দেশীয় চলচ্চিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজন সম্ভবত অনেক দিন ধরেই কিছুটা আস্থাহীনতা আর কিছুটা সন্দেহের ঘোরের ভিতরে ভুগছিলেন। ঠিক কি ধরনের ছায়াছবি বানানো যায়। লম্বা সময় ধরে দর্শকের ভিতরে একটা শ্রেনীবিন্যাস তৈরী হয়ে গেছে, বিনোদনের অন্যতম এই মাধ্যমটিতে কাদের জন্য সিনেমা বানানো হয় সেটা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। বেশীরভাগ সময়ে আমার কাছে মনে হয়েছে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে জড়িত লোকজন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না কি করা উচিৎ! বাজেট সমস্যা, দর্শক সমস্যা, মনন আর মানসিকতার সমস্যা, দক্ষ অভিনেতা - অভিনেত্রীর ঘাটতির নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশীয় চলচ্চিত্র।
নাটক নির্মাতাদের, অভিনয় শিল্পীদের সিনেমায় আসাটা মানসম্পন্ন সৃজনশীল সিনেমা নির্মানের স্বপ্ন দেখিয়েছে, তবে সিনেমা কিন্তু সিনেমা। নাটক নাটকই। ভালো গল্প, ভালো ফ্রেমিং , ভালো অভিনয় থাকলেও কোথায় গিয়ে যেন সেগুলোর বেশীরভাগ আর সিনেমা হয়ে উঠতে পারছিলোনা। বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবে অমিতাভ রেজা অনেক আগেই নিজের প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তাই তিনি সিনেমা বানাচ্ছেন এটা নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্রভাবেই প্রত্যাশার সীমারেখা তৈরী করে দিয়েছে।
সিনেমা শিল্পে আমরা সম্ভবত বেশ কিছু ব্যাপারে অনেক পেছনে ছিলাম। একেবারেই শুরুতেই যেটা আসে সেটা হচ্ছে প্রচারণা। প্রচারণাতেই আয়নাবাজি বাজিমাৎ করেছে, বেশ ভালো রকমের সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘদিন পরে হাউজফুল, হাউজফুল, হাউজফুল রব উঠেছে। ভালো কাজ হলে যে দর্শক লুফে নেয় সেটা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে।
আয়নাবাজি দেখতে হলে যাবার আগে এমন বেশ কিছু ভাবনা ঘুরাফেরা করছিলো। আয়নাবাজি অনেক কিছুরই জবাব হয়ে এসেছে। আয়নাবাজি কেমন লেগেছে, এক কথায় বলা যাবেনা। আয়নাবাজিতে কি হয়েছে সেটাও বলা সমীচিন হবেনা।
আয়নাবাজি সম্ভবত বাংলাদেশের প্রথম থ্রিলার মুভি। দর্শককে প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট করে রাখা যার প্রধান ধর্ম। এই দিক থেকে আয়নাবাজি শতভাগ সফল। দর্শককে পুরো তিন ঘন্টা পর্দায় বন্দী করে রাখাটা নিঃসন্দেহে সাফল্যের ব্যাপার। কিভাবে রেখেছেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, আমার কাছে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে অমিতাভ রেজা সম্ভবত ক্যামেরার ফ্রেমিং দিয়েই মনোযোগ ধরে রেখেছেন, দর্শক আমাদের চিরচেনা কিছু দৃশ্য পর্দায় আকর্ষনীয় ভাবে দেখছে তাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে, ক্ষানিকবাদেই আমি অনুভব করলাম আমি আয়না সাহেবের ভাবনার সাথে একাত্ব হয়ে গেছি। সিনেমার প্রতি পদক্ষেপে নতুন নতুন চমক ও আমাকে চোখ সরাতে দেয়নি। বিরতির সময়ে মনে হলো, ইশ! অর্ধেক শেষ!
আর নাটক কিংবা বিজ্ঞাপনের লোকজনের সিনেমা দেখার পর যেটা মনে হয় টেলিফিল্ম দেখলাম, মুভি নয়, সেই ভয় নিয়েই দেখা শুরু করেছিলাম। মিথ্যে বলবনা প্রথম আট দশ মিনিটে মনে হয়েছে আরেকটা টেলিফিল্ম দেখছি বোধহয়, কিন্তু না অমিতাভ রেজা মুভিই বানিয়েছেন, থ্রিলার মুভি। আপনাকে রোমাঞ্চ উপহার দেবেন।
চঞ্চল চৌধুরী কত বড় মানের অভিনেতা সেটার প্রমান হিসেবে এই মুভিটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। মোট সাতটা চরিত্রের নিখুঁত বাস্তবায়ন কেবল মাত্র তাঁর পক্ষেই বাংলাদেশে সম্ভব। সিনেমার পাত্র পাত্রী নির্বাচনে অমিতাভ রেজা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। কাহিনী বিন্যাস, সিনেমাটোগ্রাফি আর অভিনয় বের করে আনায় যে তিনি পরিশ্রম করেছেন সেটা ছবিটা না দেখলে অনুমান করা যাবেনা।
দর্শককে আনন্দ দেয়ার জন্য বেশ কিছু মজার আয়োজন করেছেন। মাঝে মাঝেই ছোট ছোট কিছু দৃশ্যে জনপ্রিয় কিছু মুখের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন, সিনেমাটির জন্য তাদের উপস্থিতি কখনোই প্রয়োজনীয় ছিলোনা তবে দর্শকদের একগেয়েমি থেকে দূরে রাখতে এটা খুব জরুরী ছিলো।
অমিতাভ রেজা একটা বার্তা পৌছে দিয়েছেন সবার কাছে, কমার্শিয়াল ফিল্ম আর আর্ট ফিল্ম এই দুটি ধারণা আলাদা আলাদা করাটা ফিল্মের জন্য ক্ষতিকর। একটা ব্যাবসা সফল মুভিতেও আর্ট থাকতে পারে, আর সেটাই ভালো ছবি হয়।
ছবির শুরুর ১৫ মিনিট পর থেকে নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে ক্ষানিক বাদে বাদেই কিছু প্রশ্ন, কিছু শঙ্কা উপহার হিসেবে এসেছে, বিরতির পর এটা চূড়ান্ত ধম বন্দ অনুভতি উপহার দিয়ে তারপর হঠাৎ করে আরো কিছু প্রশ্ন সামনে রেখে শেষ হয়েছে। আয়নাবাজিকে আপনি চাইলে ছোটগল্প বলতে পারেন।
অমিতাভ রেজাকে শুভেচ্ছা, ধারাটা চালু থাকুক। দর্শক এমনিতেই হলে যাবে, সুস্থ বিনোদনের অনেক অভাব এই দেশে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ২:০৮