সকালঃ ৭.১০ [হলের রুম]
ধুর আজও দেরি হয়ে গেল ঘুম থেকে উঠতে ।কাল রাতে শোবার সময় নিজেকে এত করে বললাম যে আজ সকাল সকাল উঠতে হবে, কোথায় কি!!! উঠতে উঠতে কিনা ৭.১০!!!!! ৮.২০ এ পরীক্ষা । আজকের পরীক্ষাটা শেষ হলে আপাত দৃষ্টিতে শিক্ষা জীবন শেষ। আহ কতদিন এই দিনটার জন্য অপেক্ষা ছিল।কত গ্লানী ,কত না পাওয়া, কত কষ্টের কথা আজ মনে পড়ছে। নাহ এখন এই সব হিবিজিবি ভেবে লাভ নেই। যাই আগে পরীক্ষাটা দিয়ে আসি।
এতসব ভাবতে ভাবতে অমিত ছুটে চলল কার্জন হলের দিকে।আজ তার শিক্ষা জীবনের শেষ পরীক্ষা।
দুপুরঃ ২.৫০ [গাবতলী বাস স্ট্যান্ড]
দুনিয়ার মাঝে দুইটা জায়গা অমিতের কাছে বিষের মত লাগে। একটা এই বাস স্ট্যান্ড অন্যটা মাছ বাজার। হলে ছিল বিধায় বাজারে যাবার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু বাড়ী যেতে তো বাস স্ট্যান্ডই ভরসা ,তাই না এসেও উপায় নেই। কিন্তু এই বাড়ী ও সে যাচ্ছে আজ বহুদিন পর কমপক্ষে ৪ বছর তো হবেই।
৪ বছর!!! নাহ তার কম না বরং বেশিই হবে।
যে বছর সে এসেছিল ছোটবোন নন্দিতার কুত কুত খেলার বয়স । আজ নন্দিতা এক সন্তানের জননী। হেল্পারের ডাকাডাকিতে তার মোহ ভাঙে, বাসে উঠে সে। একদম জানালার পাশে তার সিটটা । সি ১। পাশের সিটে মোটা মত এক লোক বসেছে। পান খেয়ে ঠোঁটের যা ছিরি,মনে হয় দামি ব্রান্ডের লিপিস্টিক মেখে এসেছে। এই পান,বিরি,মদ,গাঁজা খাওয়া লোক গুলোকে তার দেখতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এই পান বিরি খাওয়া লোকগুলোর সাথেই আছে তার এক আত্মিক সম্পর্ক । তাই এই ৪টা বছর সে চেয়েছে এদের কাছ থেকে দূরে থাকতে ।
এদের দেখলেই তার একজন আর কথা মনে পড়ে যায়। তার নিজের জন্মদাতা পিতার কথা.................. পোঁ পোঁ .............গাড়ী বেশ খানিক টা চলে এসেছে। সাভার বোধহয়।
অমিত জানালাটা একটু খুলে দিল ।পাশের সিটের লোকটা নীচের ঠোঁট বের করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে ।সে তাকালো বাইরের দিকে ।গাছ পালা ,ঘর বাড়ী , মানুষ গুলো ছুটছে অবিরত পেছন দিকে।
হটাৎ সেও হারিয়ে গেল গত কয়েকটা বছর পিছনের দিকে।
কত বছর গ্রামের সেই পূজো দেখা হয়না, কালী মন্দিরের ঠাকুর অনেক সুন্দর হত। মা’র হাতে সেই পায়েস যার ঘ্রাণ,স্বাদ অদ্বিতীয়। কিন্তু এই সব কিছু থেকে তাকে দূরে থাকতে হয়েছে শুদু মাত্র একজনের কারণে।
তার জন্মদাতা পিতার কারণে। তাই বাবার প্রতি তার এত রাগ, এত ক্ষোভ।
অমিতের বাবা নিরঞ্জন দাস। বয়স হয়েছে বেশ । একটা সরকারী চাকরী করে সে। বেতন পান ৮০০০ টাকা সব মিলিয়ে। প্রথম প্রথম অমিতকে ২০০০ টাকা করে পাঠাঁতেন। কিন্তু গত চার বছর অমিত বাবার পাঠাঁনো টাকা ছুঁয়েও দেখেনি। এত কষ্টের চাকরীর এত কষ্টের টাকা ছেলে গ্রহন করত না এই নিয়ে তার কোন রাগ নেই ছেলের প্রতি। পোস্ট অফিসের আলেক ভাই যখন আবার টাকা ফেরত নিয়ে আসতো তখন নিস্পলক চেয়ে থাকতেন তিনি।
ভাবতেন ছেলে আমার বড় হয়ে গেছে। একদিন সে আমাকে বুঝবে, আমি কেন এমন করলাম।
