সারা গায়ে প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে জ্ঞান ফেরে নীপুর। ব্যাথার কারণেই জ্ঞান হারিয়েছিলো, আবার সেই ব্যাথাই জাগিয়ে দেয় তাকে। ভাঙ্গাচোরা চা দোকানের পরিচিত কাঠামোটা মনে পরে যায় তার। অজান্তেই ঠোঁটের মাঝে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কয়েক ঘন্টা আগেও এই দোকানে বসে চা খেয়েছে কয়েকজন মানুষ। হ্যা, তারা দেখতে মানুষের মতই ছিলো। কিন্তু এখন আর তাদের মানুষ বলে চেনার কোন উপায় নাই। দোকানটার ধ্বংশস্তুপই বলে দিচ্ছে তার ভেতরে পরে থাকা মানুষরুপী জানোয়ার গুলোর শেষ পরিনতি।
বাংলাদেশ - একটা স্বপ্ন, একটা পতাকা, আমার অস্থিত্ব। হায়রে বাংলাদেশের মানুষ। কি করে পারে এরা? কি করে নিজের দেশকে, নিজের বিবেকটাকে নিশ্চিন্তে বিক্রি করে দেয় মানুষ? সৌভাগ্য এই যে, সব মানুষ এমন না। হাতে গোনা কিছু লোক হয়তো টাকার লোভে, নতুবা বিপদে পড়ার দোহাই দিয়ে এই পথে পা বাড়ায়। তারা নিজেরাও বোধহয় জানেনা যে দেশের কাছে, এই মাটির কাছে তারা কোন দিন আর ক্ষমা পাবেনা। হয়তো একদিন স্বাধিন হবে দেশটা, হয়তো হবেনা। কিন্তু যতো দিন মানুষের মনে বাংলাদেশ থাকবে, ততো দিন সবাই ঘৃণা ভরে তাদের কথা স্বরন করবে।
হঠাৎ করেই যেন বাস্থবে ফিরে আসে নিপু। কতক্ষন সময় পেড়িয়েছে? ভোর হতে দেরি নেই মনে হয় আর। আলো ফোটার সাথে সাথেই এই এলাকায় ঝাপিয়ে পড়বে পাকিস্থানী সেনারা। নির্বিচারে গুলি চালাবে। শরীরের সমস্থ শক্তি এক করে উঠে দাঁড়ায় নিপু। ছিড়ে যাওয়া জামা কাপড় থেকে কাদামাটি ঝেড়ে ফেলে দুহাতে, তারপর হাটতে থাকে বাসার দিকে।
বাসায় ঢুকে দ্রুত গোসল সেরে নেয় সে। শরীরের ক্ষত গুলোতে কামড়ে ধরে ঠান্ডা পানি, না, সে দিকে নজর দেয়ার সময় নেই এখন। ভোর হবার আগেই জানাতে হবে সবাইকে, যেন দ্রুত সরে যেতে পারে মানুষ গুলো। এলাকায় কোন যুবক ছেলে নেই, মিলিটারির অত্যাচারে থাকতে পারেনি কেউই। শুধু কিছু পরিবার তাদের সহায় সম্বল আকড়ে ধরে পড়ে আছে। একে একে তাদের জানিয়ে দিতে থাকে নিপু, সরে যেতে বলে এই এলাকা থেকে।
ফজরের আজান দেয় দূরের কোন মসজিদে। শেষ বাড়ীটাতে কড়া নাড়ে নিপু। নিজ মনেই ভাবে "এতো দূর কি আসবে মিলিটারী?" তবুও জানিয়ে রাখা ভালো। সাবধানে থাকলে তো ক্ষতি হবার সম্ভাবনাটা কমবে। " নিপু মা - এতো রাতে তুই?" - ঘুম জড়ানো অবাক হওয়া কন্ঠ মহিলার। "চাচী, আপনারা যত তারাতারী পারেন সরে যান এই এলাকা থেকে"। সংক্ষেপে কাল রাতের ঘটনা খুলে বলে নিপু। বলে বেড়িয়ে আসে। আপাতত কাজ শেষ।
নিপুকে দেখে চমকে ওঠে সবাই। শুধু নির্বিকার তাকিয়ে দেখে আসিফ। "আপু, আমরা তো ভেবেছিলাম যে তুমি শেষ" কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে ওঠে শান্ত, চোখ দেখে বোঝা যায় অনেক কেঁদেছে এই ছেলে। এগিয়ে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে নিপু। "এখনো অনেক কাজ বাকিরে শান্ত, আমি এতো সহজে মরছিনা। বাবার শেষ আদরের স্পর্ষ এখনও আমার কপালে লেগে আছে"। চোখ ভিজে ওঠে নিপুর।
