সকাল ৭.২০ এ আমি যখন গন্তব্যে যাবার উদ্দেশে বাস স্ট্যান্ডে দাড়াই ঠিক তখনই দেখি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে । জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস আসবে , উল্কা ১ । বাসটার নামের সাথে তার চেহারার কোন মিলই নেই। জবরথবর করতে করতে আসে জবরথবর করতে করতে যায়। বিআরটিসি’র পুরনো দোতলা বাস। উল্কা আসার পরেই আমার গন্তব্যের বাস আসে। আমি ও ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকি আর অপেক্ষা করি কখন ওদের বাসটা আসবে আর কখন আমারটা।
মোটামোটি মানের স্বাস্থ্যর একটা ছেলে প্রায় প্রতিদিনই আমার পাশে এসে দাঁড়ায় আর পাশের খালার দোকান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে জোরসে আরামে ফুঁকতে থাকে। ছেলেটা আমার পাশে এসে দাঁড়ায় বললে ভুল হবে আমারা আসলে দুজনই ওই খালার টং এর পাশে দাঁড়াই কারণ রাস্তার বালু, মাঝে মাঝে রোদ, কিংবা গাড়ী গুলোর হুঙ্কারে ভয় পেয়ে।
তাই আমি না পারি তারে কিছু বলতে, না পারি সইতে। সে হয়তো ভাবে আমি ও সিগারেট খাই আর এই ধোঁয়াটাও আমার খুব পছন্দ। একটা জিনিষ খেয়াল করলাম কখনই সে সিগারেটটা শেষ করতে পারে না অর্ধেক না যেতেই বাস আসে আর সিগারেটটা ভূপতিত হয় মাটিতে। পা দিয়ে একটা ডলা দিয়ে বাসে উঠে যায় সে। আমার বাস যেহেতু পরে আসে আমি তাই মনের রাগটা মেটানোর জন্য ওই সিগারেট খণ্ডটাকে আরও পিষে দেই।
ছেলেটার সাথে আমার ওই জায়গাটায় দাড়িয়ে থাকা হয় সর্বচ্ছো ৬ কি ৮ মিনিট। এর মাঝে সে সিগারেট কিনে খালার সাথে কথা বলে আর অর্ধেক টেনে ফেলে চলে যায়। তাই আমি যে ওর সাথে একটু কথা বলবো তারও কোন সুযোগ নেই ।
গত কয়দিন আগে ছেলেটা আসার পর খালার দোকানে সিগারেট নিতে যাবার সময় তাকে জিজ্ঞেস করলাম ভাই কয়টা বাজে? সে আমার হাতের ঘড়ির দিকে কাঁধ বাঁকা করে তাকিয়ে বলল আপনার ঘড়ির হিসেব মত ৭.২৫ আর আমার ঘড়ি বলছে ১২ টা।
শুনে আমি কিছুটা লজ্জিত হতভম্ব হয়ে বাম হাতের শাটের হাতাটা টানতে থাকলাম।
সে যথারীতি সিগারেট ধরিয়ে আমাকে বললঃ
- ব্যাপার না আমিও আগে কারো সাথে কথা বলার জন্য এই কমন টেকনিকটা ব্যবহার করতাম। পরে দেখলাম এটার থেকে সোজাসোজি প্রশ্ন করাই ভালো। আমি বিপুল। আপনি?
- আমি আসাদ।
- হুম আমার আসাদ নামের এক বন্ধু ছিল এখন আর নাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম
- কেন এখন নাই কেন?
- আরে ধুর বাদ দেন, সে ম্যালা কথা। আপনি যান কই?
- আমি কারওয়ান বাজার আপনি? ( এই প্রশ্নটা করে আমি নিজেকেই একটা তিরস্কার করলাম, কারন আমি নিজেই দেখি সে উল্কাতে উঠে আবার তাকে একটা অবান্তর প্রশ্ন, উফ কি যে করি!! )
প্রশ্নটা করার পর সে আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল
- এইতো ভার্সিটির আশে পাশে যাই।
উত্তর শুনে আমি একটু কৌতূহলীবশত তাকে জিজ্ঞেস করলাম ।
- মানে?
- মানে ভার্সিটির আশে পাশে।
হুম আমি ভাবতে থাকলাম এই পোলা ভাব লওয়া শুরু করছে। থাক বাদ দি কথা বলার দরকার নাই। একটু চুপ থাকলাম কতক্ষন।
একটু পর বিপুল নিজেই জিজ্ঞেস করলো
- আপনি কি চাকরি করেন?
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম
- না, ইন্টার্নশীপে আছি একটা ফার্মে ।
বিপুল তখন বলল
- হুম ভালো। আপনি বিশ্বাস করলেন না যে আমি ভার্সিটির আশে পাশে যাই তাই না?
আমি বললাম
- না তা না, আসলে ভার্সিটির বাসে যান তো তাই ভাবলাম নিশ্চয়ই পড়াশুনা করছেন।
বিপুল বলল,
- না আপনার অনুমান একবারে ভুল ও না । ছিলাম এককালে ছাত্র ছিলাম এখন আর ছাত্র নাই এখন অছাত্র।
- হুম তা পাশ করলেন কবে?
