গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জোর প্রচারনা চলছে নিউ ইয়ার ইভের ঘটনাবলি নিয়ে। এবার ফেডারেল সরকার ৭ মিলিয়ন ডলার বাজেট করেছে আড়াই ঘন্টার এই ফায়ারওর্য়াক্স - এর জন্য। সব জাগায় "নেভার সিন বিভোর" বলে প্রচারনা চালাচ্ছে। তাই আমি আমার পুরো স্টুডিও সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি! স্টুডিও বলতে তেমন কিছু না। একটা ট্রাভেলিং ব্যাক প্যাকে ভর্তি আমার ডি এস এল আর, সাথে কিছু লেন্স, একটা মাঝারি আকারের ট্রাই পড, একটা রিমোট কনট্রোল, একটা ভিডিও ক্যামেরা, আর ছোট আয়তাকার একটা আয়না। এইজিনিসগুলাই নিয়ে যাই আর ভাব দেখানোর জন্য বলি ইসটুডিও!
স্টুডিও ছাড়াও আরও নিয়েছি এক বোতল ফলের রস, এক বাক্স বিফ বিরিয়ানি (টেকাওয়ে), একটা বিছানার চাদর আর পোর্টেবল ডিভিডি প্লেয়ার।
এত কিছু নেবার কারন আছে। আমাকে একটানা পুরো ৯ ঘন্টা সেখানে থাকতে হয়েছে। সেখানে মানে সিডনী হারবারব্রিজ/অপেরা হাউস প্রাঙ্গনে। তাই আগে ভাগে সেরকম প্রস্তুতিই নিয়ে গিয়েছিলাম। (যেটা নিতে পারিনি সেটার জন্য পরে খেসারত দিতে হয়েছে অবশ্য )
বাসা থেকে বেরিয়েছি বিকাল সাড়ে তিনটায়। গিয়ে পৌছলাম সাড়ে চারটায়। প্রচন্ড গরম। তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জিনস আর টি শার্ট পরতেই আমার গরমে হাস ফাস অবস্থা। আর অজি মেয়েদের তো দেখলাম.... থাক! আর কি বলবো? সে বিষয়ে এখানে কিছু না বলাই ভাল। বেশী কিছু বল্লে আবার ১৮+ কনটেন্টের জন্য মডু কর্তৃক ব্যান খাবার আশংকা আছে।
যাই হোক, প্রথম শো শুরু হবার প্রায় ৫ ঘন্টা আগে গিয়েই দেখি হুলস্থুল কান্ড। মানুষ গিজ গিজ করছে । পা ফেলার জাগা নেই। এর মধ্যে দেখি, এক বাংগালি মেয়ে তার বয় ফ্রেন্ডকে সাথে করে এনেছে। ছেলেটাকে বলছে - তুমি আমার সাথে থাকো। আমি সাথে থাকলে তোমাকে কেউ ধাক্কাবে না।" একটু পর দেখি বয়ফ্রেন্ডর হাত ধরে টেনে মেয়েটা একাই সবাইকে ধাক্কিয়ে ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার সাথে বিশাল ব্যাগ থাকায় আমি খুব একটা সুবিধা করতে পারলাম না তো না-ই উল্টো মেয়েটার ধাক্কায় আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বল্লাম না। হাজার হোক, নিজের দেশের লোক বলে কথা। কিন্তু একটু পর দেখি এক অজি ছেলে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে একটা এফ ওয়ার্ড যুক্ত গালি দিল। এরপর দেখলাম মেয়েটা আস্তে আস্তে ভদ্রভাবে এগোতে লাগল। ভাবলাম একবার তাকে গিয়ে বলি - "আপা, প্রথম থেকেই এমন করে চল্লে গালিটা খেতেন না। সবাই আগে যেতে চায়, তাই বলে কি এভাবে গরুর মত গুতিয়ে যেতে হবে নাকি?" কিন্তু এবারও কিছু বল্লাম না।
