(রোয়াংছড়ির প্রবেশ পথ, ছবিঃ সাঈদ সৌম্য)
বাস,ট্রাক, প্লেন কিংবা লঞ্চ। চলন্ত পথে আমি কখনো ঘুমাতে পারি না। অথচ ট্রেক শুরুর আগে আমিই সবাইকে বার বার বলেছি বিশাল রাস্তা হাঁটতে হবে। রাতের বেলা বাসে অনেক করে ঘুমাতে হবে। কিন্তু ঘুম আসে না মহা জ্বালতন তো। ঐ পাশের সীটে রাহাত ভাই আর ইফতি দুজনেই ঘুমে অস্থির। রাহাত ভাই এর ঘুমানোটা আরো জটিল। মুখ হা, মাথা বাসের জানালায় বার বার ঠোক্কর খাচ্ছে। বেচারা নিঝুম দ্বীপ থেকে ফিরে বাসা পর্যন্ত যায় নাই। ব্যাগ পেক আর ওয়াকিং স্টিকটা আমার হাতে দিয়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করছে। সন্ধ্যায় বাসায় চোখের দেখা দিয়েই আবার বান্দারবনের দিকে দৌড়।
(রাহাত ভাই এর ঘুমাতে সময় লাগে না মোটেই, ছবিঃ ফজলে রাব্বী)
কাহাতক আর সহ্য করা যায়। আর বাসে লং জার্নীতে উঠলেই আমার ছোট বাড়ি থেকে প্রচন্ড ডাক আসে। এবারেও ব্যাতিক্রম না। এটা নিয়ে হাসা হাসি করতে জ্যাজ আর ঘোড়া পিছের সীট থেকে আমার সীটে চলে আসলো। এক সীটে ধাক্কা ধাক্কি করে তিন জনে বসলাম। জ্যাজ রাত তিনটার দিকে জানালো সে খুব ভালো হাত দেখতে পারে। রাত তিনটার সময় টর্চ লাইট জ্বালিয়ে হাত দেখে জানালো আমি খুব বিখ্যাত একজন স্টারকে বিয়ে করবো এবং এছাড়াও একসাথে তিনটা পরকিয়াও নাকি কপালে আছে। ব্যাপারটা প্রমান হিসাবে রেখে দেবার জন্যে ঘোড়া তার হ্যান্ডি ক্যাম দিয়ে পুরাটা রেকর্ড করে রাখলো। ভবিষ্যতে আমার বউকে দেখানোর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাক মেইল করবে নাকি।
চান্দের গাড়ী, ছবিঃ ফজলে রাব্বী
কুমিল্লায় একবার করেছি। আরেকবার হেভী চাপ আসায় চোখে আন্ধার দেখছি। বাস অলঙ্কার দিয়ে যখন ঢুকছে তখন পাহাড়ের পাশে রেইল লাইন দেখেই মনে হলো আগে ভাটিয়ারী থেকে জি ই সি আসার সময় সবসময় এখানে ইয়ে করতাম। নষ্টালজিকতা প্রাকৃতিক চাপ ভোলার উপায় নয়। ভাবলাম জি ইসির মোড়ে বিখ্যাত এসি বাথরুমটায় কাজ সারবো। একসময় সময় কাটানোর জন্যে অকারনে টিকেট করে ভেতরে শাওয়ার নিতে গিয়ে পুরা দিন কাটিয়ে ফিরতাম। এবারে জিইসির মোড়ে নেমে হতবম্ভ বাথরুমটাই নাই। একটা মাইক্রোতে জিয়া পার্ক পর্যন্ত গেলাম। ভাড়া নিয়ে ঝগড়া লাগায় সেটা আমাদের মাঝরাস্তায় ফেলে রেখে হকশোবাজারের দিকে চলে গেল। বদ্দারহাট পর্যন্ত হেটে এসে বান্দারবানের বাস ধরলাম।
বান্দারবান বাস স্ট্যান্ড থেকে চান্দের গাড়ী স্ট্যান্ড সামান্য দূরে। যেভাবেই হোক সকাল ৮টার গাড়ি ধরতে হবে। তাড়াহুরো করে এসে দেখলাম গাড়ি লাইনেও লাগেনি তখন। মুখচেনা টিকেট ওয়ালা (গতবার এর সাথে বিশাল ঝগড়া হয়েছিল, হাতাহাতির উপক্রম) কোন উতসাহ না দেখিয়ে টিকেট ধরালো। বিশাল বিশাল ব্যাগপ্যাক গুলো চান্দের গাড়ির ছাদে তুলে দিলাম। সমস্যা হচ্ছে স্থানীয় আর্মি গ্যারিসনটা একদম গা ঘেসা। ছাদে লোক