জানালার বাম পাশের ফুলদানি টায় তুর্য সদ্য আনা ৫ রঙের গ্লাড়িয়াস আর রজনীগন্ধা সাজিয়ে রাখল। পর্দাটা একটু টেনে সরিয়ে রাখল সে। এইতো এবার একটু রোদ অনুর পায়ের কাছে পড়ছে। রুমটাও আলোকিত লাগছে। কি সব বাতি জ্বালিয়ে রাখে ফুলিটা, রুমে একটা গুমোট গুমোট ভাব। আজ আবার অফিসে জরুরী একটা মিটিং আছে তাই ঘুম থেকে ও আজ তাড়াতাড়ি উঠেছে। গোসল টা শেষে চট্ করে তৈরী হয়ে নিল সে।
অনুর কাছে এসে ওর দেয়া হাতঘড়িটা পড়তে পড়তে বলল সে—
এই দ্যাখো ঘড়িটার ডায়ালের বামদিকটায় রং উঠে সারা, আমি তো তোমাকে বলেছিলামই আমি ঘড়ি তড়ি পরি না ,আমাকে এটা দিও না। আমি ঠিকই জানতাম তোমাকে দোকানিরা ঠকাবে। দেখেছ রং উঠে গেছে!!
এই কথা বলতে বলতে সে ফুলিকে ডাক দিল।
--জী বাইজান।
--শোন তোর ঐদিকটায় কাজ কি হল? হলে তোর ভাবীর কাছে এসে বস।
--এইতো ভাইজান, কাজ শেষ। আপনার নাস্তা ও রেডি। আপনি আসেন নাস্তা কইরা লন।
---ভাল, শোন আজ কিছু কি লাগবে? তোর ভাবীর খাবার সব আছে তো?
--না ভাই জান ,কিছু লাগবো না সবই আছে।
--আচ্ছা তোর মোবাইলে টাকা আছে তো?
--হ ভাইজান আছে। কিছু লাগবো না। আপনি আসেন তো নাস্তা কইরা লন।
--তুই যা আমি আসছি।
তুর্য নাস্তা সেরে ওর হ্যান্ডব্যাগটা গোছাতে গোছাতে অনু কে বলল। তোমাকে বলেছিলাম না আমাদের অফিসে একটা নতুন ছেলে জয়েন করেছে। ছেলেটাও আমাদের মত প্রেম করে বিয়ে করেছে । গতকাল সব শুনলাম ওর কাছ থেকে। ও তো আমদের কথা শুনে তোমাকে দেখার জন্য পাগল প্রায়। আমি সামনের শুক্রুবারে ওদের আসতে বলেছি।।কি ভাল করেছি না??
ওহ্ শুন আরেকটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছিলাম। মা’না গত পরশু ও রোজা রেখেছে। আমি একটু রাগই করলাম মার সাথে। এত ঘন ঘন রোজা রাখলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। উল্টা মা আমকে যা শুনাল তা আর নাই বললাম এখন।
এই দ্যাখো আমার তো কাজ সারা। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ফুলী ........... ফুলি...........
জী আসতেছি ভাইজান। ফুলী একটু দেরিতেই যাবে এখন। কারন সে জানে ভাইজান রুম থেকে বের হবার সময় ভাবীর কপালে আলতো একটা চুমু দিবে। প্রতিদিনেরই তো রুটিন এটা। তাই সে ভাইজান কে অপ্রস্তুত না করার জন্য একটু দেরি করেই যায়।
----কিরে শেষ কাজ সব?
