
প্রতিদিন ভাবি আমার জীবনের সবচে’ সুন্দর সময়ের কথাগুলো কোন একদিন সময় করে বসে লিখে ফেলি। কিন্তু সেই সুন্দর সময়টা এতটাই সুন্দর আর এমনভাবে আমার জীবনের প্রতিটা মুহুর্তের সাথে মিশে আছে যে তাকে নিয়ে আর আলাদা করে কি লিখব,কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব বুঝে উঠতে পারিনা।
মেডিকেল জীবনটার অপর নাম-ই আমার বা আমার বন্ধুদের কাছে আনন্দ জীবন। সারাজীবন শুনেছি মেডিকেলে পড়লে অনেক কষ্ট,খালি পড়া আর পড়া,দুনিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয়—অথচ আমার কাছে মনে হয়েছে এই জীবনটা শুরু করার পর-ই আমি একটা নতুন জীবনে চলে এসেছি-- যে জীবন শুধু আনন্দ আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। এই আনন্দের কারণ আমার চারপাশের অসম্ভব প্রিয় বন্ধুরা। যাদের মজার মজার কাজকর্ম আর কিছু বোকাসোকা পাগলামি আমাকে প্রতিদিন একটা সজীব জীবন দেয়। সেই আনন্দের কাব্যগুলো নিয়েই আমার আজকের পোষ্ট।
বান্ধবী

মেডিকেলে তখন নতুন ভর্তি হয়েছি। পড়াশোনার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে অস্থির অবস্থা। নতুন নতুন বিষয়—যার কিছুই বুঝিনা। তার উপর স্যার ম্যাডামদের কঠিন চেহারা দেখলে কলিজা শুকিয়ে যায়। আমাদের বায়োকেমিষ্ট্রির হেড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট ছিলেন সুলতানা ম্যাডাম। ভয়াবহ কড়া ম্যাডাম। (এখন ফাষ্ট প্রফ পাশ করে এসে বুঝি ম্যাডাম আমাদের প্রতি কতটা মমতাময়ী ছিলেন)। প্রত্যেকটা ছাত্র-ছাত্রীর গতিবিধি আর চালচলন ম্যাডামের ইতিমধ্যেই জানা হয়ে গেছে। সেই অনুযায়ী ম্যাডাম একটা লিষ্ট করে ফেলেছেন কারা ঠিকভাবে ক্লাস বা পড়াশোনা করেনা। ম্যাডামের সেই লিষ্টে আমাদের ব্যাচের দুইটা ছেলে-মেয়ের নাম ঢুকে গেল—অর্ক আর দৃষ্টি। (বলাই বাহুল্য তারা এখন অনেক সিরিয়াস হয়ে গেছে)। ম্যাডাম একদিন ক্লাসের মাঝে দুইজনকে দাঁড় করালেন। প্রথমে দৃষ্টির দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন-
--তোমার এই অবস্থা ক্যান? কোন কলেজ থেকে পাশ করেছ?
--ম্যাডাম সিটি কলেজ।
--সিটি কলেজের ছেলেমেয়েরা তো অনেক ভালো হয় পড়াশোনাতে। তোমার একি অবস্থা?
দৃষ্টিকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই এরপর ম্যাডাম অর্কের দিকে তাকালেন-
--এ্যাই ছেলে,তুমি কোন কলেজ থেকে পাশ করেছ?
--সিটি কলেজ,ম্যাম।
--ওওও বুঝেছি, সিটি কলেজ থেকে আসা দুই বান্ধবীর-ই দেখি একই অবস্থা!
অর্ককে দৃষ্টির বান্ধবী হিসেবে কল্পনা করে পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ার উপক্রম হল। কিন্তু ম্যাডামের ভয়ে কেউ হাসতে পারলাম না। শুধু ক্লাসের মাঝে মাঝে অনেক কষ্টে চেপে রাখা হাসি মুখ থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণে “ফেচ,হেহহ,ঘোৎ” টাইপ শব্দ কিছুক্ষণ পরপর ভেসে আসতে থাকল। আর এরপর থেকে বেচারা অর্কের নাম হয়ে গেল “বান্ধবী”। অর্কের পৌরুষত্বে প্রথমবারের মত বড়সড় আঘাত!
