কোথায় স্বর্গ? কে বলে বহুদুর?
বগালেকের উচ্চতা সী লেভেল থেকে প্রায় সাড়ে তিনহাজার ফিট। মেঘের দেশের এই প্রাকৃতিক হ্রদটার সাথে মুহম্মদ জাফর ইকবালের টি রেক্সের সন্ধানে বইটার ফসিল ভর্তি হ্রদটার আশ্চর্য রকমের মিল। কেউ কেউ বলে বগা লেক ঐ হ্রদটার চেয়েও হাজার গুন সুন্দর। যারা এখনো বগালেকে যাবার সৌভাগ্য হয়নি গিয়ে মিলিয়ে আসুন।
বগা লেক বান্দরবন জেলার রুমা উপজেলায় পড়েছে। সবচেয়ে কাছের বসতি, বগা মুখ পাড়া। বম অধ্যুসীত গ্রাম। এছাড়া দার্জিলিং পাড়া, এবং অফিশিয়ালী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গ্রাম(?) সাইকত পাড়া ও খুব কাছেই। দির্ঘ দিন ধরে কেওকারাডং অভিযানে যাওয়া ট্রেকার/হাইকারেরা কিংবা সাধারন টুরিস্টরা বগা লেককে বেস ক্যাম্প হিসাবে ব্যাবহার করে। রুমা বাজার থেকে বগা লেকে এসে রাত কাটায়, খাবার/পানি নিয়ে বোচকা বুচকি রেখে কেওকারাডং সামিট করে পরের দিন। এবং ফিরে এসে রুমার দিকে ফিরতি হাটা দেয়।
স্বপ্নের বগা লেক।
বগা লেক নিয়ে এখনো অনেক রহস্যের জাল ঘিরে আছে। যেমন সাগর পৃষ্ঠ হতে এত বেশি উচুতে অবস্থান, কিন্তু বগা লেক থেকে কোন নদী, খাল বা ঝর্না তৈরি হয়নি, এবং কোন বাইরের উৎস থেকেও বগা লেকে পানি আসে না। পানির উৎস বৃষ্টি পাত বলে ধারনা করা হয়। কিন্তু এত উপরে এত বিশাল লেক তৈরির জন্যে খালি বৃষ্টিপাত, অনেকের কাছে ব্যাপারট মানতে নারাজ। দ্বীতিয়ত বগা লেকের গভীরতা নিরুপন করা আজও সম্ভব হয়নি। অনেকেই বগা লেক সম্পর্কে এরকম মন্তব্য করে, আরে আমাদের গ্রামের বাড়ির পুকুরটা আরো চওড়া (যদিও এটা সাড়ে তিনহাজার ফিট উপরে এটা মনে থাকে না)। কিন্তু সত্যি কারের কথা হচ্ছে বগা আর্মি ক্যাম্পের সৈনিকেরা একবার লেকের মাঝে রশি ফেলে গভীরতা মাপার চেষ্টা করে। কিন্তু ২০০ ফিট যাবার পরে দড়ি শেষ হয়ে যায়, তলা আর পাওয়া যায়নি। তৃতীয়ত, বগা লেকের পানির রঙ নিয়মিত ভাবেই পালটে যায়, কখনো সবুজ, কখনো গাড় নীল আবার কখনো কালচে, মজার ব্যাপার কেও কারাডং রেঞ্জের অন্যান্য হ্রদ্গুলোর পানির রঙ একই ভাবে পালটে যায়, যদিও তার কোনটার সাথেই বগা লেকের কোন নদী, ঝিরি খাল বা ঝর্না নেই, বগা লেক থেকে দৃশ্যমান উপায়ে একবিন্দু পানিও বাইরে যায়না। অনেকেই ভাবে হয়তো ভু গর্ভস্থ কোন নদী আছে বগা লেকের, তলাটায় কি আছে, কেউ তো জানে না।
বগালেকে, সিয়াম দিদির দোকানের উঠান থেকে তোলা।
বগা লেকের চেহারা বাইরে থেকে আগ্নেয়গিরীর মত। এবং আশে পাশে প্রচুর আগ্নেয়শীলার উপস্থিতি। কেও কাড়াডং এবং তাজিং ডং এর মত বড় দুটো পর্বত ছাড়াও তিনহাজার ফিট ল্যান্ডমার্ক ছাড়ানো আরো কিছু পর্বত চুড়া আছে আশে পাশে। তাই বগা লেকের সত্যিকার পরিচয় কল্পনা করে নিতে গিয়ে বেশির ভাগ লোকই একে একটি মৃত আগ্নেয়গীরী বলে কল্পনা করে নেয়। কিন্তু আগ্নেয়শিলা আর লাভা এক জিনিস নয়। বগা লেকের আসল পরিচয় জানতে দরকার আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে আধুনিক গবেষনা। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে ট্রেকার এবং এডভেঞ্চার প্রেমীদের স্বর্গ রাজ্যে পরিনত হয়েছে রহস্যের বগা লেক। গত বছর কুরবানীর ঈদের পরে একমাসেই ২০০ জন বহিরাগত নাম এন্ট্রি করেছিল বগা আর্মি ক্যাম্পে। যতই বগা লেক পরিচিতি পাচ্ছে ততই জনপ্রিয় হচ্ছে। এখন এটা শূধু কেওকারাডং অভিযানের আগে একটি বেস ক্যাম্প না। নিজেই নিজের অনন্য সাধারন অবস্থান, মীথ আর রহস্যের কারনে অনন্য।
বগালেক থেকে পিছনের ট্রেক, ঝিরি পথ দিয়ে আসলে প্রবেশ পথ।
বম পাড়ায় যাবার ট্রেইল, বামে বগা লেক।
#বগা লেক কিভাবে যাবেন?
