রাঙ্গুনীয়াতে এক্সেরসাইজ লৌহকপাটে আমি, সেকেন্ড টার্ম ক্যাডেট, হাতে উদ্ধত একে ৪৭
তারিখটা ছিল জুলাই মাসের ১৬। চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে সেনাবাহিনী মার্কিক করা ৩টা বাসে আমরা রওনা হলাম। টোটাল ১৪০ জন ছেলে মেয়ে। ৩০ জন ছেলে নেভী আর এয়ারফোর্সের আর ১১১জন (২৮টা মেয়ে) আমরা মাটির মানুষ। সবাই যাচ্ছি ভাটিয়ারীতে সাগরের পারে 'চির উন্নত শির" নামের একটা চুড়ার নিচে একটা ভ্যালিতে, যেখানে বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমী। বিএমএ নামটার অনেকেই অর্থ করে বাংলাদেশ মেন্টাল একাডেমী। ২৪ মাস, মাত্র ২৪ মাস প্রচন্ড খাটুনিতে ব্রেন ওয়াশ করার পরে বের হয়ে আসবে একদল সদ্য কৈশোর উর্তিন্ন আর্মি অফিসার, দেশের সার্বভৌমত আর স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে। ১৮/১৯ বছরের ছেলে মেয়ে গুলোর সবার চোখেই স্বপ্ন। এডভেঞ্চার, দেশ প্রেম, কিংবা আর্লি এস্টাবলিশমেন্টের স্বপ্ন।
যাই হোক, হাট হাজারীর পাহাড় আর লেক ঘেরা সুন্দর সবুজ পাহাড় বেয়ে বাস গুলো যখন বিএমএর মেইন গেট (আল্লাহু আকবার গেট কিংবা মাইলটেস্ট গেট নামে কুখ্যাত) আরপি চেক পয়েন্ট পেরুচ্ছে। ৩ নাম্বার বাসে আমি। সামনের বাস গুলো থেকে ভয়ানক সব চিতকার আর আর্তনাদের সাউন্ডে ঘাবরে গেছি, না জানি কি হচ্ছে। এন অফিসার এন্ড আ জেন্টেলম্যান কিংবা অন্যান্য মিলিটারী একাডেমী নিয়ে মুভী গুলোতে দেখেছি প্রথমদিন কি হয়। আত্নীয় স্বজনের মধ্যে যারা আর্মিতে আছে বা ছিল তাদের মুখে বিএমএ কথা শুনার ট্রাই করলেই দেখতাম তারা আবেগে আপ্লুত হয়ে যেত। শুধু বলতো প্রথম কয়েক ঘন্টার কথা মনে আছে। ভয়ঙ্কর পাঙ্গার চোটে বাকি সব ভুলে গেছি। প্রথম কয়েকদিনে এমনিশিয়া খুব সাধারন ঘটনা। যাই হোক। আমাদের বাসটা গেটের ভিতরে ঢুকতেই এক বিশালদেহী সিনিয়র মেয়ে ক্যাডেট ঢুকলো। ঘাগুদের কাছে শুনে এসেছি, সিনিয়র নারী-পুরুষ নির্বিশেষে 'স্যার'। সেই মেয়ে ঢুকেই গালি গালাজ শুরু করলো। ইউ ফাকেন শিটি ফার্স্ট টার্মারস। ইউর বামস আর সো লাউজি বিগ দ্যাট ইউ ক্যান্ট মুভ ফাস্টার। আমরা ভয় পেয়ে ছুটাছুটি করে বাস থেকে নামতে থাকি। মেয়েটা গালির তুবরী ছোটাতে থাকে। কোন কারন ছাড়াই গালি দিচ্ছে আমরা ভয়ানক অলস। আমরা নোংরা এবং আমরা খুব খারাপ। তাই সে আমাদের Fu**k করবে। আর্মিতে ঐ শব্দটার অর্থ পাঙ্গাবে কিংবা টর্চার করবে। কিন্তু আমার সাধারন ভাষা জ্ঞ্যান বলে একটা মেয়ে একটা বিশেষ অঙ্গের কারনে কোন ছেলেকে ইয়ে করতে পারেনা। ব্যাপারটা ভেবেই আমি এবং আরেক ছেলে (ও রাজশাহী ক্যাডেটের, কিন্তু বাড়ি আমার এলাকায়) হেসে ফেললাম। সেটা দেখে সেই সিনিয়র তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। ইউ শিট অফ দি শিট পট ইউ ওয়ান্না সি হাউ ক্যান আই **** ইউ। জাস্ট কাম উইথ মি।
