সামহোয়ার ইনে ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান নিয়ে যেভাবে কনফ্রন্টেড হয়েছিলাম আসার একেবারে দ্বিতীয় দিন, সেরকম আগে কোথাও হই নি। এক সময় খুঁজে খুঁজে যখন ইসলাম নিয়ে কিছু বলা হলেই জবাব দেয়া শুরু করলাম, তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম, আমি কত কম জানি!
একদিন তর্কাতর্কির মাঝেই হঠাৎ থমকে গেলাম এক অদ্ভূত উপলব্ধিতে... কুরআনটা আমার তখনও পর্যন্ত নিজের ভাষায় আগা গোড়া পুরাটা একবারে পড়া হয় নি! খতম করেছি তো ছোটবেলা, সে তো আছে। এখান থেকে সেখান থেকে দারস পড়েছি, ব্যাখ্যা শুনেছি, অনুবাদ পড়েছি, কিন্তু কি আশ্চর্য, যেই আমি হাজার পৃষ্ঠার সুনীল কিংবা তার চেয়েও মোটা গন উইথ দ্যা উইন্ড পড়ে ফেলতে পারি এক সপ্তাহে, সেই আমি জীবনের প্রায় দুই দশক পার হয়ে ফেলেছিলাম কুরআনের মাত্র ছয় হাজার শব্দ আগা থেকে গোড়া রিডিং না পড়েই! অদ্ভূত লজ্জা নিয়ে কুরআনের অনুবাদ পড়া শুরু করেছিলাম সেই রমজানে, কয়েক বছর আগে। শুরু থেকে একটু একটু আরবির সাথে অনেক বেশি করে অনুবাদ পড়া শুরু করলাম প্রতিদিন। আর সে কি বিষ্ময়! কুরআনে অনেক কিছু এত সুন্দর ভাবে বলা আছে, যেটা আমি আগে কখনও শুনি নি! যেমন-- সূরা বাকারায় আল্লাহ যখন মুসলিমদের কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিচ্ছেন, তখন কি সুন্দর করে বললেন, "অবশ্যই নির্বোধ লোকেরা বলবে, “এদের কি হয়েছে, প্রথমে এরা যে কিব্লার দিকে মুখ করে নামায পড়তো, তা থেকে হাঠৎ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? হে নবী! ওদেরকে বলে দাও, “পূর্ব ও পশ্চিম সবই আল্লাহর ৷ আল্লাহ যাকে চান তাকে সোজা পথ দেখান।"... প্রথমে যে দিকে মুখ করে তুমি নামায পড়তে , তাকে তো কে রসূলের অনুসরণ করে এবং কে উল্টো দিকে ফিরে যায় , আমি শুধু তা দেখার জন্য কিব্লাহ নির্দিষ্ট করেছিলাম।" (সূরা বাকারা: ১৪২ ও ১৪৩ এর কিছু অংশ)।
ব্লগে কত তর্ক করেছি যখন কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়া নিয়ে লেখাগুলো আসতো, কিন্তু আমি যত কিছু বলেছি তার কিছু না বলে যদি এই দুইটা আয়াত বলে দিতাম, তাহলে সব বলা হয়ে যেত! আল্লাহ তো নিজেই বলছেন তিনি সব দিকে আছেন, কিন্তু তবু তিনি চান আমরা কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়ি শুধু মাত্র পরীক্ষা করার জন্য যে কে তাঁর কথা শুনে!
গত রমজানে মোবাইলেই আস্ত কুরআনটা ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। খুব ব্যস্ত ছিলাম তখন অনার্স ফাইনাল নিয়ে। ইউনিতে যাওয়ার পথে ট্রেইনে কিংবা ল্যাবে এক্সপেরিমেন্টের ফাঁকে ফাঁকে আইপডে আরবি কুরআন শুনতাম আর সাথে সাথে ইংরেজি অনুবাদ পড়ে নিতাম মোবাইল থেকে। মুহাম্মদ (সা) এর কাছে কুরআন লিখিত ভাবে আসে নি, তাই কানে শুনাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল আমার। ঠিক যেভাবে তিনি শুনেছিলেন চোদ্দশ বছর আগে, সেভাবে শুনতে চাচ্ছিলাম! তাছাড়া যেই লিংক দিলাম, মিশারী রাশিদ আল আফাসের, ওঁর কুরআন শোনার অভিজ্ঞতাই অন্যরকম। কুরআন পড়ার সময় তিনি সুর বদলান, যেখানে ভালো লাগার কথা সেখানে একরকম, যেখানে ভয়ের কথা, সেখানে আরেক রকম। ছয় বছর আগে প্রথম ওনার তেলওয়াত শোনার আগ পর্যন্ত আমাকে কুরআন তেলওয়াত তেমন টানতো না! চ্যালেঞ্জ করলাম, একবার শুনে দেখেন!
