সেইদিন যখন জাহেদ ভাই আমার লেখাটা হাতে নিয়ে বিরক্তি ভরা চোখে তাকালেন, আমি তখনই বুঝে গেছিলাম "আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা"।
অথচ আমি বোকার মতো ভাবতাম অথবা বলাযায় ভাবতে ভালোবাসতাম 'আমি লিখতে পারি'।
আজ আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি আমি ভুল ছিলাম।
কতো কষ্ট করে, কতো রাত না ঘুমিয়ে আমি লিখেছি। বন্ধুরা সবাই সবসময় বলেছে আমি নাকি ভালই লিখি! ওরা তো আর জাহেদ ভাই এর মতো অতো কিছু বোঝেনা। আর তাই আমিও রাতের পর রাত লিখেই গেছি। লিখতে লিখতে কতো গুলো যে ছোট গল্পের পাণ্ডুলিপি জমে গেছিলো আজ তা আমার নিজেরও মনে নেই। যা ইচ্ছে হতো তাই লিখতাম। বন্ধুরা বলতো আমি ঠিকভাবে গুছিয়ে কথা বলতে না পারলেও লিখি দারুন।
দুই একটা গল্প দৈনিক পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। আর সেগুলো দেখে সবার কি উচ্ছাস!
শারমিনকে খুব ভালো লাগতো কিন্তু কখনো সাহস করে কথা বলতে পারিনি ওর সাথে। একদিন সে নিজে থেকেই আমার সাথে কথা বলতে এসেছিল। পত্রিকায় নাকি আমার লেখা গল্প পড়ে তার খুব ভালো লেগেছে। তারপর মাঝে মাঝেই কথা হতো শারমিনের সাথে। আমার কাছ থেকে গল্প চেয়ে নিয়ে পড়তো। আর মাঝে মাঝেই বলতো, আমি নাকি অনেক বড় লেখক হবো।
শারমিনের কথা গুলো আমাকে স্বপ্ন দেখাতো আরও বেশি করে স্বপ্ন দেখাতো।
আমি স্বপ্ন দেখতাম আমাকে নিয়ে, শারমিনকে নিয়ে, আমাদের দুজনকে নিয়ে। কিন্তু কথা গুলো ওকে বলা হয়নি কোনদিন। একদিন হটাত করেই শারমিনের বিয়ে হয়ে গেল। কষ্ট পেয়েছিলাম খুব। তারপর একদিন কষ্টটাও মরে গেছে।
তারপর আমি আবার স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমার লেখা গুলোকে নিয়েই স্বপ্ন দেখেছিলাম। একসময় পড়ালেখা শেষ হল। বন্ধুরা সবাই যে যার মতো করে কাজ শুরু করলো। আমিও কাজ পেলাম। একটা নামকরা দৈনিক পত্রিকা অফিসে সাব-এডিটর এর চাকরি। নামেই এডিটর, কাজ প্রুফ দেখে দেয়া। কিন্তু তারপরও আমি আমার কাজটাকে ভালোবেসেছিলাম।
জাহেদ ভাই এই পত্রিকারই সম্পাদক। তিনি শুধু একজন সম্পাদকই নন, তিনি দেশের একজন নামকরা সাহিত্য সমালোচক। বাঘা বাঘা সব লেখক তাকে সম্মান করে। তিনি কোন লেখাকে ভালো বললে সেটা পাঠকদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সব প্রকাশকরাও ওনাকে, ওনার কথার অনেক গুরুত্ব দেন।
আমি এই চাকরিটা পাবার পর থেকেই চেষ্টা করছিলাম জাহেদ ভাইকে আমার কিছু লেখা দেবার। হয়তো উনি বলে দিলেই আমার লেখা গুলো বই হিসেবে ছেপে দেবে কোন প্রকাশক!
আর তাই একদিন সুযোগ পেয়েই ওনাকে বলেছিলাম সে কথা। আর উনিও হেসে বলেছিলেন "আচ্ছা ঠিক আছে, নিয়ে এসো আমি দেখবো"।
আমার সেদিন মনে হয়েছিল আমি বিশ্ব জয় করে ফেলেছি। আর তারপরেইতো দুটো উপন্যাস আর ছোট গল্পের একটা পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেছিলাম জাহেদ ভাই এর কাছে। তিনি পাণ্ডুলিপি গুলো হাতে নিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখে আমার দিকে বিরক্তি ভরা চোখে তাকালেন । আমার তখনি মনে হয়েছিল জাহেদ ভাইয়ের হয়তো লেখা গুলো ভালো লাগবেনা।
কিন্তু তারপরো অনেক আশা নিয়ে ছিলাম। সপ্তাহ খানেক পর জাহেদ ভাইকে পাণ্ডুলিপি গুলোর কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন "আমি পড়েছি তোমার লেখা, ওগুলো তো কিছুই হয়নি"। লজ্জায় আমার যেন মাথা কাটা যাচ্ছিল।
এখন আমি নিজেও বুঝতে পারছি, খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি ওগুলো আসলেই কিছুই হয়নি। আর জাহেদ ভাই ঠিক কথাই বলেছেন, আমাকে দিয়ে আমাকে দিয়ে লেখালেখি হবেনা।
আমাকে দিয়ে আসলে কিছুই হবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৩:৩৫