----হ ভাইজান।
---তাহলে বয় তোর ভাবীর কাছে। খাবার টাবার ঠিক মত দিস। আর কোন কিছু লাগলে আমাকে ফোন দিস। মোবাইল কাছে কাছে রাখিস।
----ঠিক আছে ভাই জান , আমি আছি এই হানে।
তুর্য ওকে সব বুঝিয়ে দিয়ে নীচে এসে গাড়িতে বসলো। বুক পকেট থেকে মিনি ক্যালেন্ডারটা বের করলো সে।
আজ ২০১৩ এর ২ তারিখ। তার মানে ৬ মাস ১৩ দিন। অন্য অনেক কিছুর মত এই হিসাবটাও তুর্যর প্রতিদিনের।
এক একটা দিন যায় আর ও নতুন আশা বুনে। এই ছয়টা মাসের প্রতিটি দিনের শুরু আর শেষের ক্ষণ গুলোকে ও ছাড়া আর কেও বোধহয় এত গভীর ভাবে উপলব্ধি করেনি। ওর যে প্রতিটি দিন শুরু হয় ছয় মাস আগের কথা মনে করে।
যখন অনু জোর করে ঘুম থেকে ওকে টেনে তুলত। বাচ্চাদের মত টুথপেস্ট নিয়ে ওর পেছন পেছন ঘুরত। আর সকালে টেবিলে থাকতো প্রতিদিন এক গ্লাস গরম দুধ। এই একটা বিষয় তুর্যর মোটেও ভাল লাগত না। আচ্ছা ওকি বাচ্চা নাকি যে প্রতিদিনই দুধ খেতে হবে। কিন্তু অনুর জন্য কিছুই করতে পারত না। বাধ্য হয়ে তাই খেতে হত।
কিন্তু এখন অনু আর তেমন করে না ওর জেদটাও কমে গেছে একদম। কিভাবে করবে সে ?? ও যে আজ ছয় মাস কোমাতে!! গত গ্রীষ্মে ওরা ঘুরতে বান্দরবন গিয়েছিলো । একটা রোড এক্সিডেন্টে আজ অনুর এই অবস্থা। তুর্য সেদিন কোনমতে বেঁছে গিয়েছিলো । কিন্তু অনুর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে। টানা এক মাস আই. সি. ইউ তে ছিল । শেষে ডাক্তাররা অনুকে বাসায় আনার অনুমতি দেয় কিন্তু ওর জন্য বাসার একটা ঘরে মিনি হসপিটাল বানাতে হবে। তুর্য তাই করেছিল। প্রতিদিন সকালে উঠে অনুর শরীরের সাথে লাগানো যন্ত্র গুলো দ্যাখে আর আশার আলো বুনে । মাকে ফোন করে বলে “মা অনু ভাল আছে, তুমি কেমন আছো”।মা তুর্যর কথা শুনে আর চোখের পানি মুছে । পুত্র বধূর জন্য কত রোজা ,কত মানত করে।
তুর্য বলে এসব কিছুই লাগবে না শুদু তুমি দোয়া কর,সব ঠিক হয়ে যাবে।
হ্যাঁ সব তো ঠিক হতেই হবে। তুর্য জানে অনু আবার ফিরে আসবে। ওকে যে আসতেই হবে।
ভাবতে ভাবতে তুর্জ সামনে মিটিং এর সাদা কাগজগুলোকে ঝাপসা দেখে ।
--ওহ্ এই রোদটা যে কি, চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়।
আসলে ও কাঁদতে চায় না । অনুর জন্য এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলতে চায় না সে। কারন অনু তো হারিয়ে যায়নি, অনু আছে, ঘুমিয়ে আছে, ঘুম থেকে একটু উঠতে দেরি করছে এই যা।
থাক আজ আবার তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে । অনুর জন্য জুবায়ের মামার ফুস্কা নিতে হবে। ফুস্কা ওর যা প্রিয়।
গাড়ির বাইরে তাকায় সে , ব্যাস্ত শহরের ব্যাস্ততা এখনো বাড়েনি। প্রতি সন্ধ্যার মত আজ সন্ধ্যায়ও তুর্যকে বাড়ী ফিরতে হবে অনুর ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য,আগামী কালের আরেকটি নতুন সকালের জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৩৯