সাড়ে তিনহাজার ফিট প্রায় উপরে প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা লেক, যার থেকে একবিন্দু পানি বাইরে যায় না, বা বাইরে থেকে ভেতরে আসে না।
শিতকালে সাঙ্গুর এই চেহাড়া দেখে কনফিউজ হবেন না। মনে রাখবেন, এটা পাহাড়ি নদী, এবং এর নাম সাঙ্গু, তবে শীতকালে চান্দের গাড়ি দিয়ে সরাসরি যাওয়া যায়।
১। ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান। নাইট কোচটা ভালো। সাউদিয়া (এসি), এস আলম এবং ডলফিন নন এসি বাস ছাড়ে দিনে দুবার সরাসরি ঢাকা থেকে। এছাড়া পুর্বানী বাস এবং অন্যান্য মাইক্রোবাস সার্ভিস চিটাগং এর বদ্দার হাট থেকে কেরানীর হাট হয়ে বান্দরবান আসে সারাদিন।
সদর ঘাটে সাঙ্গু পেরিয়ে হাটা শুরু করলাম। এই সুদর্শন ব্যাক্তিটি, আমি। হি হি হি।
২। বান্দার বান থেকে চান্দের গাড়িতে করে রুমার দিকে রওনা হবেন। গ্রুপ করে গেলে খরচ কম হবে। চান্দের গাড়ির নিরাপত্তার ব্যাপারটা লক্ষনীয়। নাইট কোচে এলে সকাল ৭টায় বান্দারবানে পৌছে যাবেন,
৮টার চান্দের গাড়িটা ধরলে অনেক সুবিধা। পথে চিম্বুক ওয়াই জাংশান, গ্যারিসান এই দুইজায়গায় নাম এন্ট্রি করতে হবে। বহিরাগত দের জন্যে মাস্ট। সরকারী পার্মিশান ছাড়া কখনোই ট্রাভেল করবেননা। গ্যারিসনের পরে সদরঘাট ব্রীজে এসে রাস্তা শেষ সাঙ্গু নদীর পাড়ে। বর্ষা কালে বড় ট্রলার চললেও শীতকালে চান্দের গাড়ি নদী পাড় হয়। যদি না পারে তাহলে গাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।
সাঙ্গুর পারে ধরে মনোরম ট্রেইল। ছবি তোলার দিন মায়ানমারে নার্গিস আসছিলো।
৩। সদর ঘাটে একটা আর্মি ক্যাম্প আছে, ওখানে রিপোর্ট করে পানি ভরে নেবেন। ওখানে একটা ঝর্নার মত আছে পাইপ দিয়ে ক্যাম্পে পানি আসে। সম্ভবত পাহাড়ে কোন ধরনের মিনারেল পানিতে মেশে, তাই ওখানকার পানি অস্বাভাবিক রকমের মিষ্টি। ক্যাম্পের লোকেরা অবশ্য আল্লাহর রহমত এটুকুই বলে।
কেও কারাডং রেঞ্জের নাম জানা এক পাহাড়ের চুড়ায় সূর্যাস্ত। জঙ্গলে রাত কাটাবেন না। কখনো।
৪। নৌকায় করে সাঙ্গুর ওপারে গিয়ে হাটা শুরু করতে পারেন, অথবা সরাসরি রুমা বাজারে চলে যেতে পারেন। সদরঘাট থেকে ৪/৫ মাইল রাস্তা। চান্দের গাড়ির রাস্তা, পাহাড়ি ট্রেইল কিংবা নদীর পাড় যেদিক দিয়েই যান না কেন সহজেই রুমা বাজারে পৌছে যাবেন। রুমা বাজার বাংলাদেশের একমাত্র রিক্সাবিহীন উপজেলা। যদিও উপজেলা সদর কিন্তু সমতলের তুলনায় অনেক অনুন্নত। তবে থাকার জন্যে গেস্ট হাউজ আছে। সেখানে বেশী কিছু আশা করা বোকামী।
৫। রুমাবাজার হিন্দু কালী মন্দিরের পাশে আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করবেন সাথে সাথে। এটাই মুল ক্যাম্প। বাকী গুলো এর আন্ডারে সাব ক্যাম্প। এখান থেকে পার্মিশান পেলে তবেই মুভ করা যাবে। তবে দুপুর ২টার পরে কোন পার্মিশান হয়না। ট্রেকিং করবেন শুনলে এমনিতে আর্মি ক্যাম্প একটু ইয়ে করে। তবে সবসময় ক্যাম্পে সত্যি কথা বলবেন। পথে কোন সমস্যা হলে নির্দিধায় আর্মির হেল্প নেন। আপনার কোন বিপদ হলে ওরা এগিয়ে আসবে। পার্মিশানের জন্যে আপনাকে অবশ্যই একজন বাঙ্গালী স্থানীয় গাইড ভাড়া করা লাগবে। সাধারনত কোন পাহাড়ি গাইড বিরল। আর সব গাইডের নাম ছবি ক্যাম্পে রেজিস্ট্রি থাকে। আন রেজিস্টার্ড গাইড নেবেন না। গাইডের উপরে বেশি ভরষা করবেন না। লারাম বম নামে এলাকায় তুখোড় এক বম কিশোর আছে। তাকে পেলে খুব ভালো।