ভাঙ্গা মন্দিরটা থেকে সবাই বেড়িয়ে গেছে নিপু আর আসিফকে একা করে দিয়ে। আসিফের বুকে মাথা রেখে বসে আছে নিপু। শরীরে এক বিন্দু শক্তি অবশিষ্ঠ নেই তার। প্রয়োজনও নেই। তাকে দুহাতে জড়িয়ে আছে আসিফ। কি অসাধারন চিন্তা শক্তি এই ছেলেটার। কি নিখুত পরিকল্পনা। সমস্যা ছিলো, নূরুর চা'র দোকানে রাজাকারদের মিটিংএর সময় বোমা নিয়ে যাবে কে। কোন ছেলেকে দেখলেই ওরা গুলি করে বসতে পারে। নিজে থেকেই যেতে চেয়েছিলো নিপু। আসিফ একটি বার নিষেধ করেনি তাকে। ভালোবাসার মানুষটাকে নিশ্চিৎ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে একবারও কাঁপেনি তার চোখের পাতা। সময়টা যে এখন দেশকে ভালোবাসার। আর যে কোন সময় ছোট্ট একটা বুলেট আঘাত করতে পারে আসিফের কপালে কিংবা বুকে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিপু নিজেও জানেনা। সন্ধে মিলিয়ে গেছে, অন্ধকার ঘরের এক কোণে মিটমিট করে জ্বলছে একটা হারিকেন। হারিকেনের পাশে টিনের থালায় নিশ্চই কোন খাবার। আসিফের কোন কাজে ভুল নেই, আনমনে হাসে নিপু।
খেতে বসে প্রথম গুলির তীক্ষ্ণ শব্দটা শোনে নিপু। এখন আর ওই শব্দ কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনা তার মদ্ধে। একে একে গুলির শব্দ বাড়তে থাকে। ভারী মর্টারের আওয়াজ শোনা যায় মাঝে মাঝে। খেয়ে নিয়ে মেঝেতে পাটি পেড়ে নামাজে বসে নিপু। দূহাত তুলে দোয়া করে দেশের জন্য, দেশের মানুষ গুলোর জন্য।
প্রথমেই মন্দিরের ভেতর ঢোকে শান্ত, তার পেছনে বাকি সবাই। শান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ধক করে ওঠে নিপুর। আসিফ আসেনি। তবে কি? "আমরা জিতেছি আপি, এই এলাকা এখন আমাদের দখলে" - মৌনতা ভাঙ্গে জামান। "আসিফ ভাই আমাদের সঙ্গে ছিলেননা, আমাদের অ্যামবুশে সেট করে দিয়ে উনি চলে গেছিলেন অনেক সামনে, পূর্ব পাড়া স্কুলের পেছনে। সেখানেই আজকে ক্যাম্প করেছিলো মিলিটারী। খাল পাড়ের ব্রীজটা উড়িয়ে দেয়ার আগে মনে হয় তিনটা জীপে করে কয়েকজন সেনা পালাতে পেরেছে। আর পেছনে কমপক্ষে ৭০টা লাশ রেখে গেছে তারা। আমরা হারিয়েছি অমলদা আর নাসিম কে। রাজিব, নবিন, পল্লব আহত। ওরা আছে জসিম স্যারের বাসায়। কপাল ভালো, আজকে সকালেই বেশ কিছু অসুধপত্র পাওয়া গিয়েছিল। আগামিকাল সকালে ডাক্তার পাওয়া যাবে। স্যার'ই ব্যাবস্থা করবেন বলেছেন। কিন্তু আসিফ ভাইকে কেউ দেখেনি। আমরা আধা ঘন্টা অপেক্ষা করে ফিরে এলাম। জানিনা উনি কোথায়।" একটানা কথা বলে থামলো জামান। কেমন যেন সবকিছু এলোমেলো লাগছে নিপুর। অজানা একটা আসঙ্কা, একটা ভয় ঘিরে ধরছে তাকে। আস্তে করে মেঝেতে বসে পড়লো নিপু।
রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ছোট্ট একটা বাচ্চার কান্না স্বচকিত করে তোলে সবাইকে। হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দেয় নিপু, নিজের গায়ের ধুশর শালে জড়িয়ে একটা ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢোকে আসিফ। হাটু গেড়ে বসে পড়ে নিপূর সামনে। শাল সরিয়ে এক হাতে বান্ডেজ জড়ানো বাচ্চাটাকে তুলে দেয় নিপুর কোলে। "নিপু, আমি জানিনা এটা কার সন্তান। হয়তো কোন মুক্তিযোদ্ধার, হয়তো কোন রাজাকারের, হয়তো কোন সাধারন দরিদ্র মানুষের। ওকে আমি কুড়িয়ে পেয়েছি পথের পাশে। হেরে গিয়ে পালানোর সময় ওর মা'কে তুলে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা। বাচ্চাটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে অমানুষ গুলো। আমি ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম ডাক্তারের কাছে। তাই ফিরতে দেরি হলো। যদি তুমি চাও, তাহলে ওকে রাখতে পারো আমাদের সাথেই, আমাদের সন্তানের মত। না চাইলে ..." আসিফের মুখে হাত চাপা দেয় নিপু। "ও আমাদের সন্তান, ওর নাম স্বাধীন। ওর বাবা মুক্তিযোদ্ধা আসিফ ইস্তিয়াক, মা আয়শা পারভীন নিপু"।
~সমাপ্ত~
{গল্প কমিউনিটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত - পিডিএফ আকারে দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন}
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:৪৭