- নাহ ভাই পাশটাই করতে পারলাম না।
মিনিট খানেক তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এবার সে আবার বলতে শুরু করলো
- বাবা মা থাকে নরসিংদী, ছোট্ট একটা বোন আছে বাড়িতে, ছোট্ট বললে ভুল হবে সবাই নাকি বলে ওর বিয়ে দেয়া দরকার কিন্তু বোন তো, তাই ছোট্টই বলি। ইন্টারের পর যখন জগন্নাথ এ ছান্স পাই কৃষক বাবা এতটুকুই বুঝেছিল যে ছেলে আমার বিলেত যাচ্ছে পড়াশুনা করতে। বাজারের কালিদাস মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি এনে সবাইকে বলে বলে খাইয়েছে। বাড়ি থেকে আসার সময় মা আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিয়ে আমাকে বলল-
“বাবা ঢাকা শহর নাকি অনেক বড়, মানুষ ওইখানে যায় আর সবাই বড় হয়, দোয়া করি বাবা তুমি ও বড় হইয়ো”।
বিপুল কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে ফেললো। আমি অপলক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সিগারেটের ধোঁয়াগুলোকে সে গোল গোল করে ছাড়ছে আর কথা বলছে।
বিপুল আবার বলতে শুরু করলো-
- ক্যাম্পাসে এসে বুঝলাম বাস্তবতা ভালো না। কয়দিন পর ক্ষমতা, শক্তির জন্য পলিটিক্স এ জড়িয়ে পড়লাম । বড়ভাইদের কথায় চলতাম, মিছিল করতাম, যখন গাড়ী ভাঙ্গা লাগতো গাড়ী ভাঙতাম, ফাও খেতাম, টিজ করতাম দেদারসে। মনে হতে লাগলো আমি এক অন্য জগতে। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো পরে দেখলাম সব ঠিক হয়ে গেছে। বাড়ীতে ফোন দিতাম আর বলতাম
- আব্বা টাকা পাঠান, সেমিস্টার ফি লাগবে।
বাপ হন্তদন্ত হয়ে টাকা যোগাড় করতো। আর বলত বাবা লিখাপড়া খুব কষ্টের ভাল মত কইরো।
আমি এতক্ষণ নিরব হয়ে ওর কথা গুলো শুনছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম পড়াশুনার কি হলো ??
বিপুল আবার বলতে শুরু করলো-
- আরে ভাই পড়াশুনা তো তখন টালে। ফাস্ট ইয়ারে নকল করতে গিয়ে ধরা পড়লাম। স্যার হল থেকে বের করে দিবে সে সময় বড় ভাইরা এসে আমারে বাঁচায়। সে দিন শা***ন (স্যারের নামটা দিলাম না) স্যার আমাকে বললো, বিপুল আজ তুমি বেঁচে গেলে, কিন্তু এভাবে আর কতদিন বাঁচবা ? স্যারের কথাই ঠিক হয়েছিল। বেশিদিন বাঁচতে পারিনি। এরপর ক্যাম্পাসে এক সুন্দরীর প্রেমে পড়লাম। বড়লোক বাবার বড়লোক সন্তান সে। তার পিছে পিছে ঘুরে নিজেকে বদলাতে লাগলাম। সে নাকি ম্যানলি পুরুষ পছন্দ করে। তার এই ম্যানলি হবার জন্য জামা কাপড় থেকে শুরু করে সব পাল্টাতে লাগলাম। শেষে ধরলাম সিগারেট। এইবার একদম পুরুষ আমি। কার থেকে যেন শুনলাম ওর সেমিস্টার পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো না। পরীক্ষার আগে ম্যানেজ করলাম প্রশ্ন। বীর বেশে তার সামনে গিয়ে বললাম এই নাও সামনের দুটা কোর্সের প্রশ্ন। খুশিতে আটখানা হয়ে সে আমার প্রেমের প্রস্তাব গ্রহন করলো। তারপর আর কি? সব বাদ দিলাম আর রাজকুমারীর আবদার মেটাতে লাগলাম। ওইদিকে পলিটিক্স ও তখন খুব গরম। সেদিন বোধয় বুধবার ছিল। আমাদের গ্রপের সাথে ক্যাম্পাসের বাইরের আরেকটা গ্রুপের বিশাল এক মারামারি হইল। ফায়ার হইল। ভার্সিটির গাড়ী পোড়াইল। অন্য গ্রুপের দুজন মারা গেল। ওরা কেস দিল আমি সহ আরও ১২ জনরে আসামী করে। অথচ ওইদিন আমি ছিলাম রমনা পার্কে। ভাইদের কইলাম ভাই এখন কি হইব। ভাইরা কইলো আরে কিছুই না কইদিন বাড়িত জা গা। আমিও গা ঢাকা দিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হইল না। আমার বাপ মার সামনে থেকে আমারে ধরে নিয়ে আসলো।অন্য আসামির সবাই নানা কায়দায় বেঁচে যায় শুদু আমি ছাড়া, কারণ আমার কোন ব্যাকআপ ছিল না,দেড় বছর জেলে থাকতে হয়, ভার্সিটি ছাত্রত্ব বাতিল করে, সুন্দরী আমারে ছড়ে চলে যায়, সেই থেকে বাপ মা আমার সাথে কথা কয় না।
বিপুল এর কথা গুলো শুনতে শুনতে মনে হল ও কোন নাটক সিনেমার পাণ্ডুলিপি পড়ছে। সাবলীল, অনর্গল ভাবে সে তার কথাগুলো বলে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম
- তারপর কি করলেন?
