মুকুন্দমধুসুদনপুর বাজারের মোড়টা পার হতেই সুদূর ঢাকা থেকে আগত বিশিষ্ট ব্যবসায়ি জনাব মাহবুব এ রহমান সাহেবের পাজেরো গাড়ির সামনের দুই চাকা বেফাস স্থির হয়ে গেলো। ঠিক তেমনি ফ্রিজ শটে স্থির হয়ে গেল মাহবুব এ রহমান সাহেব ও অন্যান্যরা। ঘটি-বাটি-ডেকসি-কলসি-গামলাগুলা বাল-বাচ্চা-কিশোর-কিশোরি-বুড়ো-জোয়ান মর্দ মেয়েমানুষের মতন একটা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সেই লাইন শিব লিঙ্গের মতন নির্দিষ্ট একটা সিমেন্টের পাথরকে কেন্দ্র করে এদিক-ওদিক মিলিয়ে প্রায় দুই মাইল।
তখন রামনগরের বহু পুরনো কালের মাইনে বিহীন পাহারাদার নেড়িকুত্তাটা আল্লারদান হোটেলের সুবল কারিগর’র গরম গরম আমিত্তি ভাঁজার দিকে বিস্ফারিত চোখ নিয়ে ফ্রিজ শটে স্থির হয়ে আছে, যদিও ইতোপুর্বে গরম খুন্তির এক বাড়ি খেয়ে কোমরটা বাঁকা হয়ে আছে তার। বাঁক পেরোতে গিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার যাবার পর এক দঙ্গল পুরুষ-মহিলা-কিশোর-কিশোরির জটলা দেখে মাহবুব এ রহমান সাহেব গাড়ি থেকে নেমে জটলার সাথে প্রথমে চার-পাঁচ খানেক সেলফি তুলে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে, কথা শুরু করলেন।
‘. . . চৈত-বইশাখ আর শীত কালে ত পানিই পাই না। সকালে ঊঠি। ধইল পহরের সোমাই। ঘটি-বাটি নিয়া দৌড় দেয়, লাইন ধরন লাগব। আগে যাইলে আগে পাইব। কহন ফুত কইরে পানি বন্ধ অইয়া যায়! ধরেন আমরা আড়াইশ-তিনশ পরিবার হপ্তাই দুইদিন পানি পাই। ধরেন ঘর ফতি দুই কলস পানি প্রতি হপ্তায়। তারপর বেহান বেলা রান্না বান্না সাইরে গরু ছাগল মুরগি ছাইরে দিইয়ে পুরুষ মানুষ ঘেরে জন দিতে যাইবে। তয় আফনেরা কীডা? এক নিঃশ্বাসেই সখিনা বিবি কথা বলছিলেন, কিন্তু প্রশ্নটা করলেন একটু থেমে, ঢুক গিলে’।
মাহবুব এ রহমান সাহেব হিসাব করলেন প্রতি পরিবার সপ্তাহে তিরিশ থেকে চল্লিশ লিটার খাবার পানি পায় বছরে ছ’মাস। পরিবার প্রতি সদস্য সংখ্যা গড়ে ছয় জন। আর মাছ তরকারি চাল ডাল ধোয়া-পালা করার জন্য পুকুরের পানি। তাহলে আরো পানির প্রয়োজন প্রতি পরিবারে। এটুকু ভেবে মাহবুব এ রহমান সাহেব বিস্ফারিত চোখ নিয়ে ফ্রিজ শটে স্থির থাকা মগজে একটা মচৎকার আইডিয়া খেলে গেল। ব্যাংকে বহু টাকা অলস পড়ে আছে। এইখানে একটা পানির ভালো ব্যবসা হবে। ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন গাড়ি ঘোরা। সুন্দরবন দেখা লাগব না। ঢাকায় চল। ফিরে আসব আবার।
ফিরে আসার সময় পেছন থেকে জটলার ভেতরে স্থির থাকা বুড়ো আব্দুল মাবুদ ডাক দিয়া কইলেন- ছবি আফনের লাহান হগলেই তুলছে। কেউ কিচ্ছুটি করে নাই সাব। আফনে কিছু কইরেন।
ফুটনোটঃ ঢাকার মিরপুরে পানির সংকট পত্রিকার প্রথম পাতায় শিরোনাম হয়। ঢাকার গ্যাসের সমস্যা পত্রিকাওয়ালারা এমনভাবে জ্বালাময়ি ভাষায় তুলে ধরেন, মনে হয় সেই জ্বলনে ঢাকা জ্বলে যাবে, আশু সমস্যার সমাধান না হলে। মুকুন্দমধুসুদনপুর গ্রামের উৎপাদিত চিংড়ি আর কোরাল সেই জ্বলনে ঝলসিত হয়ে বড় গ্রামের বড় হোটেলের বড় মানুষের পাতে শোভা পায়। সেই চিংড়ি আর কোরালের শক্তি নিয়া শরির বানায় নানান উৎসবে সুপার মার্কেটগুলোর বাহারি ডিজাইনের জামা গায়ে তোলার জন্য। আর সখিনা বিবি তখনো এক কাপড়ে পানির কলসি কাঁখে নিয়া ঘরে ফিরে মাছের ঘেরে জন দিতে প্রস্তুতি নেয়। আল্লারদান হোটেলের গরম গরম আমিত্তির দিকে বিস্ফারিত চোখ নিয়ে ফ্রিজ শটে স্থির হয়ে থাকে নেড়িকুত্তাডা। শুধু একটাই প্রশ্ন- ক্যামনে চলে?
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৪:৩৫