পড়বে অনেক ধরনের শিলা। আমি শিলা চিনি না । অনেক বিশ্বাসীরা বলে থাকে হয়তো এগুলো প্রাচীন লাভা। প্রস্তুরীভুত হয়ে আজ এই অবস্থায়।
সী লেভেল থেকে প্রায় দুই আড়াই হাজার ফুট উপরে একটি ন্যাচারাল লেক। স্বাভাবিক ভাবেই এখান থেকে একাধিক ঝর্না, ঝিরি কিংবা পাহাড়ি নদী তৈরি হবার কথা। কিন্তু দৃশ্যমান কোন উপায়ে বগা লেক থেকে কোন পানি বাহিরে যায় না। কিন্তু মাঝে মাঝে বগা লেকের পানির রঙ পরিবর্তন (প্ল্যাঙ্কটন কিংবা পানির ব্যাকটেরিয়ার কারনে) হয়। মজার ব্যাপার বগা লেকের পানির রঙ চেঞ্জ হলে আশে পাশের জলাশয় গুলোরও রঙ পরিবর্তন হয়। ধারনা করা যায় হয়তো বগা লেক থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড রিভার তৈরি হয়েছে।
বগা লেকের সঠিক গভীরতা এখনও জানা যায়নি। গত বছর পাশের আর্মি ক্যাম্পের একজন জেসিও আমাকে জানিয়েছিল তারা ২০০ফিট লম্বা রশি দিয়ে পানির গভীরতা মাপার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রশি শেষ হয়ে গেলেও তলা পাওয়া যায়নি। আবার শুনেছি বাংলাদেশের একজন সৌখিন প্রসিদ্ধ ডাইভার সোনার দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু লেকের তলায় ভেজিটেশন খুব বেশী (প্রচুর শ্যাওলা, শালুক আর শাপলার শিকড় ছড়ানো, সাতরাতে গেলে প্রায় পা আটকে ধরে) উনি ১৫০ ফুটের মতো রিডিং পেয়েছিলেন। আর দেখেছেন তলায় অনেক দৈত্যাকার মাছ আছে। আসল রহস্য এখনো পুরোপুরি ভেদ হয় নি।
কিভাবে যাবেনঃ বগা লেক এখন একটি জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট। প্রচুর দেশী বিদেশী টুরিস্ট আসে। আর আসে ট্রেকারদের দল কিংবা সৌখিন ক্লাইম্বারদের দল (কাছেই কেওকারাডং আর মার্টিন্স রক, যেটা দারুন একটা রক ক্লাইম্বিং এর জায়গা)। ঢাকা থেকে বাসে বান্দারবান। এরপরে চান্দের গাড়িতে রুমা। রুমা আর্মি ক্যাম্পে একজন গাইড সহ রিপোর্ট করতে হবে। গাইডকে ৩০০টাকার মত দিতে হবে। চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করলে দুই আড়াই হাজারটাকা পড়বে। রুমাতে একদিন থাকা যেতে পারে। কেওকারাডং হোটেল নামের একটা থাকার জায়গা আছে, এছাড়া ডাক-বাংলো আছে। গাড়ি, রুমা পর্যন্ত সবসময় যায় না। গ্যারিসনের পরে সদরঘাট বলে একটা জায়গায় সাঙ্গুর তীরে নামিয়ে দিতে পারে। এজায়গা থেকে নৌকায় কিংবা পাহাড়ি ট্রেইল ধরে (৪ কিমি প্রায়) রুমায় আসতে হবে। রুমায় থাকলে কাছেই রিজুক ফলস নামের একটা ঝর্না দেখতে পারেন, তবে এখানে পাহাড়ি তাঁতের গামছা, লুঙ্গি, থামি এবং অন্যান্য জিনিস অকল্পনীয় স্বস্তা। এরপরে চান্দের গাড়িতে করে বগা লেক। মাঝে মুংলাই পাড়া নামের চমতকার একটা বম পল্লী পড়বে। যদি ফিটনেস লেভেল খুব খারাপ না হয় তাহলে পরামর্শ দেব ট্রেকিং করার। ঝিরির পথ ধরে ১২-১৫ কিমি পায়ে হেটে যেতে ৪/৫ ঘন্টা লাগবে। ভাগ্যভালো থাকলে পাইথন, হরনী, বন্য গয়াল সহ অন্যান্য ওয়াইল্ড লাইফের দেখা মিলবে।
বগালেকের পাড় থেকে
বগা লেকে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করা লাগবে। থাকা এবং খাবার জন্যে লারাম বম, সিয়াম বম (স্থানীয় স্কুল টিচার সিয়াম দিদি) সহ কয়েকটি দোকান আছে। এখন টুরিস্টরা খুব আসা যাওয়া করে তাই গত কয়েকবছরে থাকা খাওয়ার খরচ বেড়ে গেছে। তবে ১০০-২০০টাকার মধ্যে রাতে থাকার ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। ইচ্ছে করলে ক্যাম্প ফায়ার করা যেতে পারে। এছাড়া আর্মিদের একটা কটেজ আছে। এটা মাঝে মাঝে ভাড়া পাওয়া যায়। খরচ পার নাইট ২৫টাকা (গতবছর এই রেটে ছিলাম)।
বিঃদ্রঃ একবার বগালেকে গিয়ে দেখি শহর থেকে কিছু ফিট ফাট টুরিস্ট বাবু আসছেন ল্যান্ড ক্রুজার নিয়ে। এসে বিরক্ত। কিসের লেক? এইটার চেয়ে তো আমার বাড়ির পিছের এঁদো ডোবাটা সুন্দর। সৌন্দর্য একেকজনের কাছে একেক রকম। বিশাল বিশাল পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ট্রেকিং করে ক্লান্তিতে যখন শরীর ভেঙ্গে পড়ে তখন বগা লেক দেখলেই আমার সব ক্লান্তি ঘুচে যায়। মুহম্মদ জাফর ইকবালের টি-রেক্সের সন্ধানে বইতে পাহাড়ি যেই হ্রদটার বর্ননা আছে তার সাথে এর তেমন কোন উনিশ বিশ পাইনা।
কেওকারাডং যাবার হাটার ট্রেইলের থেকে
পাশের টিলার উপরে লারামের ঘর থেকে।
সিয়াম দিদির খাবার ঘর থেকে বগা লেক।
ছবি গুলোতে রঙ কিংবা অন্যকিছুতে কোন এডিট করা হয়নি। একবার জনৈকা ব্লগার আকাশের কালার গাড় নীল দেখে বলেছিল আমি নাকি অতিরিক্ত এডিট করেছি। দুই আড়াই হাজার ফিট উপরে আকাশে ধুলা বালি থাকে না, তাই আকাশে ফ্যাকাশে সাদা না হয়ে নীল মাঝে মাঝে স্বচ্ছ বা গাড় নীল হয়।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১০ সকাল ১১:০১