বিপুল বলল
- একবার ভাবলাম সুসাইড করি। কিন্তু পরক্ষণে বাপ মা আর ছোট বোনটার কথা মনে হতে লাগলো। ভাবলাম ভুল তো আমি করেছি আর এই ভুলটাও আমাকে ঠিক করতে হবে। চাকরী বাকরী খুঁজলাম না কারণ দুইটা সার্টিফিকেটে কেও চাকরী দেয় না। সোজা ঢুকে পড়লাম এক বন্ধুর গ্যারেজে। গাড়ির কাজ করতে শুরু করলাম। বাসা থেকে বের হই ভালো জামা কাপড় পরে আর গ্যারেজে গিয়ে গ্যারেজের জামা কাপড় পরি। উল্কাতে (ভার্সিটির বাস) উঠি কারণ ভার্সিটির পাশেই আমার গ্যারেজ, রাজনীতি করতাম বলে ছেলেপেলে বাসে উঠতে ঝামেলা করে না। ছাত্র বিপুল এখন বিপুল মেকানিক। কথাটা বলেই সে একটা ফিকে হাসি দিল।
এরপর বিপুল আমাকে বলল
- আসাদ ভাই আমি কিন্তু একটা জিনিষ প্রতিদিন ই খেয়াল করি।
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি ভাই?
- এই যে আমি সিগারেটটা নিই, আপনার সামনে ধোঁয়া ছাড়ি, অর্ধেক খেয়ে ফেলে রেখে যাই আর আপনি আমার সেই সিগারেটটারে আবার মাটির সাথে মিশিয়ে দেন এগুলোর সবই আমি খেয়াল করি।
আমি তখন বোকার মতন একটা হাসি দিয়ে বললাম,
- আসলে আমি সিগারেট খাই না তো তাই এটা ভালোও লাগে না।কিন্তু আমার তো মনে হল আপনিও এখন আর বেশি খান না। একটা পুরো সিগারেট এইভাবে কেও না খেয়ে ফেলে দেয় তা যত তাড়াই থাকুক না কেন!!
বিপুল তখন বলে উঠলো—
- আসলে আমি আমার সাথে আমার অতীতটাকে ভুলতে চেষ্টা করছি। দিনে এই একটা মাত্র সিগারেট আমি খাই। এখন অর্ধেক খাই তার মানে আমি অতীত অর্ধেক ভুলে গেছি। যে দিন আর খাব না সেদিন আমি আমার পচা, নষ্ট অতীতটাকেও পুরোপুরি ভুলে যাব। এটা মনে করতে পারেন একটা থার্মোমিটার। থার্মোমিটারের পারদ যেদিন একদম নেমে যাবে সেদিন থার্মোমিটারটাকেই ভেঙ্গে ফেলবো। এখনও অনেক কাজ বাকী, বুড়ো বাবা মার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে হবে, বোনটাকে ভালো একটা বিয়ে দিতে হবে, নিজের কাজটাকে গুছিয়ে নিতে হবে। অনেক অনেক কিছু করতে হবে।
আমি সেই তখন থেকে বিপুল এর মায়াভরা চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে ওর কথাগুলো শুনছিলাম। আজকেও সে অর্ধেক সিগারেটটাকে ভূপতিত করলো। দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে আমরা এক প্রান জুড়ানো হাসি দিলাম। অতঃপর সে উঠে গেল তার গন্তব্যর বাসে আর আমিও চলে আসলাম অফিসে। বাসে পুরোটা রাস্তা ভাবছিলাম বিপুল, সিগারেটের ধোঁয়া আর তার কথাগুলো।
সে দিন থেকে বিপুল এর সিগারেটের ধোঁয়া আমার আর খারাপ লাগে না। যখন দেখি ধোঁয়ার পরিমাণটা আস্তে আস্তে কমছে তখন ভালই লাগে। একটা মানুষের পাশে দাড়িয়ে তার কষ্টের অতীত ভুলার এই নিরন্তন জলন্ত চেষ্টা দেখি আর অপেক্ষা করি কোনদিন এই ধোঁয়াটুকুও আর দেখতে হবে না।
সত্যিই বিচিত্র মানুষের জীবন!!!!
(পুনশ্চঃ বিপুল এর সাথে কথোপকথনের সেইদিন আমার অফিস পৌছাতে বেজে গিয়েছিল ১০.২০টা আর বিপুলও সেইদিন উল্কাতে উঠতে পারেনি)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৪ রাত ১১:১১