সাত সকালে যদি আমার ফোন শব্দ করে আমার চেয়ে বিরক্তকর প্রাণী আর কেউ হবে না। তার পরেও এক চোখ খুলে দেখলাম কে আমাকে সাত সকালে স্মরণ করছে। খুব খুব কাছের এক বড় ভই। রাহিন ভাই। আমি ফোন ধরে ঘুম ঘুম গলায় বললাম কে? ভাই মনে হয় আমার কথা ভালো ভাবে শুনতে পায়নি। উনি বললেন তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস? আমি ঠিক আগের মতো গলাতেই বললাম ভাই আপনি কাকে চাচ্ছেন? আপনি রঙ নম্বরে ফোন করেছেন।
এবার মনে হয় উনি ভড়কে গেলেন, অবাক হয়ে বললেন এটা নিয়নের নম্বর না?
-ভাই আপনি গতো চার বছর ধরে এই এক নম্বরেই কল দিচ্ছেন আজ এইটা অন্য কারো হওয়া সম্ভব না, আপনার সাথে মজা করছিলাম, এবার বলেন ফোন করছেন কেন এই কাক ডাকা ভোরে।
-নতুন একটা কেস পাইছি তুই এখুনি আমার বাসায় চলে আয়।
-ভাই ঘন্টা খানিক পরে যাই, সারা রাত কাজ করছি আর একটু ঘুমাই।
-হাতে বেশি সময় নাই, এই এখুনি চলে আয়।
ফোন রাখার পর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো, ফোনটা রিসিভ করায় ভুল হইছে। আমাদের গয়েন্দা হওয়ার শখ অনেক দিনের, অনেক স্বপ্ন নিয়ে রাহিন ভাইয়ের বাড়ির ছাদের চিলে কোঠার একটা ঘরে আমরা আমাদের অফিস বানালাম। টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে একটা লেপটপ, চেয়ার টেবিল, আতস কাচ, শার্লক হোমস সমগ্র, ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সীর বই আর ছবি কিনে ঘর ভর্তি করে ফেলা হলো। এবার পড়লাম মহা সমস্যায়। আমরা তো আর গল্পের গোয়েন্দা না যে আমাদের খুজে কেউ কেস দিয়ে যাবে, তার চেয়ে বড়ো কথা খুন-বড়ো বড়ো চুরি কেসে পুলিশ কখনো আমাদের মাথা ঘামাতে দেবেনা তাহলে কি বাসা বাড়ির বারান্দা থেকে কাপড় চুরি আর ফুলের টব চুরির কেসে মাথা ঘামাবো নাকি? রাহিন ভাই অবশ্য এর সমাধান বের করলেন, ওনার আইডিয়া অনুযায়ী পেপারে আমরা এড দিলাম, টানা কয়েক দিন এড দিলাম, কোন ফল পেলাম না, আসা প্রায় ছেড়ে দিছি। চার পাঁচ দিন পর একটা ফোন আসলো। এক মেয়ে গলা। আমিই ফোনটা ধরলাম। ওপাস থেকে মেয়েটা বলল এইটা কি প্রাইভেট ডিটেকটিভ অফিস? আমি মিষ্টি গলায় বললাম জী আপু। রাহিন ভাই আমার দিক তাকালো বোঝা যাচ্ছে আমার আপু বলা ওনার পছন্দ হয়নি, নিশ্চয় ম্যডাম জাতিও কিছু একটা বলা উচিৎ ছিলো।
-আমার একটা হেল্প লাগবে।
-আমরা হেল্প করার জন্যই আছি, বলেন আপনার সমস্যা।
-তার আগে বলেন আপনাদের ফি কেমন, আমার ফি নিয়ে কোন সমস্যা নেই শুধু আমার কাজটা করে দেন আপনি।
-আসলে আমরা ফি নেই না, গয়েন্দাগিরি করি শখের বসে, বলেন আপনার সমস্যাটা কি?
-আমার হাজবেন্ড মনে হয় আর একজনের সাথে সম্পর্কে জড়ায় গেছে। আমার জানা লাগবে মেয়েটা কে?