কেন নিজের ছেলেকে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখল সে ,এইসব প্রশ্নের উত্তর তার ছেলে অবশ্যই বুঝবে,জানবে। শুদু সে দিন তার জন্যই তার অপেক্ষা।
সন্ধ্যাঃ ৬.২০ [যমুনা ব্রীজের এর কাছাকাছি]
অমিতের গাড়ী এখন যমুনা ব্রীজের কাছাকাছি। ব্রীজের হলুদ বাতি গুলো দূর থেকে অপরূপ লাগছে। যেন একটা ধনুক পড়ে আছে নদীটায় । অমিত পুরো জানালাটা খুলে নেয়। বাস তার গতি বেগে এগিয়ে চলছে। অমিত তার ফেলে আসা দিন গুলোকে ভুলার চেষ্টা করছে। বাড়ী গিয়ে বাবার সাথে কথা বলবে না অমিত। সে ঠিক করলো প্রথমে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে। অনেক ক্ষণ কাঁদবে সে। বাবার কি দরকার ছিল তাকে দূরে রাখার ? কোন অধিকারে তার মায়ের কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, যতই হোকনা সে নামিক ভাষায় মেথরের ছেলে, যতই থাকুক না কেন তারা মেথর পট্টিতে ।
হ্যাঁ অমিতের বাবা এই সমাজের একজন ময়লা পরিছন্ন কর্মী। যার সামাজিক পদবি মেথর। নিরঞ্জন দাশ তার পৈতৃক পেশায় এই খানে আসেছে। সে চায়নি তার ছেলেও বাবার মত এই পেশায় আসুক। তাই সে তার ছেলেকে নিজের কাছ থেকে দূরে রেখেছে, দূরে রেখেছে এই মেথর পট্টী থেকে। তাইতো গত ৪ বছর সে তাকে ঘরে আসতে দেয় না আরও ৩ বছর সে নিজ পুত্রের সাথে কথা বলে না । কি কথা বলবে ওর সাথে ? সারাদিন ই যে তার মুখে থাকে মদের বিশ্রী গন্ধ, ঠোঁটে পানের লালছে দাগ । অমিতের মেধা ভাল ছিল দেখে সেই ছোট কাল থেকে তার এক পিসতুতে দাদার কাছে থেকে পড়ালেখা করেছে ।
ছেলে যখন বড় হয়ে উঠছিল নিরঞ্জন দাশ তখনি এই চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারন এই সমাজে তার কোন দাম নেই,নেই কোন পরিচয়, সে চাইছিল যে তার ছেলে নিজ কর্ম গুনে মানুষ হক। যেন তাকে শুনতে না হয় “মেথরের ছেলে মেথর হবে না তো কি ব্যারিস্টার হবে”-আই কথা গুলো।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে অমিতের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আজকেই তার আইনের মাস্টাসের ফাইনাল পরীক্ষাটা শেষ হল। তার বাবার দেয়া দিব্যির কারণে সে এতদিন সবার কাছ থেকে দূরে ছিল । আজ সে বাড়ি ফিরছে । মেথরের ছেলে হয়েও ব্যারিস্টার হয়ে । দূরের সেতুর বাতি গুলো এখন তার মাথার উপর। তবু কেন জানি সেগলো ঝাপসা দেখাচ্ছে ।
পাশের সিটের পান খাওয়া লোকটাকে এখন আর খারাপ লাগছে না। বরং আপন মনে হচ্ছে। আর বাইরের ছুটে চলা কাল রাতের তারা গুলোকে বাবার মত লাগছে। শত অন্ধকারেও যাকে জ্বলতে দেখা যায়,দূরে থেকেও কাছে টেনে নেয়।
অস্ফুট স্বরে সে বলে উঠে - বাবা আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি ..
.
পুনশ্চঃ নিরঞ্জন দাশ পেরেছিল তার ছেলেকে ব্যারিস্টার বানাতে। অনেক নিরঞ্জন কিন্তু তা পারে না। তাদের ধুঁকে ধুঁকে এই সমাজে বেঁছে থাকতে হয় ,পরজীবি হয়ে । কিন্তু সত্যিই কি সেলুকাস এই নিরঞ্জনদের ছাড়া আমদের সভ্য সমাজ এক পলকও টিকতে পারবে না
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:৩৭