ধরলে গাড়িকে ফাইন করে। তাই এই কয়েকফুট ছাদে লোক উঠেনা। কয়েকফুট পড়েই বাঁক, সব লাফ দিয়ে ছাদে উঠে গেলাম। না উঠে উপায় নেই, ১০জনের সীটের গাড়িতে ৪০জন বাঙ্গালী পাহাড়ি এবং বিশাল বিশাল বোঁচকা বুঁচকি। আর ছাদে অনেক বেশি কমফোর্ট তাই এই গাড়ির আদি নাম ছাদের গাড়ি বিবর্তনে চান্দের গাড়ি, যদিও অনেকের ধারনা উচু পাহাড় ঘেসে চান্দের দেশে প্রায় আরোহীদের পৌছে দেয় বলে এই নাম।
ক্যান্টমেন্টের সামনে চান্দের গাড়ির ছাদে উঠা মানা, ছবি সাঈদ সৌম্য)
চান্দের গাড়িতে ছাদে বসার জায়গা না পেয়ে ঘোড়া একটা মরিচের বস্তার উপরে বসেছিল। ঢাকার বাজারে চাপা চাপা এই মরিচ গুলো বোম্বাইয়া মরিচ নামে পরিচিত। কিছুক্ষন পরেই পশ্চাদদেশে ঝাল লাগায় চিল্লা চিল্লি শুরু করে দিল। বেচারা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। অধিক আদরে গাধা না হয়ে হাসিব ঘোড়া হয়েছে, এই নামেই বন্ধুরা সবাই চেনে। ছাঁদে বসার নিয়ম কোনার স্টিল বার (দড়ি দিয়ে বস্তা বাধার জন্যে) গুলো শক্ত হাতে চেপে ধরে পাশ দিয়ে পা নামিয়ে দেয়া। শক্ত করে না ধরলে চান্দের দেশে পৌছে যাওয়া যায়। চান্দের গাড়ির ছাদে একজন স্থানীয় বম ছেলের সাথে গল্প হলো। সে থানছির লোক। বান্দারবান শহরেই থাকে। একবার কক্সবাজার পর্যন্ত গেছে। চিটাগাং পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। আরেকজন স্থানীয় বাঙ্গালী কলেজ ছাত্র ছিল চশমা পাড়া। চাঁটগাঁর আঞ্চলিক চ্যাং ব্যাং ভাষায় কি জানি বলছিল। নিচে সাবটাইটেল না থাকায় বুঝতে পারলাম না। সম্ভবত পাহাড়ি জোঁক নিয়ে কিছু বলছিল।
রোয়াংছড়ির পাহাড়ে অনেক গাছ, বাঁশের জঙ্গল বেশী। চিকন রাস্তা ওপাশ থেকে ব্যাম্বু মাইর খাচ্ছিলাম। সামনে যে বসা তার দায়িত্ব ছিল বলে দেব বাঁশ ঝার আসছে, গাছের ডাল আছে। কিন্তু বোম্বাইয়া মরিচের বস্তায় বসার পর থেকে তার মুখ থেকে ক্রমাগর আহা উহু এবং কিছু অশালীন গালি গালাজ ছাড়া কিছু বেরুচ্ছিলো না। শালার মরিচের বাচ্চা মরিচ, তোরে আমি............।
একটা পাহাড়ে একজন আদীবাসি মহিলা কাঠ কেটে বস্তা নিয়ে আমাদের চান্দের গাড়ির ছাদে তুলে দিলেন। নিজেও চেপে বসলেন গাড়িতে। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীর উপস্থিতি বেশি। মহিলা সম্ভবত টাকা বাঁচানোর জন্যে বছর পাঁচেকের ছেলে আর বছর দশেকের মেয়ে এবং পোষা কুকুরটাকে গাড়িতে তুললেন না। কুকুরটা দৌড়ে চান্দের গাড়ির আগে আগে। অবাক করে দিয়ে বাচ্চা ছেলে আর মেয়েটাও দৌড় শুরু করলো। মেয়েটা মাইলখানেক দৌড়ানোর পরে টায়ার্ড হয়ে গেলেও ছেলেটা ঠিকই ৫মাইলের মত রাস্তা গাড়ির সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়ালো (পাহাড়ি রাস্তায় চান্দের গাড়ির স্পিড বেশী হয়না)। পুরা কৃষ স্টাইল। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যেন উড়ে যাচ্ছে। এদেরকে সাফ গেমস এ নামানো যায়না? উচু এলাকার মানুষ, স্বাভাবিক ভাবে এদের রক্তে লোহিত কনীকার পরিমান এবং অক্সিজেন ধরে রাখার ক্ষমতা বেশী।