যা ভয় পাচ্ছিলাম, এই টাইপ কিছু একটার কেসেই আসবে। আমি চাচ্ছিলাম না প্রথম কেস এই সব দিয়ে শুরু করতে। তাই কোন মতে দু চারটা কথায় ফোনটা রেখে দিলাম।
এর পর আর কোন কেস পাইনি। আজ আবার রাহিন ভাই ফোন দিলেন নতুন কেস নাকি তিনি পাইছেন। এখন গিয়ে পুরো গল্পটা শোনা লাগবে আবার সেই বাড়ির বিড়াল খোজা টাইপ কোন কেস নাকি!!!!!
চিলাকোঠার ঘরে ঢুকে দেখি রাহিন ভাই শার্লক হোমসের মতো বসে আছেন শুধু পার্থক একটায় পাইপের বদলে সিগারেট। আমাকে দেখে নড়ে চড়ে বসলেন, বুঝলি নিয়ন এবারের কেসটা একেবারে খাসা। আর অনেক বড়ো একটা কেস।
আমি মনে মনে বললাম শার্লক হোমসের বাংলা অনুবাদ পড়ে ঐ ভাষায় কথা বলা শুরু করেছে। ভালো ভালো চালায় যাও।
-ভাই এবার বলেন কেসটা কি নিয়ে?
-সামনে মোড়ের জাদুঘরটা থেকে গত কাল রাতে একটা মূল্যবান মূর্তি চুরি গেছে, জাদুঘরের কতৃপক্ষ চাচ্ছেনা কেউ বেপারটা জানুক। পেপার পত্রিকায় আসলে সম্মানের প্রশ্ন দাঁড়াবে তাই তারা চায় আমরা এই কেসটা হাতে নেই। আমি মনে মনে খুশি হয়ে গেলাম। এরকমের একটা কেসের অপেক্ষায় ছিলাম।
রাহিন ভাই উঠে দাড়ালো, চলো গিয়ে দেখে আসি কি অবস্থা। সকাল নয়টায় জাদুঘর খোলে তার আগে আমাদের জায়গাটা দেখে আসা লাগবে। এখন সবে সকাল সাড়ে সাতটা ।
আতস কাচ, ব্লু ভিউ ক্যমেরা নিয়ে আমরা জাদুঘরে ঢুকলাম । গত রাতে বৃষ্টি হওয়ায় জুতার দাগ খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। আতস কাচের আর প্রয়োজন পড়লো না আমার। রাহিন ভাই কিন্তু আতস কাচ দিয়েই দেখছেন খুব মনযোগ দিয়ে। দু তিন মিনিট দেখার পর উনি মুখ তুলে তাকালো।
-বুঝলি নিয়ন তিন জন মানুষ এসেছিলো এই মূর্তি চুরি করতে। এই চুরির পরিকল্পনা একজনের তবে ,বাকি দুজনকে নিয়ে এসেছে সাহায্য করতে।
এবার আমি সত্যি অবাক হয়ে গেলাম। ভাইয়ের ঘাড়ে কি শার্লের ভুত চাপছে নাকি শার্লক হোমসের মতো হওয়ার ভান করতেছে। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আপনি কি ভাবে বুঝলেন?
আমি দুটা সিগারেটের গোড়া পাইছি একটা দামি আর একটা কমদামি। দামিটা হাফ খেয়ে ফেলেছে। কমদামিটা পুরো শেষ করা এমনকি ফিল্টার হালকা পুড়েছে তার মানে কমদামিটা দুজন খেয়েছে। আর তারা যদি বন্ধু বা খুব কাছের হইত তিনজনেই দামিটা খাইত। ব্যাপারটা পরিস্কার যে দুজন টাকার জন্য সাহায্য করতে এসেছে।
-তিনজন কি ভাবে বুঝলেন? চার জনও থাকতে পারে?
