দূর্গ নামটি শুনলেই কেমন রহস্যময় আর ছমছমে একটি অনুভূতি খেলে যায়!
দূর্গুকে ঘিরে কত কল্পকাহিনী, কত ইতিহাস আর কত রহস্যময়তা!
দূর্গ শুধু কল্পনা বা রুপকথার কোন বস্তু নয়, মানুষের হাতে তৈরি জাঁকজমকপুর্ণ সৌন্দর্য্যের নিদর্শন হিসাবে সেগুলো এখনো পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিদ্যমান! এগুলো সাধারণত মূল শহর থেকে দূরে তৈরি করা হয়েছে। বেশিরভাগ দূর্গ গুলোই নজরকাড়া সবুজের সমারোহ দিয়ে পরিবেষ্টিত যা দূর্গ গুলোকে করেছে আরো আকর্ষনীয়! আসুন সেসব দূর্গ গুলো দেখি এবং কিছু জানতে চেষ্টা করি।
প্রতিটা দূর্গের পোস্টের বর্ণনা শেষে উইকিপিডিয়ার লিঙ্ক দিয়ে দিয়েছি, তাই এগুলো সম্পর্কে যদি আরো বেশি জানতে ইচ্ছা করে ক্লিক করতে ভুলবেন না!
১. Bran Castle (Dracula castle)
এই সেই বিখ্যাত আর গা ছমছম করা দূর্গ! ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা পড়েন নি এমন মানুষ খুজে পাওয়া মুশকিল। যেটা নিয়ে মুভিও তৈরি হয়েছে এবং বেশ ভাল ব্যবসাও করেছে। সেই ভয়ংকর ভ্যাম্পায়ার ড্রাকুলার দূর্গ যা ব্রান ক্যাসল নামে পরিচিত। কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে ড্রাকুলা কাহিনীর স্রষ্টা স্টোকার এই দূর্গটির ব্যাপারে কিছু জানতেন। এটা রোমানিয়ার ন্যাশনাল মনুমেন্ট এবং ব্রান এ অবস্থিত। এটা এখন জাদুঘর হিসাবে জনসাধারন এবং ট্যুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। যদি ড্রাকুলার সত্যিকারের কোন নিদর্শন দেখার জন্য যেতে ইচ্ছুক হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি হতাশ হবে। ওখানে শুধুমাত্র কুইন মেরির সংগ্রহ করা রাজকীয় আসবাব পত্র এবং রোমানীয় শিল্পকে তুলে ধরা হচ্ছে।
উইকি লিঙ্ক
২. Chambord Castle (ফ্রান্স)
এই প্রাসাদটি মূলত নির্মিত হয়েছিলো Francois I এর মাধ্যমে, উদ্দেশ্য ছিলো উপপত্নীর সাথে মিলিত হওয়া। কিন্ত সম্পর্ক শেষ হবার সাথে তিনি এই প্রাসাদটির কথাও ভুলে যান। এর দৈত্যাকার হলওয়ে এবং অন্যান্য অলংকৃত আসবাব সব নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাকিগুলো চূর্ন-বিচূর্ন করা হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাকে আবারো সংস্কার করা হয়।
উইকি লিঙ্ক
৩. Matsumoto Castle (জাপান)
মাতসুমতো দূর্গ আরেকটি নামেও সুপরিচিত, “ক্রো ক্যাসল” এর কালো বহিরাবরনের জন্যই এমন নাম। জাপানের মাতসুমতো শহরে অবস্থিত এই প্রাসাদটি ঐতিহাসিক দূর্গ গুলোর মধ্যে অন্যতম।
উইকি লিঙ্ক
৪. Segovia Castle (স্পেন)
সেগোভিয়া দূর্গ মূলত পাথরের তৈরি, স্পেনের পুরানো শহর সেগোভিয়ায় অবস্থিত। গুয়াদারেমা মাউন্টেইন এর কাছে এরেজমা এবং ক্লামোরেস নদীর সঙ্গমস্থলে এটি মাথা উঁচু করে আছে। গড়নের দিক থেকে এটা স্পেনের সর্বাপেক্ষা স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের দূর্গ-জাহাজের বোঁ এর আদলে গড়া। এটাকে প্রাসাদ হিসাবেও ব্যবহার করা হত। আমাদের বাংলাদেশের ধানমন্ডি লেকের পাশেও এরকম বৈশিষ্টের দূর্গের একটি ছোটখাটো নমুনা দেখে থাকবেন।
উইকি লিঙ্ক
৫. Pena Castle (পর্তুগাল)
এই দূর্গটি পর্তুগালের সিন্ত্রা শহরের একটি পাহাড়ের উপরে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রোদ ঝলমল দিনে লিসবন শহর থেকেও সহজে দেখা যায়। এটা পর্তুগালের জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং উনবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিসিজমের এক প্রধাণ অভিব্যক্তি হয়ে বিশ্বের বুকে আজো দাঁড়িয়ে আছে।
উইকি লিঙ্ক
৬. Frederiksborg Castle (ডেনমার্ক)
ফ্রেডারিক্সবর্গ দূর্গ হচ্ছে ডেনমার্কের একটি জলদূর্গ যা ড্যানিশ আইল্যান্ডের হিলারডে অবস্থিত। এটা রেনেসাঁ এবং আজকের যুগের বৃহত্তম এবং খুব ই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এটা এখন ডেনমার্কের জাতীয় জাদুঘর।
উইকি লিঙ্ক
৭. Castle de Haar (নেদারল্যান্ড)
হার দূর্গ বা ক্যাসল দ্য হার নেদারল্যান্ডের Utrecht প্রদেশের হারজ্যুলেন্সে অবস্থিত। দূর্গটি এ পর্যন্ত বহুবার ভেঙ্গে পুনঃনির্মান করা হয়েছে যেহেতু এটা ১৩৯১ সালের ব্যাকডেটেড কনসেপ্ট ছিল। দূর্গের ভেতরে কয়েক শত রুম এবং ডজনের উপরে বাথরুম আছে। তাছাড়া এর অভ্যন্তরীণ কাঠের জটিল কাজ ও নজরকাড়া!