(সত্যিকারের কৃষ, ছবিঃ সাঈদ সৌম্য)
রোয়াংছড়ি বাজারে ঢোকার রাস্তাটা এতই সুন্দর যে হাসিব তার যন্ত্রনা ভুলে গেল কিছুক্ষনের জন্যে। ছোট একটা পাহাড়ি খাল অজগরের মত এঁকে বেঁকে গেছে।তার উপরে স্টিলের ব্রীজ। সামনে বহু রঙ্গা খেত।আদা, মরিচ, বিভিন্ন শাক, ধান খুব কম, জুমের ক্ষেত অন্যদিকে। পিছেই মাথা তুলে আছে একটা বিশাল পর্বত। রোয়াংছড়ি আসলে একটা ভ্যালি। পাহাড়ের চুড়াকে জরিয়ে ধরে আবেগী চুমু দিচ্ছে শরতের সাদা মেঘের পুঞ্জ। রোয়াং ছড়িতে আমরা সবাই নেমে পড়লাম। এর পরে আর রাস্তা নাই। আমাদের রোয়াং ছড়িতে কন্টাক্টের নাম বান কিম বম। স্থানীয় বম পাড়ার কারবারীর ছেলে। ভালো বাংলা জানে। গত সপ্তাহে আরেকটা ট্রেকিং দল আসছিল। রনীন পাড়া পর্যন্ত এসে সিপ্পি সামিট না করেই ফিরে গেছে। ওদেরকে গাইড করেছিল বান। আমরা প্রথমে হালকা খাওয়া দাওয়া করা দরকার। এখানে ইলেক্ট্রিসিটি আছে। টেলিটকের নেটওয়ার্ক আছে। আমরা চিনির সিরা ভেজানো সিঙ্গারা, পিয়াজু আর গরম চা খেয়ে নিলাম। প্রচন্ড রোদ, মাথার তালু ফেটে যায়। পাহাড়ের উপরে গুচ্ছ গুচ্ছ গ্রাম। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় ঘুরছি। গ্রামের উতসাহী নারী পুরুষ নির্বিশেষে ভীর করে দেখছে। কিন্তু বান দের পাড়া আর খুজেই পাই না। রোদে পুরে একেকজনের অবস্থা শেষ। হাসিব এতক্ষন বোম্বাই মরিচের জ্বালা ভুলে ছিল। এবার ঝাঝিয়ে উঠলো, সৌম্যর বাচ্চা, আমি ট্রেকিং করুম না। আমারে গাড়িতে তুইল্যা দে, আমি হকশো বাজার যামু। কে জানি বললো রোয়াংছড়ি বাজারে মোবাইল করার দোকানে বান কে দেখা গেছে। আবার ফিরতি পথ। রোয়াংছড়ীতে হাসিব(ঘোড়া)কে ঠান্ডা করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো। পরিচিত এক বম দোকানদার বের হলো। আগের বার রাহাত ভাইদের হেল্প করেছিল। স্থানীয় বাজার কমিটির প্রধান। দোকানে বসিয়ে ফ্যান ছেড়ে দিল। একজন ভাঙ্গা বাংলায় জানালো হাজী সাহেবের দোকানে ফ্রিজ আছে। ঐখান থেকে কোল্ড ড্রিংক্স দিলে এর মেজাজ ঠান্ডা হবে। দৌড়ে গিয়ে আনলাম। কিন্তু আমাকে শাস্তি দিতে হাসিব আমার ভাগটাও খেয়ে তবে ঠান্ডা হলো।
রোয়াংছড়ির দেব দুত, ছবিঃ ফজলে রাব্বী
এমন সময় আরেকটা পরিচিত মুখ বের হলো। লাল তুয়ার ছেং। লাল তুয়ার দাদা পাইখং পাড়ার বাসিন্দা। এবছরে ৩টা ট্রেকিং দল গেছে ৩টাকেই উনি হেল্প করেছিলেন। রাহাত ভাইকে চিনে ফেললো। বাজার করতে পর্বতের ওপার থেকে এসেছিলেন। অনেক নিশ্চিত হলাম। এরপরে বাজার করার পালা। চাল, ডাল আর রাধুনীর প্যাকেট মশল্লা কিনলাম। সাথে সয়াবীন তেল কিনতেও ভুল হলো না। উপরের গ্রাম গুলোতে এইসব পাওয়া কষ্টকর। চাল পাওয়া গেলেও ওরা ডাল খায়না। আর বাঙ্গালী মশলা কিংবা তেলের ব্যাবহারও ভিন্ন।