-গাধা কাদায় জুতার দাগ খুব ভালো ভাবেই বলতেছে তিনজোড়া।
আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগতেছে, কারন সাহস করে তো কেস হাতে নিলাম কিন্তু সমাধান কি করতে পারব? এমনিতে একই পাড়ার জাদুঘর। না পারলে মান ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে।
রাহিন ভাই মনে হয় আমার মুখের দিক তাকায় আমার অবস্থা বুঝতে পারছে। একটা হাসি দিয়ে বললো উপরে তাকায় দেখ কাচের সেন্সরের তার গুলো কাটা। আমি উপরে তাকাতে মনে পড়লো এখন সব জায়গায় সিসি ক্যমেরা থাকে অথচ এই ঘরে কোন সিসি ক্যমেরা নেই। ব্যপারটা একটু অবাক হওয়ার মতো
আমরা রেজিস্ট্রি খাতাটাও দেখলাম। গতো কাল কতোজন মানুষ এসেছে। বুঝলাম মানুষ জন আর জাদুঘরে আসেনা। সারা দিনে মাত্র তেরো জন। জাদুঘর থেকে বের হওয়ার সময় আমাদেরকে এতোক্ষন যে লোকটা সব দেখাচ্ছিলো তাকে প্রশ্ন করলাম মূর্তিটার কতো দাম হতে পারে? লোকটা কিছুক্ষন চিন্তা করে বললো তিন চার লাখ টাকা হবে।
আমরা আমাদের চিলেকোঠায় ফিরে আসলাম। আমি দুকাপ চা বানায় সবে চেয়ারে বসে চুমুক দেব জাদুঘরের ইন-চার্জ ফোন করলেন।
-একটা বিশাল সমস্যা হয়ে গেছে। বড়ো অফিসার আজ এখানে আসবে। যে ভাবেই হোক দুপুরের মাঝে মূর্তি বাহির করা লাগবে নাহলে আমার চাকরি থাকবেনা।
আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দিল। আমি অবাক হয়ে বললাম এটা কিছু হইলো? কি ভাবে সম্ভব এতো তাড়াতাড়ি এই চোর ধরা। বুঝা গেছে এইটা unsolved এর খাতায় ফেলাতে হবে। ধুর প্রথম কেসটায় unsolved
রাহিন ভাই মাথা নিচু করে আছে, মুখটা হালকা দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে পেটের ব্যথায় মুখটা এমন করে আছে। আসলে উনি গভীর চিন্তায় আছে। আমিও গভীর চিন্তায় আছি যদি আমাদের প্রথম কেস unsolved এর খাতায় যায় তো বন্ধুদের সামনে মুখ দেখানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।
রাহিন ভাই আমার দিক তাকালো, মনে হচ্ছে উনি পেটের বেথায় দাড়াতে পারবেনা আমার দিক তাকায় সাহায্য চাচ্ছেন ওনাকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি বললাম ভাই কি বাথরুমে যাবেন?
আমার কথা শুনে মনে হয় উনি আকাশ থেকে পড়লেন। মুখটা এবার স্বাভাবিক করে বলল চলো বের হই। বাহিরে গিয়ে চা খাই।
আমি বিরক্ত মুখে বললা ঘরেই তো চা আছে বাহিরে যাওয়ার দরকার টা কি?
রাহিন ভাই হাসি মুখে বলল দরকার আছে বলেই বলছি, চল বাহিরে চা খাই।
আমরা জাদুঘরের সামনে এক চায়ের দোকানে বসলাম। এক হাতে চা আর এক হাতে সিগারেট নিয়ে বেমালুম ভুলেই গেলাম কেসের কথা। ভাবতে শুরু করলাম আজ ফেইজবুকে কি ছবি আপলোড করবো।
আবার বাস্তবে ফিরে আসলাম, ফিরে আসার কারন মনে পড়লো, সিসি ক্যমেরাটার কথা। রাহিন ভাইকে বললাম আপনি কি খেয়াল করেছেন সিসি ক্যমেরা নেই?
-হ্যা, তখন জাদুঘরের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করেছি, উনি বললেন আগের গুলো পরিবর্তন করা হচ্ছে। এখন নতুন মডেলের আরো ভালো লাগাবে তাই কাল খুলে নিয়ে গেছে, আজ ভাল গুলো লাগাবে।
-আচ্ছা এই সিসি ক্যমেরা লাগানোর লোক গুলো চুরি করেনি তো ? কারন ওরা গত কাল এসে দেখে গেছে আর ওদের নামও রেজিস্ট্রি খাতায় নেই। মূর্তি দেখে হয়ত লোভ সামলাতে পারেনি তাই রাতে চুরি করেছে।
রাহিন ভাই গম্ভির মুখে বলল সম্ভবনা আছে, তবে যেই চুরি করুক সে খুব ভালো ভাবে জানে গত কাল রাতে সিসি ক্যমেরা ছিলোনা। আর সবাই মূর্তি চুরি করবেনা সবাই যানেনা কোন মূর্তি কেমন দামি। যে চুরি করছে যে খুব ভালো ভাবেই জানে ঐটার দাম কতো।
-ভাই আমরা কি বিকালের মধ্যে চোর ধরতে পারব নাকি unsolved এর খাতা খুলব?