৬। রাতে রুমাবাজারে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। শপিং করতে পারেন। কিংবা কাছে সুন্দর একটা ফলস আছে। এই মুহুর্তে নাম মনে পড়ছে না। ওটা দেখলেন। খুব সকাল সকাল খেয়ে পর্যাপ্ত ঘুমাবেন। পরিপুর্ন বিশ্রাম এবং খাবার খুব প্রয়োজন।
ঐ দূর পাহাড়ের মাঝে, দিগন্তেরই কাছে... নিঃসঙ্গে বসে একটি মেয়ে গাইছে, আপন সুরে।
৭। খুব ভোড়ে সুর্যদয়ের সাথে সাথে বের হবেন। গাইডের সাথে। তবে গাড়ি পেলে তাড়াহুরার কিছু নেই। সাধারনত ২টা ট্রেইল আছে। ঝিরি পথ এবং গাড়ির রাস্তা। দুটোই সুন্দর। তবে, এডভেঞ্চারের জন্যে ট্রেকাররা ঝিরি পথকে প্রাধান্য দেয়। তবে গাড়ির রাস্তা তে দারুন সব জঙ্গল পাবেন,
৮। সাধারন ট্রেকিং ম্যানুয়াল ফলো করবেন।
৯। কোন ওয়াইল্ড লাইফের ক্ষতি করবেননা। যেখানে সেখানে উচ্ছিষ্ট খাবার বা প্যাকেট ফেলবেন না। শুকনা মৌসুমে এই জঙ্গলটা দাবানলের জন্যে কুখ্যাত ধুমপায়ীরা সাবধানে সিগারেটের বাট নেভাবেন।
১০। বগা লেক আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করবেন। সিয়াম দিদির ঘর বলে একটা কুটির আছে। সিয়াম বম নামের একজন বম আদীবাসী স্কুল টিচার ট্রেকরদের কাছে গন দিদি হিসাবে বিখ্যাত। উনি রেস্টুরেন্ট চালায়। লারাম বম এবং আর্মির যৌথ ব্যাবস্থাপনায় থাকার জায়গা আছে। খুব সম্ভবত ২৫টাকা পার নাইট।
সবুজ পাহাড়ে স্বর্গ বাস।
১১। রাতে বগা লেকে থাকবেন। থাকার জায়গা না পেলে (টুরিস্ট মৌসুমে) পাশের বম পাড়ায় রাত কাটাতে পারেন অথবা লেকের পাশের ভ্যালিতে তাবুতে থাকতে পারেন।
১২। সকালে আর্মি ক্যাম্পের রিপোর্ট করে কেওকারাডং সামিট করবেন।
১৩/ শক্তি আর আগ্রহ থাকলে তাজিংডং ঘুরে আসতে পারবেন।
ট্রেকিংএ অবশ্যই পালের গোদা বা দলপতিকে শাপ শাপান্ত করবেন। কিন্তু নিশ্চিত বলতে পারি, একমাস পরেই গাইতে থাকবেন, কবে যাব পাহাড়ে আহারে আহারে।
একটা ভুল ধারনা দূর করি, অনেকেই বলে তাজিংডং বাংলাদেশে সর্বোচ্চ চুড়া এবং কেওকারাডং ২য়। এটা বিরাট ভুল বোঝা বুঝি। পাহাড়ে এভাবে তুলনা করা নিতান্তই বোকামী। আগেরদিনে ত্রিকোনমিতির হিসাব করত আর আজকাল আছে জিপিএস। জিপিএস রিডিং এ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চুড়া সাকা হাফলং ৩৪৪২ ফিট এবছরের (২০০৮) ফেব্রুয়ারীতে প্রথম এই পাহাড়টা জয় করে একদল সম্পুর্ন অপেশাদার ট্রেকার (ন্যাচার এডভেঞ্চার ক্লাব)। এরপরেই কেওকারাডং। ৩য় মদক ময়াল। তাজিং ডং জিপিএস হিসাবে কেওকারাডং এর চেয়ে অনেক ছোট।
সবার জন্যে শুভ এবং সফল ট্রেকিং ট্রিপের প্রত্যাশায় রইলাম। ইনফর্মেশন বা অন্য কোন হেল্পের জন্যে-
ই-মেইলঃ [email protected]
মেসেঞ্জারঃ [email protected]