এর পরে গেলাম থানায়। থানায় যেই ভদ্রলোক ছিলেন। আমাদের অনেক খাতির করলেন। কিন্তু পার্মিশান দেবেননা। বরাবরের মত শান্তি বাহিনী কিংবা ড্যানিডার সুমনের ভয়। আরাকানের বিদ্রোহীদের দল। ভয়ের অন্ত নাই। একবার একজন আর্মির সৈনিকের মুখে ২০ফিট অজগর আর নরমাংস ভোজী গ্রামের হাস্যকর ভয়ও শুনেছি। যাই হোক ওসি সাহেবের সাথে বেশ খাতির হলো। দেখা গেল এই ভদ্রলোক ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে অঙ্কে মাস্টার্স করেছেন। প্রথম পোস্টিং এমন জায়গায় যেখানে মাতৃভাষা বিরল। স্বভাবতই আমাদের দেখে খুব খুশি। অনেক কথা চালাচালির পরে আমাদের রনীন পাড়া পর্যন্ত পার্মিশান দিলেন। রনীণ পাড়া আর্মি ক্যাম্প থেকে সিপ্পি সামিটের পারমিশান নিতে হবে।
ভদ্রলোককে বিদায় দিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম। কাছেই একটা খাওয়ার দোকান। কষাই খানায় বাঙ্গালীদের গরুর মাংস আর মাছের পাশে পাহাড়ীদের জন্যে শুকর ঝুলিয়ে রাখা। চামড়া ছাড়া শুকর দেখলেই আমার কেমন জানি লাগে। একটূ আগেই এক রোগা পটকা লোককে হাতির মত মোটকা এক আলিশান শুকরকে ফেলে জবাই করতে দেখেছিলাম। সেটা ভয়ঙ্কর শব্দ, বুকে কাপন ধরায়।আমরা ভদ্রভাবেই শুকর খাবার প্রস্তাবে না করলাম। স্থানীয় আদিবাসী হোটেলমালিক খুব যত্ন করছিলেন, তাই প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
রোয়াংছড়ি প্রাইমারী স্কুলে দুজন দেবদুত, ছবিঃ সাঈদ সৌম্য
শুরু হলো আমাদের ট্রেক। সামনে ৮৫ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা। পাহাড়িদের হাটার স্টাইল খুব চমতকার। আস্তে ধিরে হেলে দুলে যায়। আমরা বাঙ্গালীরা পাহাড়ে গেলে কেন জানি কম্পিটিশানের ভঙ্গিতে জোরে গটগট করে হাটার চেষ্টা করি। দ্রুত টায়ার্ড হয়ে যাই। ওরা মনে হয় হাটছে আস্তে, কিন্ত এভারেজ স্পীড আমাদের অনেক গুন। একেকজন মাথার সাথে বেল্টে বেধে পাহাড় প্রমান বোঝা ক্যারি করে। রোয়ংছড়ি বাজারের পর প্রাইমারী স্কুল। বাচ্চারা অবাক হয়ে দেখছিল। স্কুলে এরা বাংলাতেই পড়ে জেনে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমাদের গ্রামের স্কুলের বাচ্চারা ইংলিশ পড়লেও ইংলিশে কথা বলতে পারে না, এটা ভুলে গিয়েছিলাম। সামনে একটা ঝিরিতে সবাই গোসল করে ফিরছিল। পাহাড়ের যত গভীরে যাওয়া যায়, মেয়েদের রুপ ততই যেন বৃদ্ধি পায়। একেকজনের দিক থেকে চোখ ফেরানো দায়। সামনে বিশাল রাস্তার কথা ভুলে গিয়ে এমপি থ্রিতে মাইলসের গান ছাড়লাম।
পাথুরে নদীর জলে পাহাড়ি মেয়ে নামে,
ভেজা তার তনু মন ধরা দেয় না।
কি স্বপন একে দিল বলা যায় না।
ট্রেক শুরু , ছবিঃ রাহাত খান
বহু দূর যেতে হবে, এখনো পথের অনেক রয়েছে বাকি, তুমি ভয় পেও না, তুমি থেমে যেও না। ছবিঃ সাঈদ সৌম্য।