ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিনের বিদেশ ফেরত বর্তমানে অবসরে থাকা দ্বিতীয় ছেলে জমিরুদ্দীন আঠার বছর তিন সপ্তাহ’র প্রথম মঙ্গলবারের ধল প্রহরে, বাবাকে বুঝতে পারার সুতীব্র বেদনায়, আসমান জমিন কাঁপিয়ে চীৎকার করে উঠলেন। সন্তানের মুখ দেখে জমিরুদ্দীনের মনে হল; কলিজায় কেউ যেন ঘাঁই মেরে দিল।
যেদিন ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিন মারা যান, সেদিন তাঁর জানাজায় যাঁরা এসেছিলেন; আশ্চর্যজনকভাবে, তাঁরা প্রত্যেকেই বাবা ছিলেন। অর্থাৎ বাবারাই ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিনের জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন। পৃথিবীতে এমনটি আর দ্বিতিয়বার ঘটেছে এমন কোন প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিন মারা যান আজ থেকে আঠার বছর তিন সপ্তাহ আগের কোন এক মঙ্গলবারের ধল প্রহরে।
কোনরূপ অভিযোগহীন, একেবারে অভিমানশূণ্য জীবনের শেষ বারটি বছর তেল চিটচিটে বালিশ আর শিল কড়য়ের মতন শক্ত বিছানায় কেটে গেছে ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিনের। রোগ আর শোকগ্রস্ত শরীরে কাঁপন লাগলে বুঝতে বাকী থাকত না, এক কালে প্রেম ছিল। জামার আস্তিনে লুকানো ছিল আত্তির লাহান বল। চওড়া বুকের পরতে পরতে ছিল যৌবন। এমন একজন সুঠাম, কর্মঠ বনেদী কৃষক, মাইনে বিহীন মুয়াজ্জিন কী ভীষণ নিস্পৃহ হয়ে পড়লেন জীবনের শেষ দিনগুলিতে। কী ভয়ানক অসহায়! কেমন সকরুণ দারিদ্র!
ফাগুন-চৈত দুপুরে ছারা ভিটার বাঁশ ঝাড়ে শমশম হাওয়া বইলে, ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিনের শইলে কাঁপন লাগে। বাড়ির বৌ-ঝিদের কোমল শিশুর মতন রাইজ্যের তাবৎ অসহায়ত্ব জড়ো করে ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিন এক কাপ চা চাইতেন। লাজুক ভঙ্গিতে, অপরাধীর মতন খুব নীচু স্বরে বলতেন- এক কাপ গরম পানি কী কোনভাবে পাওয়া যায়। সে কী ভীষণ আকুতি! সে কী ভয়ানক হাহাকার! অথচ এই ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিন, শরীরে যখন তাক্বত ছিল, সে সময় দিন রাত এক করে খেটেছে। তাঁর জমির ধানের গোলা, মহিষের পাল, ঘেরের মাছ খেয়ে আশে-পাশের দশ পরিবার চলে যেত।
ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিনের অন্তিম সময়ে তাঁর পুত্র জমিরুদ্দীন পাশে ছিলেন। মৃত্যুর সময় মানুষ নানা অছিয়ত করে। ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিন এমন কোন অছিয়ত করে যাননি। শুধু একটা কথায়ই বলেছিলেন- যেদিন বাবা হবি, সেদিন বাবাকে বুঝবি।
জমিরুদ্দীন একদিন বাবা হলেন। তখনো তিনি বাবাকে বুঝেছিলেন কী না তা তথ্য-উপাত্তসহ কেউ বলতে পারেননি। একদিন জমিরুদ্দিনের ছেলে বাবা হলেন। সেদিন জমিরুদ্দিনের ছেলে জমিরুদ্দীনকে বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে সুতীব্র চীৎকারে বলে উঠলেন- বাবা, আজকে আমি তোমাকে বুঝেছি। খুব অদ্ভুতভাবে সেদিন জমিরুদ্দীন হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন- বাবা, তোমাকে আমি বুঝতে পেরেছি।
ধল প্রহর কেটে গিয়ে ধীরে, খুব ধীরে কোমল আলোয় মাঠ-ঘাট ভেসে যাচ্ছিল। বাবা হবার তীব্র বেদনায় জমিরুদ্দীন আর তাঁর ছেলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছিলেন। ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিনের বিদেশ ফেরত বর্তমানে অবসরে থাকা দ্বিতীয় ছেলে জমিরুদ্দীন আঠার বছর তিন সপ্তাহ’র প্রথম মঙ্গলবারের ধল প্রহরে, বাবাকে বুঝতে পারার সুতীব্র বেদনায়, আসমান জমিন কাঁপিয়ে চীৎকার করে উঠলেন। সন্তানের মুখ দেখে জমিরুদ্দীনের মনে হল; কলিজায় কেউ যেন ঘাঁই মেরে দিল। পরাণের গহীনে কেমন শিরশির করে উঠছে। চউক্ষের জল মনে লয় বাঁধ মানল না।
ফযরের আযান ভেসে এলে মনে হয়; ছদরুদ্দীন মুয়াজ্জিন খুব করুণ সুরে, রাজ্যের যাবতীয় বেদনাকে জড়ো করে, পৃথিবীর সমস্ত সন্তানদের উদ্দেশ্যে বলছেন- ঈশ্বরকে বুঝতে গেলে বাবা হতে হবে। ঈশ্বরকে বুঝতে হলে পিতা-মাতা হওয়া লাগে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৫