somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃষ্টির সাথে

৩১ শে মে, ২০১৪ বিকাল ৩:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




মজার এক ব্যাপার ঘটলো আজ। সকালে অফিস গেলাম। গিয়ে দেখি বস আসে নাই। ভাল, না আসলেই ভাল। কলিগরা মিলে গল্প গুজব করে সময় কাটাতে লাগলাম। ঠিক ১১ টায় বিদ্যুৎ গেল আর আসার নাম গন্ধ নাই। অবাক হয়ে গেলাম কারওয়ান বাজারের মত ব্যস্ত জায়গায় লোডশেডিং দেখে। বিডিবিএল এ স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর আছে অবশ্য তবে সেগুলো লিফট আর ইমারজেঞ্চি লাইট আর জন্য। ঘড়ির কাঁটা যখন ১২.২০ ছুই ছুঁই তখন অ্যাডমিন থেকে সামাদ ভাই এসে বলল আজকে বিদ্যুৎ আসতে আসতে ৫টা বাজবে। সুতরাং যাদের অফিসে কোন কাজ নেই তারা চলে যেতে পারেন আর যাদের মিটিং আছে তারা থাকলে থাকতে পারেন। খবরটা শুনে বহুদিন পর পুরনো এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিজের মাঝে টের পেলাম। আগে স্কুল হাফ ছুটি হলে সবাই যেমন হই হুল্লোড় করতে করতে বের হতাম মনে হল সে রকম একটা চিৎকার দিতে দিতে বের হই। আমি মনে করলাম শুদু আমারই এই অবস্থা। বাকী সবার চোখের দিকে তাকিয়ে যখন একই অনুভূতির খেলা দেখলাম তখন লিফটে আমার গুন গুন করে গাওয়া “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে , ............. আজ আমাদের ছুটির” গানটার প্রতিধ্বনির মানে বুঝতে পারলাম।

অফিস থেকে বের হয়ে দেখি ওমা এতো সোনায় সোহাগা। মানে আসলেই আকাশে মেঘ করেছে। যেকোনো সময় সে অঝর ধারায় ঝরতে পারে। হুম হুম গর্জনে বৃষ্টির আগমন ধ্বনি স্পষ্ট শুনতে পারলাম। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে থেকে বাসে উঠতে না পেরে হাটতে লাগলাম। হালকা ঠাণ্ডা বাতাস চারপাশটাকে ভরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে । ফার্মগেটে এসেও যখন বাস পেলাম না তখন মনের দুঃখে হাঁটতে থাকলাম। বিজয়সরণী এসে কেন জানি একটু দাঁড়ালাম। উপরের আকাশটার দিকে তাকালাম। এই বিজয়সরনী থেকে আকাশটাকে একটু খোলা দেখা যায়। ভাসানি নভোথিয়েটারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশের রঙ আর বিল্ডিঙটার রঙ একই রকম দেখাচ্ছে।