উইকি লিঙ্ক
৮. Bodiam Castle (ইংল্যান্ড)
বদিয়াম দূর্গ হচ্ছে চতুর্দশ শতাব্দীর একটি পরিখাবেষ্টিত দূর্গ যা ইংল্যান্ডের ইস্ট সাসেক্সের রবার্টসব্রীজের কাছে অবস্থিত। দূর্গটি ১৩৮৫ সালে স্যার এডওয়ার্ড ডেলিনগ্রীগ (তৃতীয় এডওয়ার্ডের একজন সাবেক নাইট ছিলেন) এর মাধ্যমে নির্মিত হয়। এটি বাহ্যত ফ্রান্সের বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো।
উইকি লিঙ্ক
৯. Trakai Island Castle (Lithuania)
ট্রাকাই আইল্যান্ড দূর্গ লিথুনিয়ার গালভ লেকের সুদৃশ্য নীলপানি দ্বারা পরিবেষ্টিত ট্রাকাই আইলান্ড নামক একটি ছোট দ্বীপে অবস্থিত। দূর্গটির নামকরণ যে দ্বীপের নামের সাথে সাদৃশ্য রেখেই করা হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। এখানে দ্বীপ শুধু একটি নয়, ট্রাকাই আইল্যান্ডের মত ছোটখাটো আরো বেশ কয়েকটি দ্বীপ সেখানে আছে।
দ্বীপের মাঝে দূর্গটি দেখলেই মনে হয় পৃথিবীর মাঝে ছোটখাট একটি স্বর্গ! মনে হয় এক্ষুনি ছুটে চলে যাই ওখানে! দূর্গটি মূলত পাথরের তৈরি যার নির্মাণ শুরু হয়েছিলো চতুর্দশ শতাব্দীতে কেস্তুতিস এর মাধ্যমে, ১৪০৯খ্রিঃ এর দিকে এর বেশিরভাগ কাজ ই কেস্তুতিসের ছেলে ভিতোতাস দ্য গ্রেট এর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ভিতোতাস দ্য গ্রেট ১৪৩০ সালে এই দূর্গের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন।
উইকি লিঙ্ক
১০. Kilchurn Castle (Scotland)
কিলচার্ন দূর্গ পঞ্চদশ শতাব্দীর দিকে ধ্বংস হয়ে যায়। ঐ শতাব্দীর ই মধ্যদিকে স্যার কলিন ক্যাম্পবেল এটি পুনঃনির্মান করেন এবং ১৬৯৩সালের দিকে এটিকে আরো বড় করা হয়। সেসময় দূর্গটি ব্যারাক হিসাবে ব্যবহৃত হত। এর চারপাশের ফটোগ্রাফিক সিনারী এতটাই মনোমুগ্ধকর যে বর্তমানে এটি স্কটল্যান্ডের অন্যতম একটি ট্যুরিস্ট স্পট হিসাবে পর্যটকদের কাছে সমাদৃত। এখন দূর্গটি শুধুমাত্র সামারে খোলা থাকে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর)।
উইকি লিঙ্ক
১২. Gripsholm Castle (Sweden)
গ্রিপসম দূর্গ সুইডেনের সোদারম্যানল্যান্ডের ম্যারিফ্রেডে অবস্থিত ম্যালারেন লেকের সুনীল জলরাশি এবং সবুজ গাছপালা দিয়ে পরিবেষ্টিত। এটি সুইডেনের ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৫৩৭ সালে গুস্তভ ভাসা এটি নির্মাণ করেন, তাই এটি গুস্তভ ভাসা’স ক্যাসল নামেও পরিচিত।
উইকি লিঙ্ক
১৩. Burg Eltz (Germany)
যারা জার্মানীতে থাকেন তাদের জন্য বার্গ এল্টজ দূর্গ অনেক পরিচিত একটি স্ট্রাকচার বলা যেতে পারে। এক সময় জার্মানীর মুদ্রার একপিঠে এটির ছবি ছিল, বর্তমান খবর জানিনা। এটি এখন এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যাদের এই দূর্গটির উপর মালিকানা আছে তাদের উত্তরসূরি ই এখানে আছেন। এর ভিতরে ট্যুরিস্টদের জন্য দু’টি সেলফ সার্ভিস রেস্টুরেন্ট আছে।
উইকি লিঙ্ক
১৪. Neuschwanstein Castle (Germany)
এই দূর্গটিকে ওয়েগনার্স মিউজিকের স্থাপত্য সংস্করণ হিসাবে বিবেচিত করা হত! সত্যিকার অর্থেই দূর্গের গঠন, পরিবেশ, ডিজাইন...একটা শিল্প বলা যায়! রিচার্ড ওয়েগনার ছিলেন সেসময়ের পৃথিবী বিখ্যাত একজন কম্পোজার, এবং কিং লুদউইগ তার খুব ভক্ত ছিলেন। দূর্গটি খুব বেশি পুরোনো নয়, উনবিংশ শতাব্দীর দিকে দ্বিতীয় কিং লুদউইগ এর মাধ্যমে এটা নির্মিত হয়। এটা জার্মানীর জনপ্রিয় দূর্গগুলোর একটি এবং ইউরোপের ট্যুরিস্টদের ট্যুরতালিকায় থাকা অন্যতম একটি স্থান।