গভীর রাত। পাশে বেলম্যান হ্যাঙ্গার এবং বাস্কেটবল গ্রাউন্ড কিংবা স্বাধীনতা মানচিত্র থেকে জুনিয়রদের পাঙ্গানোর আর্তনাদ ভেষে আসছে। বৃষ্টি ভেজা ঘাস আর বড় বড় কাটা ওয়ালা লজ্জাবতীর মাঠ (অজ্ঞাত কারনে এই লজ্জাবতীর কাটা গুলো ছুলে বন্ধ হয়না বরং আরো বের হয়ে আসে)। পরিস্থিতি যথেষ্ট ভয়ঙ্কর ছিল। আমাদের ২ জন হাসা হাসি করা ক্রিমিন্যালকে আলাদা করা হলো। ক্রমান্বয়ে গালির তুবরী ছুটছে। আমরা শীট অফ দ্যা শিট পট, আমরা লাউজি বাফুন, আরো কি কি জানি মানে বুঝলাম না, সব গুলোর অর্থ আমরা খুব খারাপ। আর এফ ওয়ার্ড গালীটা সবচেয়ে বেশি আসে। আমাদেরকে কাদা ভর্তি ডিচে নামানো হলো। এরপরে ৬ ফুট ওয়াল (জাম্প করতে, হয়, পিটি আইটেম) কাছে নিয়ে লং আর্ম করে রাখা হলো, পা উপরে মাথা নিচে। এর মধ্যে কাটা ঝোপে রোলিং ফ্রন্ট রোলিং করতে করতে দুজনেই প্রায় বার দশেক বমি করছি, গায়ের কাপড় চোপড় এবং চামড়া কেটে ফালা ফালা, বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমে আছে, কাটা ফুটে আছে। দির্ঘক্ষন লং আর্ম (এটা আসলে একটা ব্যায়াম, সিনিয়ররা এটা করাতো গঠন মুলক কাজেই, হাতের পেশী মারাত্নক শক্ত হত, জুনিয়র থেকে সিনিয়র হলে কেউ পাঙ্গানোর মত না থাকলে অনেকেই নিজে নিজে লং আর্ম হয়ে থাকতো) হয়ে থাকার ফলে চোখ লাল টুকটুকে হয়ে গেছে মনে হচ্ছে ফেটে রক্ত বেড়িয়ে আসবে।
কতক্ষন পরে হাসির শাস্তি শেষ হলো জানিনা, সময় স্থির হয়ে গিয়েছিল। যখন উঠলাম তখন ট্র্যাডিশনাল কাজ কর্ম (বোকারা বলে শাস্তি বা পাঙ্গা, আসলে এটা ঐতিহ্য, আমাদের সিনিয়ররা আমাদের পাঙ্গাতো আর আমরা বলতাম আমরা সিনিয়র হলে পোলাপানদের কষ্ট দিব না, যখন আমরা সিনিয়র হলাম আমরাও শুরু করলাম, কারন ভয়ানক শারীরিক আর মানসিক কষ্টে সার্ভাইভ করতে এটা অতি দরকারী, আমাদের কোর্সের একছেলে তো একজন মেডিক্যাল কোর্সের একজন নতুন ট্রেইনিকে এমন পানিশমেন্ট দিল যে সে প্যান্টে বড় বাথরুম করে দেয়)।