শালার আমি এমন এক জাগায় পড়লাম, সামনে গোবদা গোবদা কয়েকটা ফেন্স। ব্রিজ বা অপেরা হাউস কোনটাই ঠিকমত দেখা যায় না। কোনমতে এক জাগায় চাদর বিছিয়ে বসে ব্যাগ থেকে ট্রাইপড বের করে সেট করলাম ব্রিজ আর অপেরার মাঝামাঝি। কয়েকটা টেস্টিং শট নিলাম। এরপর একটু ফলের রস খেয়ে প্লেয়ারটা বের করে ফ্যানটাসটিক ফোর দেখতে লাগলাম সময় কাটানোর জন্য।
আমার পাশে কিছু ইন্ডিয়ান ছেলে পেলে এসে বিকট চেচামেচিঁ শুরু করল। একটু পর কিছু নিগ্রো এসে ওদের সাথে যোগ দিল। চেচামেচিতেঁ কান পাতা দায়। আমি দু হাত দিয়ে ইয়ার ফোন চেপে ধরলাম।
এর মধ্যে দেখি এক ভারতীয় ছেলে এক চাইনিজ মেয়ের সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। তাস খেলার ছল করে ছেলেটা যে মেয়েটার সাথে ঢলাঢলি করল, কি আর বলবো। ঢলতে ঢলতে পারলে আমার কোলের উপর এসে পড়ে। একটু পর কান থেকে ইয়ার ফোন খুলতেই দেখলাম ইন্ডিয়ান ছেলেটা চাইনিজ মেয়েটাকে বলছে -
-তুমি তো কখনও যাওনি ভারতে, তাই না?
-হ্যাঁ, তবে যাবার খুব ইচ্ছে আছে।
- আমি যাচ্ছি বেড়াতে, আগামী মাসে, তুমি চাইলে আমার সাথে যেতে পারো। (দাতঁ কেলিয়ে হেসে বলছে ছেলেটা, আমি তো আতঁকে উঠলাম।)
- আসলে আমার পড়াশুনা শেষ করে চায়নায় ফেরৎ যাবার ইচ্ছে আছে।
- জানো আমাদের গ্রামের বাড়ি খুব সুন্দর। এখানে আমাদের বাড়ী, এখানে সমুদ্র, এখানে বাগান। (ছেলেটা তাসের কার্ড দিয়ে বাড়ী, সমুদ্র এসব দেখাতে লাগল। মেয়েটাকে এত চেষ্টা করেও কনভিন্স করতে পারলো না! আহারে বেচারা!)
- তারপর যেন মেয়েটা কি বল্ল, ভীড়ের শব্দে শুনতে পারলাম না।
একটু পর দেখি ছেলেটা তার ক্যামেরা দিয়ে আমাকে বলছে - তাদের ডুয়েট ছবি তুলতে। মেয়েটাও ছেলেটার পাশে দাতঁ কেলিয়ে গিয়ে বসল। এই চাংকুরা (চাইনিজদের চাংকু বলাহয় এইখানে) কত চামবাজ হতে পারে সেটা নিজের চোখে দেখলাম। এইটা কোন চাইনিজ মেয়ে না হয়ে কোন অজি বা লেবু মেয়ে হলে, ঐ ছেলের আজ হাসপাতালে থাকার কথা ছিল।
যাইহোক, ছবি তোলার পর দেখলাম দুজন দুজনের ফোন নাম্বার নিল। মনে মনে ছেলেটিকে বল্লাম- "যাক, আজ রাতে ভালই কামিয়ে গেলে। তোমার নিউ ইয়ারটা ভালই যাবে মনে হচ্ছে! )"
শো শুরু হলো সাড়ে নয়টায়। আকাশ ছেয়ে গেল আতশবাজীতে। আর সে শব্দে বাতাস ভারী হয়ে গেল। একেকবার পুরো আকাশ দিনের বেলার মত আলোকিত হয়ে যাচ্ছিল। এরপর সব ধোয়া। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ভিডিও করবো নাকি ছবি তুলবো। শেষে দুটোকেই কোনমতে ধরে নিলাম কিছু শট। পরে পিসিতে দেখি খারাপ আসেনি।
কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী চারিদিকে। একটু পর এক গার্ড এসে বল্ল- "প্রায় দুই মিলিয়ন লোক হয়েছে। আমাদের খুব হার্ড টাইম যাচ্ছে।'' মনে মনে বলি, এই ভীড় সামাল দিতেই এ অবস্থা। এস্তমার ময়দানে মোনাজাতে দিনের ভীড় দেখলে তো হার্ট ফেলই করত।
তবে এটা অস্ট্রিলিয়ার বিগেস্ট গেদারিং। সারাবছর ধরে সিটি কাউন্সিল অনেক প্ল্যান প্রোগাম করে এই নিউ ইয়ার ইভকে ঘিরে। সিডনীর জন্য এটা একটা উৎসব। অসংখ্য পর্যটক আসে। বাইরের দেশ থেকে তো বটেই, অন্য স্টেট থেকেও আসে।
কয়েকঘন্টা পর, রাত ঠিক ১২টায় শুরু হলো ২য় এবং শেষ শো। কি আর বলবো, যারা নিজের চোখে না দেখেছে, বা ঐ সময় যারা সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত না ছিলো, তাদেরকে বলে বোঝানো শক্ত যে কতটা এমেইজিং ছিল সে শো। বনার্লি আলোর বিচ্ছুনরে চারিদিক ঝলসে উঠছিলো ক্ষনে ক্ষনে। সেই সাথে ডলবির সাররাউন্ড মিউজিক। হারবার ব্রিজ, তারপেছনে, অপেরা হাউসের উপরে, সারকুলা কি হারবার পয়েন্ট, স্টেশন আর সিটির বিল্ডিংসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে একযোগে আতশবাজির উৎসব চল্ল টানা ১৫ মিনিট।
শো এর পর দেশ বিদেশের ৪৫ জনকে একযোগে নিউ ইয়ারের উইশ জানিয়ে এসেমেস করলাম। এর মধ্যে ১২ টি সেন্ড ফেইল!
ফেরার পথে টয়লেটেও দেখলাম প্রচন্ড ভীড়। লাইনে দাড়ালাঁম। সেই এগারোটা থেকে ছোটটা চেপেছে। এখন বাজে রাত একটা। দুই ঘন্টা!!!! এত কিছূ আনলাম,আর বিপদে কাজ চালাবার মত একটা প্লাস্টিক ব্যাগ আনলাম না।!
তলপেট হালকা করে ভীড় ঠেলে বাসায় আসলাম রাত আড়াইটায়। সারাদেহ অবশ লাগছিলো।
বাসায় এসে দেখি আমার সাধের ক্যামেরার রিমোটটা হারিয়ে এসেছি! আতি পাতি খুজেঁও কোথাও পেলাম না।
লস্ট এন্ড ফাউন্ড প্রপার্টিতে ফোন করেও কোন আশাব্যন্জক উত্তর পেলাম না। নতুন বছরের শুরুটা এমন হলো বলে আরো মন খারাপ!
ছবির মূল লগোটার জন্য ব্লগার জেমিনির কাছে কৃতজ্ঞ।
সন্ধ্যা নামছে সিডনী সিটিতে, পেছনে ২০০৮ সালের শেষ সূর্যটা অস্ত যাচ্ছে!
দুটো ছবি সবচে ভাল এসেছে। এটি তার ভেতর ২য় টি।
মনে হচ্ছে যেন ব্রিজের উপর আগুন ধরে গেছে!
দুটো ছবি সবচে ভাল এসেছে। এটি তার ভেতর ১ম টি।
উৎসবের পর রাতের সিডনী শহর
ঝলমলে হারবার ব্রিজের ফুল ভিউ!
সবশেষে আমার করা ১০ মিনিটের একটি ছো্ট্ট ভিডিও ক্লিপ!
অজি কান্ট্রি সাইডারদের একসেন্টে পোস্টের শিরোনাম লিখলাম।
সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। নতুন বছর হোক আরো হাসি আর আনন্দময়।
হ্যাপি নিউ ইয়ার। ২০০৯ ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৮