অদ্ভুত সুন্দর লাগছে এই ইট কাঠের শহর। আমি আসলে নিরর্থক ভাবে জায়গাটায় দাড়িয়ে আছি। এখান থেকে না উঠা যাবে বাসে, না যাওয়া যাবে হেঁটে। ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে হাতে ধরে রেখেছিলাম অনেক আগেই। বৃষ্টি প্রস্তুতি। ছাতাটা নিয়ে তার আড়মোড় ভাঙতে না ভাঙতেই মাথার উপর আকাশটাই ভেঙ্গে পড়লো। ছাতাটা খুলে আমি বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগলাম। বৃষ্টিতে আমার সু’টার নাজেহাল অবস্থা হতে লাগলো। আমিও ভদ্রলোক না পারছি বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য অন্য কোন জায়গায় ছুটে যেতে না পারছি সু’টা কে বাঁচানোর জন্য সেটাকে খুলে হাতে নিতে। একদম রাস্তার মাঝখানের ট্রাফিক চক্করে দাড়িয়ে আমি। একটু আগে আমার সাথে দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশও মাথা গোঁজার জন্য রাস্তা পার হয়ে পাশের বট গাছের নিচে দাঁড়িয়েছে। আমি একা মনে হচ্ছে কোন এক আইল্যান্ডে দাড়িয়ে আছি। চার পাশে পানি আর গাড়ি। গাড়ি গুলো সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে।
এতক্ষণের আমার এই একাকীত্বকে ঘুচানোর জন্য একদল পিচ্চি পিচ্চি ছেলে পেলে এসে যোগাড় হল আমার চারপাশে। এদের কেও এই ট্রাফিক এ পানি বিক্রেতা, কেও ফুল বিক্রেতা, কেও বা খই। সবাই সবার পণ্য রাস্তার অপর পাশের বিল্ডিঙের নিচে রেখে ছুটে এসেছে বৃষ্টিতে ভিজবার জন্য, আর ওই খানে জিনিস গুলো দেখভালের জন্য দাঁড় করিয়ে রেখেছে হাফপ্যান্ট আর উদাম গায়ের আরেক পিচ্চিকে। বেচারা হাত দুটো মাথার পেছনে নিয়ে বালিশে মাথা দেওয়ার ভঙ্গি করে উদাস ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে বাকিদের ভেজার দৃশ্য দেখছে। আমি বেশ মজা পেলাম ওদের কান্ড কীর্তি দেখে । সবাই এই ব্যস্ত শহরের রাস্তায় এক অপূর্ব জলকেলি এঁকে দিচ্ছে। ওদের মধ্যে যে মেয়েটা ফুল বিক্রি করতো সে তার সবগুলো ফুলের মাঝে কয়েকটা তা গলায় কয়েকটা কানের উপরে লাগিয়ে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। মনে হচ্ছিল বৃষ্টি তার পরম আত্মার কোন আত্মীয়। ওদের বৃষ্টিতে ভেজার এই দৃশ্যটাকে গাড়ী থামিয়ে কয়েকজন সৌখিন ফটোগ্রাফার তার ফ্রেমে বন্দি করতে লাগলো আর এই বিষয়টাতে ওরাও যেন বেশ মজা পেয়ে গেল। ফটোগ্রাফারদের কাছে এডিট ছাড়া এই এক অন্য আদিম পাওয়া।
খানিক বাদে ওদের মাঝের মেয়েটা রাস্তার এই পাশে আইল্যান্ডে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। ছিপছিপে গড়নের ছোট্ট একটা মানুষ। হালকা লাল রঙের একটা ফ্রক, একটু বড় চুল, আর মুখে প্রানবন্ত এক হাসি। পুরো ভিজে একাকার, আমার দিকে একটু বিরক্তি নিয়ে তাকাল সে। যেন আমি কোন এক ভুল করে ফেলেছি। এই বৃষ্টিতে না ভিজে আমি অবশ্য একটা ভুলই করলাম মনে হয়। কিন্তু আমার যে সুস্থ থাকার তাড়া, চরম বাস্তবতার তাড়া। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম।

- তোমার নাম কি?
মনে হল শুনল না , আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম। তোমার নাম কি?
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল সে
- বৃষ্টি
আমি কিছুতা অবাক, না বিশ্বাসের চাহনি নিয়ে ওকে আবার জিজ্ঞসে করলাম
- সত্যি তোমার নাম বৃষ্টি?
এইবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে সে আমার দিকে তাকালো, চোখ দুইটা বড় বড় করে আমাকে বলল
- ক্যা আমগো নাম বৃষ্টি হইবার পারে না?