গত রমজানে পড়া একটা আয়াতের কথা এখনও মনে আছে... কুরআনে আল্লাহ বলেছেন কোন মেয়ের সত্বীত্তের ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ দেয়ার শাস্তি হচ্ছে আশি দোররা এবং অপবাদদানকারীকে সারা জীবনের জন্য মিথ্যাবাদী ঘোষণা দেয়া (সূরা নূর: ৪)। শুধু তাই না, যারা শুধু অন্য জনের মুখে শুনে এই কথা আরেকজনকে বলে, তার ব্যাপারেও ভীষণ কঠিন সব কথা! ভীষণ রকমের অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আয়াতটা পড়ে! বার বার পড়লাম! একটা মেয়ের ব্যাপারে একটা কথা উঠতে পারলেই হয়েছে, সত্য হোক মিথ্যা হোক, মেয়েটার সারা জীবন ধ্বংস হয়ে যায়.. এরকম ৮০% মুসলিমদের দেশে, প্রায় প্রতি বাড়িতে একটা করে কুরআন থাকা সত্ত্বেও! কি আশ্চর্য, মেয়েদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ আয়াত আমি প্রথম শুনেছি/উপলব্ধি করেছি জীবনের দুই যুগ পার হয়ে যাওয়ার পরে!!! কি ভয়াবহ লজ্জা!!! তাও আমার হাতের কাছেই কুরআন থাকে, জ্ঞানের একসেস এত বেশি, তবুও! বাংলাদেশের যেই নিরপরাধ মেয়েগুলো মুখ বুজে দোররা খেয়ে যাচ্ছে, তাদের হাতে কি কেউ একটা করে কুরআন তুলে দিতে পারে না যুদ্ধ করার জন্য!
রমজানে, বছরের সেরা দিনগুলোতে আল্লাহ কুরআন পাঠিয়েছিলেন আমাদের জন্য। প্রতি রমজানে তাই একটু একটু চেষ্টা করি কুরআন সম্পর্কে আরেকটু জানার। যত জানি, তত মুগ্ধ হই।
এবার মিফরার কাছ থেকে দারুণ একটা আইডিয়া পেলাম। মিফরা কুরআন পড়বে কুরআন ঠিক যেভাবে এসেছে, সেভাবে। আমাদের কাছে এখন যেভাবে কুরআন আছে, সেভাবে কুরআন রাসুল (সা) এর কাছে আসে নি। অনেক সূরাই আগে পিছে, রাসুল (সা) সেটা পরে সাজিয়ে দিয়েছেন আল্লাহর নির্দেশে। সূরা ফাতিহা এসেছে অনেক পরে, কিন্তু একেবারে প্রথম সূরা এখন। সূরা আলাক এসেছে একেবারে প্রথমে, কিন্তু এখন একেবারে শেষের দিকে। কুরআন যেই অর্ডারে এসেছে, সেই অর্ডারে কুরআন পড়লে ঠিক কিভাবে ইসলাম রাসুল (সা) এর কাছে এসেছিল, সেই ধারণাটা পরিষ্কার হতে পারে অনেক। কুরআন নাজিলের অর্ডারটা পাওয়া যাবে এখানে ।
অনেক সময় কুরআন পড়তে গেলে খুব রিপিটিটিভ ঠেকে, মনে হয় একই কথা তো পড়ে এসেছি দশ পাতা আগেও! কিন্তু সেই কথাটা কেন আল্লাহ আরেকবার বলছেন দশ পাতা আগে, সেটা যদি জানা যায় কুরআনের ব্যাখ্যা পড়ে, তাহলে নিজেরই মাথায় বাড়ি দিতে ইচ্ছা করে স্রেফ পুনরাবৃত্তি ভাবার জন্য! ইবনে কাসিরের তাফসীরের বাংলা অনুবাদ কেমন আমি জানি না। আপাতত আমি ইবনে কাসিরের ইংরেজি অনুবাদ পড়ছি, যত পড়ছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি!