-আর কিছুক্ষনের অপেক্ষা কর চোর ধরা পড়বে।
আমরা দোকান থেকে বের হচ্ছিলাম ,আমি বলেতে যাচ্ছিলাম কি ভাবে চোর ধরা পড়বে আগেই রাহিন ভাইয়ের পায়ে লেগে দোকানের সামনে একটা পানির বাল্টি উল্টে পড়ে গেলো।
আমরা চায়ের দোকানের সামনে রোদে দাঁড়ায় সিগারেট টানতেছি , ভাই হটাৎ দোকানের ভেতরে আবার গেলেন। প্রায় পাঁচ মিনিট পর দোকান থেকে বের হয়ে হাসি হাসি মুখে বলল চোর কে আমি বুঝছি।
আমি বললাম কে? চায়ের দোকানদার? আপনি যে ভাবে দোকানে ঘাপটি মারছেন তাছাড়া জাদুঘরের সামনে দোকান, চুরি করার সম্ভাবনা আছে। রাহিন ভাই হাসতে হাসতে বলতেছেন না, চায়ের দোকানদার না,দাড়া জাদু ঘরের ইন-চার্জকে ফোন করি।
রাহিন ভাই জাদু ঘরের ইন-চার্জকে ফোন করে বলল আপনাদের জাদুঘরের ম্যনেজার চুরি করেছে , তাকে শক্ত ভাবে ধরেন, বলে দেবে।
আমি রাহিন ভাইয়ের দিক তাকায় বললাম আপনি কিভাবে এতো নিশ্চিত হচ্ছেন ম্যনেজার চুরি করেছে, বেচারা ভালো লোকটাকে আপনি ফাসায় দিচ্ছেন!
মোটেও না। লজিকালি চিন্তা কর ম্যনেজারের পক্ষে জানা সহজ সিসি ক্যমেরা ছিলো কি না
-হুম
-ম্যনেজার জানে কোন মূর্তির দাম কতো।
-কথা সত্য
-একটু আগে ম্যেনেজার চায়ের দোকানে ঢুকলো খেয়াল করছিস?
-হ্যা
আমি ইচ্ছে করে বাল্টির পানি ফেলছি কাদা করার জন্য, এর পর জাদু ঘরের সবারি পায়ের ছাপ চেক করতাম যে যে চা খেতে আসে, প্রথমেই মিলে গেছে ঐ ম্যনেজারের পায়ের ছাপের সাথে আরো একটা ব্যপার আছে।
-কি?
কাল দামি যে সিগারেটের গোড়া পাইছি ম্যানেজার সেই একই সিগারের কিনেছে।
আমি মনে মনে একটা শান্তি পেলাম যাক আমাদের প্রথম কেসটার সমাধান হইছে, মজার ব্যপার হচ্ছে এক বেলাতেই।
রাতে জাদুঘরের ইন-চার্জ সাহেব আমাদের চিলেকোঠায় আসলেন। হাতে বিশাল এক উপহারের প্যকেট। রাত দশটা অবদি আমাদের সাথে আড্ডা দিলেন। উনি চলে যাওয়ার পর আমি উপহারের প্যকেট খোলার জন্য হাত দিলাম কিন্তু রাহিন ভাই বাধা দিলো। বলল খোলার আগে নিশ্চিত ভাবে বলা লাগবে ভেতরে কি আছে। আমি যাই বলি উনি বলে ভুল, অথচ উনি প্যকেট না খুলেই জানেন ভেতরে কি আছে। আমার উত্তর সঠিক হয়না কখনো তাই আর খোলাও হয়না।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৬ রাত ৯:০৩