মাছি তাড়ানো

স্যারদের মুখে বহুবার শোনা একটা কথা--মানুষ নাকি তিনবার ডাক্তার হয়। যখন মেডিকেলে ভর্তি হয় তখন একবার,যখন থার্ড ইয়ারে ঊঠে ষ্টেথোষ্কোপ গলায় ঝুলিয়ে ওয়ার্ডে যায় তখন একবার আর সর্বশেষ যখন ফাইনাল প্রফ পাশ করে সত্যি সত্যি ডাক্তার হন তখন একবার। আমরা যখন দ্বিতীয়বারের মত ডাক্তার হলাম,মানে ষ্টেথো নিয়ে ওয়ার্ডে যাওয়া শুরু করলাম,তখন খেয়াল করলাম আমাদের মধ্যে আসলেই একটা ডাক্তার ডাক্তার ভাব চলে এসেছে। প্রথম দিকে আমরা সবাই বারডেমের ওয়ার্ডে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। (আর এখন ওয়ার্ডে নিমপাতা চেবানোর মত মুখ করে যাই) ওয়ার্ডে যেয়েই আমরা গভীর আগ্রহে রোগীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সম্মানিত রোগীগণ দুই-একটা কথার পরেই বুঝে যান আমরা আসলে তেমন কিছুই জানিনা অসুখ-বিসুখ সম্পর্কে। তখন তাঁরা মুখ ফিরিয়ে পাশের রোগীর অ্যাটেন্ডেন্সের সাথে কথা বলা শুরু করেন। অপমানজনক ব্যপার-স্যাপার।
যাইহোক,মূল ঘটনা আসলে আমাকে নিয়ে। একদিন আমি কিছুটা মধ্যবয়সী এক চাচার কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে সুন্দর করে বললাম,"চাচা আমি থার্ড ইয়ারের একজন ছাত্রী। আপনার সমস্যা না হলে আমি আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলি?” চাচামিয়া হাতটা দিয়ে মাছি তাড়ানোর মত ভঙ্গি করে আমার দিকে তাকালেন। আমি বুঝতে পারলাম উনি আমাকে চলে যেতে বললেন। কিন্তু সেটা তো মুখে বলা যায়,নাকি? আমার একটু মন খারাপ হয়ে গেল। এতদিন রোগীদের সাথে অনেক কথা বলেছি কিন্তু আমার সাথে এরকম ঘটনা কখনো হয়নি। আমি তাই হাল ছাড়লাম না। আমি আবারো গলাটা আরো নরম করে বললাম,"চাচা অল্প একটু কথা বলি আপনার সাথে?” চাচা আবারও কোন কথা না বলে হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করলেন। আশে-পাশে আমার কিছু ফ্রেন্ড পুরো ঘটনাটা দেখছিল। বদ্গুলা এইবার উচ্চস্বরে হেসে ফেলল। আমি তাদের দিকে সন্ন্যাসীর মত ভস্ম করে দেওয়া দৃষ্টিতে তাকালাম। কিন্তু তারা সেই তাকানোকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গিয়ে “হিহিহি” করতেই থাকল। যাইহোক,আমি যখন অন্য আরেকজন পেসেন্টের কাছে যাওয়ার তোড়জোড় করছি,তখন আমাদের এক স্যার সেই ওয়ার্ডে ঢুকে চাচা মিয়ার কাছে গেলেন। আমি চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম যে চাচা মিয়া আমাকে মাছিতুল্য মনে করে কোন কথাই বলেননি সেই চাচা মিয়া স্যারকে দেখে দাঁত বের করে বিগলিত হাসি দিয়ে স্যারের সাথে ননষ্টপ কথা বলা শুরু করলেন। আমি আর কি করি? নিজেকে “ছুড ডাক্তার” মনে করে স্বান্তনা পাওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকলাম!