আরেকটা জিনিস আমার হয়তো এই রমজানে ধরা হবে না, কিন্তু খুব ইচ্ছা আছে কখনও শুরু এবং শেষ করার! এই ওয়েবসাইটে মাত্র কয়েক শ' শব্দ আছে, যেগুলো শিখলে কুরআনের ৮০% শব্দ শিখা হয়ে যাবে (কারণ কুরআনে একই শব্দ অনেকবার এসেছে)! আমি ভাবতেও পারি না, যেই কুরআন যুগ যুগ ধরে আমরা মাটিতে ছুঁতে দেই নি, সবচেয়ে উঁচু শেলফে রেখে দিয়েছি, ওজু ছাড়া ছুঁয়েও দেখিনি, সেই কুরআনের ৮০% শুধু মাত্র পড়েই বুঝে ফেলার অনুভূতি কেমন হবে! কিন্তু সত্যি, খুব ইচ্ছা করে সেই অভিজ্ঞতা পাওয়ার... ।
বছরের সেরা দিনগুলোর আসতে মাত্র এক সপ্তাহ বাকি... যখন ছোট ছিলাম, তখন রোজা আসত আর যেতো, না খেয়ে থাকার একসাইটমেন্ট আর ঈদের নতুন জামার আনন্দের চেয়ে বড় কিছু রমজান থেকে পাই নি। আস্তে আস্তে যখন জানলাম, এটা শুধু 'রমজান' না, বছরের সেরা দিনগুলো... তখন দিনগুলো চলে গেলে ভীষণ বিষণ্নতায় ভুগতাম। কেন জানেন? এই দিনগুলোতে শয়তানগুলো বন্দী থাকে সব। কিন্তু কি আশ্চর্য, শয়তানের অনুপস্থিতিতেও আমার কাজে, চিন্তায়, মেজাজে বড় সড় ধরণের কোন পরিবর্তন আসতো না! যখন ভিতরে চোরা ভয়টা ঢুকে যাওয়া শুরু করলো, শয়তানটা আসলেই হয়তো আমার মনটাকে ইচ্ছে মত বাগিয়ে নিয়েছে, তখন থেকেই ঈদের দিন যত আগাতো তত বেশি বিষণ্নতায় ভুগতাম!
এবার ভীষণ ইচ্ছা ঈদের দিন জোরে সোরে একটা 'আলহামদুলিল্লাহ' বলা... এই সুন্দর মাসের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তারপরে। পারব কি না জানি না!!!
মিফরা মেয়েটা থেকে আরেকটা আইডিয়া পেয়েছি, এটা বলে শেষ করছি। রমজানে দোআ কবুলের সময়ের ছড়াছড়ি। রোজা রাখলে ইফতারে আগে দোআ কবুলের সময়, তারাবীর পরে, সেহেরীর আগে, শেষ দশ দিনের রাতগুলোতে। এই সময়গুলোতে আল্লাহর কাছে হাত তুলে কিছু চাইলে সত্যি মনে হয় আল্লাহ শুনছেন! অসংখ্য প্রমান আছে আমার নিজের জীবনে, অসম্ভব সব কিছু চেয়ে দিব্যি পেয়ে গিয়েছি... এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না কিন্তু...। যারা ওই সময়গুলো মিস করছেন, তারা সত্যিই মিস করছেন... ।
মিফরা এবার বললো, যত যা কিছু আছে, একটা লিস্ট করে প্রতিদিন চেয়ে যাও। আল্লাহ যদি একদিন দোআ কবুল করেন, তাহলে বাকি ঊনতিরিশ দিনে কোন কারণে তোমার রোজা আল্লাহ পছন্দ না করলেও অসুবিধা নেই, ওই একদিনে তো দোআগুলো সব কবুল হয়ে যাবে!
আইডিয়াটা সত্যিই খারাপ না!