উইকি লিঙ্ক
১৫. লালবাগ দূর্গঃ
এত ঝকঝকে-তকতকে একটি দূর্গ বাংলাদেশে আছে না গেলে জানাই হতনা!
সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলায় মোঘল শাসকদের শাসন এবং স্থাপত্য বিকাশের এক ঐতিহাসিক ক্ষেত্র এই লালবাগ দূর্গ যা লালবাগ কেল্লা নামে সুপরিচিত। লালবাগ কেল্লা নির্মাণের রুপকার হিসাবে শায়েস্তা খানের নাম পাওয়া গেলেও মূলত এটি নির্মাণের পরিকল্পনা এবং নির্মাণ শুরু হয়েছিলো মোগল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মুহাম্মদ আজম শাহের মাধ্যমে ।
আজম শাহ ১৬৭৮ থেকে ১৬৭৯ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ছিলেন। আজম শাহ এটির নির্মাণ কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যে দিল্লী থেকে জরুরী তলবে ঢাকা ছেড়ে দিল্লী চলে যান এবং যাবার আগে তার স্থানে অভিষিক্ত নতুন সুবেদার শায়েস্তা খানকে নির্মাণ কাজ সম্পুর্ন করতে অনুরোধ করে যান। শায়েস্তা খান ১৬৮০ সালে ঢাকা এসে প্রাসাদ দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৬৮৪ সালে তাঁর আদরের কন্যা পরিবিবির আকস্মিক মৃত্যু হলে একে তিনি অশুভ লক্ষণ মনে করে কাজ বন্ধ করে দেন। কেল্লা নির্মাণ না করলেও তিনি তার কন্যার মাজার কে দর্শনীয় স্থাপনা বানিয়ে তুলেন। মাজারটি নির্মাণে শায়েস্তা খান ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিয়ে আসেন।
আজকের ছিমছাম আর নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে ভরা এই লালবাগ দূর্গের সাথে জড়িয়ে আছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হলে লালবাগ দুর্গে থাকা দেশীয় সিপাহিরা বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সৈন্যরা অভিযান পরিচালনা করলে ৩৭ জন সিপাহি নিহত এবং অসংখ্য সিপাহি আহত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সেনানিবাস লালবাগ দুর্গ থেকে সরিয়ে তেজগাঁও নেওয়া হয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫৩ সালে বাঙালি পুলিশরা পশ্চিম পাকিস্তানের পুলিশের সমান বেতন-ভাতার দাবিতে ধর্মঘট শুরু করে। তখন দুর্গটি পুলিশ হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের জেওসি ছিলেন আইয়ুব খান। তিনি বাঙালি পুলিশদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে উত্তেজনা প্রশমিত করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে হঠাৎ সামরিক অভিযান চালিয়ে বহু বাঙালি পুলিশকে হত্যা করা হয়। এভাবে লালবাগ দুর্গ আরেকবার বাঙালিদের রক্তে রঞ্জিত হয়।
এসব কারণে দুর্গের বিভিন্ন অংশের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। অবশেষে নির্মাণের তিন শ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয় এবং সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়। ফলে এটি ঢাকার তো বটেই, দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হেরিটেজ সাইটে পরিণত হয়। এখন প্রতিদিন দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক, ভ্রমণপিয়াসী মানুষ লালবাগ দুর্গ দেখার জন্য এখানে ভিড় করেন।
*** শনিবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে বেলা একটা এবং বেলা দুইটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত লালবাগের কেল্লা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।
উইকি লিঙ্ক