ডলারের মা

আমাদের মেডিসিন ওয়ার্ডে আমাদের অসম্ভব প্রিয় একজন স্যার হচ্ছেন ডলার স্যার। স্যার অত্যাধিক সুপুরষ। স্যারের কথা বলা,বাচনভঙ্গি,পড়ানোর ষ্টাইল দেখে আমাদের ব্যাচের অধিকাংশ মেয়ে (আমি সহ) স্যারের প্রেমে পড়ে গেলাম। স্যারের ক্লাস করার জন্য আমরা পারলে দশটার ওয়ার্ডের ক্লাস সাড়ে নয়টায় শুরু করি। আমাদের মধ্যে স্যারের প্রেমে অধিক মাত্রায় পড়ল লিজা। সারাদিন তার মুখে একটাই কথা—“ডলার ডলার”! তার মুখে “ডলার ডলার” শুনতে শুনতে আমাদের ‘'ডলার স্যার” প্রীতি মোটামুটি হাওয়া হওয়ার দিকে। ডলার স্যারকে আমরা সবাই স্বত্ত ত্যাগ করে শুধুমাত্র লিজার স্যার হিসেবেই ছেড়ে দিলাম। স্যারের ক্লাসে লিজা সবার আগে যেয়ে স্যারের সামনে দাঁড়াবেই দাঁড়াবে। তো একদিন লিজা স্যারের সামনে যেয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র—এমন সময় স্যার লিজাকে “মা” সম্বোধন করে বললেন—“মা,এই পেসেন্টের অ্যানেমিয়া আছে কিনা দেখো তো?” লিজার মুখের অবস্থা তখন দেখার মত। আমাদের পেটের মধ্যে হাসি গুড়গুড় করছে। সেদিন ওয়ার্ড থেকে ফিরে আমরা কেউ-ই আর লিজার মুখে,”ডলার কি হ্যান্ডসাম,না?” কথাটা শুনিনি। বেচারা লিজা! পিতৃপ্রদত্ত নামটা হারিয়ে সে এখন “ডলারের মা”! ছ্যাঁকা অনেকেই খায়,তাই বলে এভাবে?! বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না,দূরেও সরিয়ে দেয়!
সুগন্ধযুক্ত......

ওর্য়াডে আমাদেরকে সবসময় পেসেন্টের হিষ্ট্রি নিতে হয়। হিষ্ট্রি নেওয়া মানে পেসেন্টের অসুখের উপসর্গ বা কবে থেকে শুরু হল,কি কি সমস্যা হচ্ছে এগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ। একদিন সার্জারী ওয়ার্ডে ম্যাডাম আমাদেরকে এক পেসেন্টের হিষ্ট্রি নিতে বললেন—যিনি মেইনলি পেটে ব্যথার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আমাদের গ্রুপ থেকে মামুন আর রায়হান হিষ্ট্রি নেওয়া শুরু করল। মামুন আর পেসেন্টের কথোপকথন--
--আচ্ছা বাবা,আপনার যে পেটে ব্যথা সেটা কতদিন ধরে?
--দুইমাস হইল ব্যথা বাইড়া গ্যাছে। আগে কম ব্যথা হইত।
--বাবা ব্যথাটা কি পুরা পেটেই হয় নাকি কোন একটা জায়গায়?
--পুরা প্যাডেই।
--আচ্ছা। বাবা ব্যথাটা কখন বেশি হয়?
--পায়খানা করনের সময়।
--বাবা আপনার পায়খানা কেমন হয়? নরম না শক্ত?
--কষা।
--বাবা আপনার পায়খানায় কি দূর্গন্ধ হয়?
--জানিনা। শুঁইক্যা দেহি নাই। (পেশেন্ট এবার স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট বিরক্ত)
এই পর্যায়ে আমাদের ম্যাডাম মামুনকে থামালেন। মামুনের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন-“আবদুল্লাহ,মানুষের পায়খানা কখনো সুগন্ধযুক্ত হতে পারে নাকি?! আমি কিন্তু কখনো শুনিনি!”
নিজের গাধামি টাইপ প্রশ্নে মামুন নিজেই তখন বিব্রত। আর আমরা হাসি চেপে রাখার কাজে ব্যস্ত।
এইসব পাগলামির বা ছাগলামির মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছে আমাদের জীবন। যদিও ঘটনাগুলো অনেক মজার,যখন ঘটেছে আমরা হাসতে হাসতে দম আটকে ফেলেছি কিন্তু এইখানে আমি আমার অলেখকীয় গুনাবলী-র জন্য মজা করে লিখতে পারলাম না। লেখাটা তাই কেমন জানি "বেকুব বেকুব" হয়ে গেল।
(বিরস বদন + চিক্কুর পেরে কান্দনের ইমো হবে)