ট্র্যাডিশন হচ্ছে সবাইকে সাথের বেডিং পত্র মাথায় নিয়ে ব্যাটালিয়ন চক্কর দিতে হবে। ব্যাটালিয়ন হচ্ছে আর্মির ইউনিট, আর্টিলারীতে বলে ব্যটারী। ১০ বারো জনের গ্রুপ নিয়ে সেকশান। কয়েকটা সেকশান নিয়ে প্ল্যাটুন, ৩টা প্ল্যাটুন নিয়ে একটা কোম্পানী আর ৩টা কোম্পানী নিয়ে একটা ব্যাটালিয়ন। ব্যাটালিয়ন আকৃতিতে অনেক বড়। বিএমএ বাংলাদেশের সকল আর্মি অফিসারের জন্মভুমী, তাই সম্মান করে একে বলা হয় প্রথম বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন। ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড এবং ফাইন্যাল টার্মের সকল ক্যাডেটকে ৪টা করে প্ল্যাটুনে ভাগ করা হয়। প্রায় ৫০০জন ছেলে মেয়ে ৪টা কোম্পানী (জাহাঙ্গীর, রউফ, মোস্তফা, হামিদ ৪ বীরশ্রেষ্ঠের নামানুসারে) তে। ৪ তলা ৪টা কোম্পানী লাইন, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড, ক্যান্টিন, গার্লস হোস্টেল, মিসেলিনিয়াস বিল্ডিং, পাহাড়ি রাস্তায় পুরা ব্যাটালিয়ন মাথায় সব বোচকা বুচকি নিয়ে দৌরানো সহজ নয়। দুবছরের জন্যে আসা, বালিশ, ম্যাট্রেসের সাথে অন্যান্য জিনিস পত্র কম না। দৌড় ব্যাটালিয়ন চক্কর শেষে ইয়লো বোর্ডের (এটা ব্যাটালিয়নের সীমানা, এর পর থেকে ক্যাডেটদের রাজত্ব, ট্রেনিং দান কারী সৈনিকেরা এটা ক্রস করতে পারে না) সামনে থেকে ফ্রগ জাম্প দিতে দিতে বেলম্যান হাঙ্গার। অবস্থা যখন করুন তখন আধামাইল দূরে বেলম্যান হ্যাঙ্গার (একটা বিশাল হ্যাঙ্গার ভিতরে জিমনেশিয়াম মুলত ইন্ডোরে পিটি এবং প্যারেড করার জন্যে) এ আসলাম। চেয়ারে ফাইন্যাল টার্মের কিছু সিনিয়রের ছিল। একজন শ্বেতাঙ্গ (পরে জেনেছিলাম প্যালেস্টাইনি) ক্যাডেট উঠে দাড়ানোর পার্মিশান দিল। কয়েক ঘন্টা পরে সোজা হয়ে দাড়াতে পেরে সেই ভিনদেশী ছেলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠলো। একটানা কয়েকঘন্টা ফ্রগ জাম্প (ব্যাঙ এর মত করে লাফানো) দিয়ে পা অসার হয়ে গেছে। আমার খাতা পত্র দেখে আমাকে একটা নাম্বার এবং নাম দেয়া হলো। অফিসিয়াল জিসি নেম (সাধারনত নামের শেষ অংশ) এবং নাম্বার (জিসি- জেন্টেলম্যান ক্যাডেট) নিয়ে ঘোষনা করা হলো এখন থেকে আমি জাহাঙ্গির কোম্পানীর অংশ। জাহাঙ্গির কোম্পানীর থার্ড টার্মএর কর্পোরাল এসে আমার দায়িত্ব নিল। ইনি স্যাডিস্ট হিসাবে কুখ্যাত ছিল। ৪টা কোম্পানীর ৪টা রঙ থাকে, জাহাঙ্গির সবুজ, রউফ কমলা, হামিদ-মেরুন, আর মোস্তফা-ব্লু। সব কিছুতেই এক কোম্পানীর সাথে আরেক কোম্পানীর প্রতিযোগীতা। জাহাঙ্গির কোম্পানী এর মাঝে সবচাইতে ঐতিহ্যবাহী এবং অভিজাত কিন্তু পাঙ্গা পালিশের জন্যে এতই কুখ্যাত যে অন্য কোম্পানীর ছেলে মেয়েরা এখানে ঢুকতে দিনে দুপুরে ভয় পায়।