আমি বললাম
- না না তা কেন ? আমি প্রথমে বুঝিনি। আচ্ছা তুমি যে এত্ত ভিজছো তোমার অসুখ করবে তো।
এইবার আমার কথা শুনে ঝগড়া করার ভঙ্গিতে কোমরে হাত রেখে বলল
- আপনার লাইগ্যা আমি কি আমার মার সাথে কথা কওয়া বন্ধ কইরা দিমু নাকি?
এইবার আমি বেশ একটা ধাক্কা খেলাম। কি বলে মেয়েটা? মা কে ওর? আমার সাথে কি দুষ্টমি করছে? আমি মাথার মধ্যে এইরকম হাজারো প্রশ্ন নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম
- তোমার মা কে?
- ক্যা এইতো বৃষ্টিই তো আমার মা !!
আমি কৌতূহল মেটাতে না পেরে ওকে আবার জিজ্ঞেস করলাম
- কিভাবে বৃষ্টি তোমার মা হল?
ও বলতে লাগলো
- আমার বাপ কইছে বৃষ্টি আমার মা। আমি যখন অনেক ছোট্ট ছিলাম (বৃষ্টি মেয়েটা এখনও অনেক ছোট) তখন আমার মা আমারে থুইয়া আকাশে চইলা গেছে। মায়ে যখন আকাশে চইল্লা যায় তখন আমি আছিলাম থিক এইটটুক (ও আমাকে হাত দিয়ে নবজাতকের আকার বুঝানোর চেষ্টা করলো)। হের ফর আমি বড় হইলে বাপে আমারে কইছে মায় আকাশে বইসা আছে। আমারে দেকতাছে। আমার যখন খুব কষ্ট হয় তখন মায় আকাশ থাইকা নাইমা আসে। মা আমারে ভিজাইয়া দিয়া আবার চইল্যা যায়।

আমি প্রায় নিথর হয়ে ওর কথা গুলো শুনছিলাম। আমার পায়ের সু জোড়া আর বোধহয় পরা যাবে না, কাঁধ ব্যাগ টাও পুরোপুরি ভেজার পথে। কিন্তু এগুলো কোন দিকেই মন দিতে পারলাম না। অপলক চেয়ে থাকলাম বৃষ্টির (মেয়েটার) দিকে।
- হুম এই কথা তোমার বাবা বলেছে ?
- হ
- তোমার বাবা কই থাকে?
- আমরা ফার্মগেটে থাহি। বাপে রিসকা চালায়।
- তা তুমি পড়াশোনা কর না?
- করি প্রতিদিন বিহালে কয়টা মানুষ আইসা আমগোরে পরাইয়া যায়।
- আর এই ফুল কে দেয় তোমাকে ?
- ক্যা আমি নিজে কিনি, বাপে আমরে কিন্না দেয়। ফুল বেচি, তাকা কামাই আর বাপরে দিই।

এটুকু মেয়ের দায়িত্ববোধ আর ওর মায়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে বৃষ্টি আরও জোরে পড়তে শুরু করলো।
ও দেখলাম কেমন জানি ছটফট করতে লাগলো। আমার দিকে তাকিয়ে একটা গলাপ উচু করে ধরে বলল
- স্যার একটা ফুল নেন। আমারে মায় দাকতাছে।
ও কিছু না বললেও আমি ফুল নিতাম। পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে ওকে দিলাম। আমার দিকে অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে দুটো ফুল দিয়ে ও আবার ছুটে চলে গেল মায়ের সাথে কথা বলতে। উদ্দামভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে।

পেছন থেকে আমি দেখতে লাগলাম ওদের। শৈশব হারানো কিছু ছোট্ট মানুষদের।

কেন জানি আমারও মাকে প্রচণ্ড মনে হতে লাগলো। মাথার উপর থেকে ছাতাটা বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটতে লাগলাম।
বিড় বিড় করে বলতে লাগলাম, মা আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।

(বৃষ্টিতে ভিজে আমার এখন পর্যন্ত কোন অসুখ হয়নি, আর হবেইবা কেন মায়ের সাথে কথা বললে কারো কি কখনো অসুখ হয়)



৮টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×