কর্পোরাল আমাকে এবং আরো জনাদশেক ছেলেকে তাড়িয়ে নিল জাহাঙ্গির কোম্পানীতে। ব্যাটালিয়নের শেষ মাথায় সবচাইতে দূরে। কোম্পানী লাইনের সামনে উঠানের মত জায়গাটাতে ব্যাগেজ রেখে সামনের বিল্ডিং (এন্টি রুম এবং নিচের তলায় ডাইনিং হল)এ ঢুকালো। ছুড়ি কাটা চামুচ দিয়ে কাটাময় গরু মাছ (একধরনের সামুদ্রিক মাছ যেটার মুখ কাটার মত) খাওয়া দুঃসাধ্য। কিছুটা খেয়েই উঠে পড়লাম। সবাইকে অনেক করে পানি খাওয়ানো হলো। এর পরে আরো কিছু ট্র্যাডিশন। এর দায়ীত্ব ফাইন্যাল টার্মারদের। প্রেসিডেন্ট প্যারেডের আগে পুরো কোম্পানী লাইন ফুলে ফুলে ভরে যায়। এই ফুল গুলো না সরলে পরের প্যারেডের সময় নতুন টাটকা ফুল আসে না। তাই সদ্য জয়েন করা ক্যাডেটরা এই ফুল গুলো খেয়ে খেয়ে শেষ করা লাগে। আমরা সবাই ফুল খেয়ে বাগান পরিস্কার করতে লাগলা। ফুল খাওয়া অবশ্য পরে আরো করতে হয়েছে। এটাও ট্র্যাডিশান। এর মধ্যে গাঁদা আর রজনী গন্ধাটা খারাপ ছিলনা। কিন্তু বড় সাইজের গোলাপ আর মোরগ ফুল ছিল জঘন্য। যারা নখরামী করছিলো তাদেরকে আলাদা করা হলো। ডিনারের সময় গামলা গামলা পানি খাওয়ানোর উদ্দেশ্য ছিল বমি করানো এটা টের পেলাম। আমি আর কয়েকজন ভাগ্যবান এই পাঙ্গার হাত থেকে বাচলাম। আমাদের নিজ নিজ রুম নাম্বার দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলো। নিয়ম অনুযায়ী ফাইন্যাল টার্ম নিচতলায়, থার্ড টার্ম ২ তালা, সেকেন্ড টার্ম ৩ তালা আর আমরা ৪ তলায়। ট্র্যাডিশন অনুযায়ী ৪ তলা পর্যন্ত প্রতিটা সিড়ির পদক্ষেপ চুমু দিয়ে দিয়ে বেয়ে ৪ তলায় উঠা লাগলো। ফ্রেস ক্যাডেটদের জন্যে বাধ্যতামুলক। এতে কোম্পানীর জন্যে ভালোবাসা বারে।
রুমে ঢুকে সময় পেলাম না। বেডিংটা ফেলেই চেঞ্জ করতে হলো। চেঞ্জ করতে গিয়ে মজার ঘটনা টের পেলাম। আমার গায়ের জামা কাপড় সব ছেড়া খোড়া, রক্ত আর বমি মেশা। কিন্তু পায়ের জুতো ঠিক আছে। মজার ব্যাপার জুতো ঠিক আছে কিন্তু একপায়ের মুজা ভ্যানিশ। জুতা একবারো খুলি নাই, মুজা হারালো কিভাবে?
ভাবার টাইম নাই। নিচে থেকে সিনিয়রদের ক্রুদ্ধ গালিগালাজ আসতে লাগলো। চট পট সাদা হাফপ্যান্ট, সাদা হাফ শার্ট, সাদা মোজা আর পিটি কেডস পরে নিচতলায় ফল-ইন। শুরু হবে ভিগোরাস পাঙ্গা।
প্রথম দিনের কথা আর মনে নাই। ১০০ জনের মধ্যে ৯৯%ছেলেই এমনেশিয়ার শিকার হয়। ট্র্যাডিশনালি আমিও হয়েছিলাম। প্রথম দিনের বাকী ঘটনা (পরবর্তি প্রায় ৩/৪দিনের) কোন স্মৃতি নেই।