বিয়ে: আন্তরিকতা আর প্রফেশনালিজম
রিফাত ভাইয়ের বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল পনের। তখনই শুনেছি ভাইয়া ভাবীর প্রেমের বয়স প্রায় বারো। কত যুদ্ধ করে যে বিয়ে করলো অবশেষে দু'জনে। কিন্তু বিয়ের দিন ভাবীকে নিয়ে যাওয়ার সময় ভাবীর কান্না দেখে কে! এক পর্যায়ে ভাবী পুরা বেহুঁশ, ভাইয়া বিব্রত মুখে দুই হাতে শক্ত করে ভাবীকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ পানি আনে, কেউ বাতাস দেয়।
এর কয়েক দিন পরেই বিয়ে হল কবির মামার। মামা মামীর আকদ হয়েছিল ছয় মাস আগে। বিয়ের দিন মামীর চোখে এক ফোঁটা পানি নেই। মামীর মা কাঁদছিলেন, মামী শুধু ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে আসলেন। মামীর আড়ালে তখন সবাই ফিসফাস--বউ মানুষ না কাঁদলে ক্যামন লাগে!
সেই পিচ্চি আমার চোখে এত বিসাদৃশ লাগছিল ব্যাপারটা! এত বছরের পরিচয়ের পর বিয়ে হলো, তখন কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হতেও কেউ কিছু বললো না, যেন সেটাই স্বাভাবিক! অথচ অনেক আগে আকদ হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকতার দিন না কাঁদলেও ছি-ছি! এ কি কান্ড! কোনটা স্বাভাবিক?!
সেদিনের পর বাবা মাকে বিপক্ষে রেখে আমার আর ভাইয়ার সেকি তর্ক! বিয়ের সময় শুধু মেয়েরা কাঁদবে কেন? ছেলেরা কাঁদবে এটা তো কেউ আশা করে না! আগে না হয় মেয়েরা বিয়ে করে বাপের বাড়ি চলে যেত, জীবনে নিজ বাড়িতে আসা হতো না আর। 'কন্যাদান' করা হতো আগে, এখন তো আর কন্যাদান করা হয় না! বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা শ্বশুড় শ্বাশুড়ির সাথে থাকেও না! থাকলেও বাবা মায়ের সাথে সেই আকাশ পাতাল দুরত্ব তো থাকে না। একটা ছেলে তার বাবা মা থেকে যতটুকু সরে যায়, মেয়েটারও ঠিক তা-ই হয়।
মা প্রতি উত্তরে বলেছিল, আরে বোকা, মেয়েরা চলে যাচ্ছে বলে কাঁদে না, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাঁদে।
- কই, ছেলেদের জন্য ভবিষ্যতটা অনিশ্চিত না? শুধু মেয়েদের জন্যই অনিশ্চিত?
মা আমাদের এই চরম যুক্তি মাটিতে গুঁড়িয়ে দিয়ে বললেন, ছেলেরাও কাঁদে, শুধু সবার সামনে কাঁদে না!
তারপর আর কি, আমি ভাইয়া দু'জনেই এই সিদ্ধান্ত নিলাম---ঠিক যতটুকু কান্না আসা স্বাভাবিক, ততটুকু কাঁদলে অসুবিধা নাই। কিন্তু এর বেশি কান্নাটা বড় বেশি নাটুকে!
বাংলাদেশে আমার স্কুলের ৮০% বান্ধবীর নিজের পছন্দের বিয়ে হচ্ছে। প্রায় আধা যুগ পরিচয়ের পরে যখন ওরা অবশেষে বিয়ে করে, তখন ওদের জন্য হাউ-মাউ কান্নাটা স্বাভাবিক বলে মনে হয় না একদম!
আর বাকি ২০% বিয়ের আগেই আকদ করে ফেলে সকাল বেলা। একেবারে প্ল্যান করে, যেন কান্নাকাটিতে মেইকআপ নষ্ট না হয়ে যায়!
মন্তব্য আর পোস্ট পড়ে মনে হলো, ঠিক এইখানেই সবার প্রবলেম। এত বেশি প্ল্যানিং, কেউ মানতে চাইছে না! কিন্তু প্রফেশনালিজম আর পারফেকশন বজায় রাখতে চাইলে প্ল্যানিং আর রিহার্সেলের বিকল্প নেই। অত প্ল্যান না করলে আন্তরিকতা বজায় থাকবে ঠিকই, কিন্তু প্রফেশনালিজম জানালা দিয়ে পালাবে!
আমার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হওয়ার ঠিক ছয় দিন পরে বিয়ে হলো।
বাড়ি ভর্তি মানুষের হুড়োহুড়ির মধ্যে আমার বিয়ের স্টেজ হিমেল ভাইয়া বানিয়ে দিল--মায়ের বিয়ের পঁচিশ বছরের পুরানো লাল টুকটুকে কাতান শাড়ি দিয়ে!
সেদিন যখন মাত্র পনেরো দিন আগে প্রথম পরিচয়ের মানুষটা এসে পাশে বসলো তখন ভীষণ লজ্জা লাগছিল। আর পরিস্থিতিটা এত অদ্ভূত ছিল যে ভীষণ হাসিও পাচ্ছিল! আমি ভাবতেই পারছিলাম না, এই মানুষটাই এখন আমার সবচেয়ে আপন! বান্ধবীরা পাশ থেকে চেতিয়েই যাচ্ছে, কিন্তু ওদের কি করে বুঝাই আমার এত হাসি পাচ্ছে কেন?!বরের পাশে বসা বেশির ভাগ ছবিতে আমি মুখ টিপে হেসেই যাচ্ছি!!! আয়না দেখতে গিয়ে দুষ্টামিও করলাম। আয়না ঠিক মত হচ্ছিল না বলে বর নিজ হাতে আয়না ধরে দেখে নিল বউকে। চারিদিকে তখন হইহুল্লোড় পরে গেল। এগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবে হয়েছিল তখন, ইমোশনটাই ওরকম ছিল, বাস্তবতাটাই বড় বেশি স্বপ্নালু ছিল!
এখন ভাবলে খুব ভালো লাগে যে বিয়ের দিন হেসেছিলাম! ভাগ্যিশ! না হলে এত সুন্দর দিনটায় শুধু কান্নার স্মৃতি থাকতো! কেঁদেছি তো অবশ্যই, কাঁদব না! বিয়ের আগের ছয় দিন যত চোখের পানি ফেলেছি, সারা জীবনেও হয়তো তত চোখের পানি ফেলি নি! তখন তো ছিল বুক জুড়ে তীব্র ভয় আর অনিশ্চয়তা। অনেকগুলো বছর আগে মায়ের বলা কথাটার সতত্যা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু তবু মানুষের সামনে কেঁদেছি খুব অল্প। এতগুলো ক্যামেরা ধরা মুখের উপর, আনাড়ী ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, মোবাইল ক্যামেরা…--সব মিলিয়ে এত অস্বস্তি লাগছিল যে কাজী এসে জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথে কবুল বলে দিয়েছিলাম। বাবা মা যখন খুব কাঁদছিল, তখনও শুধু নি:শব্দে কেঁদেছি। এত ক্যামেরা আর মানুষের সামনে কাঁদাটাই কেমন নাটুকে নাটুকে লাগে!
সেদিনের প্রতিটা মুহূর্ত আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমাকে যদি কখনও সুযোগ দেয়া হয় অতীতে গিয়ে কিছু বদলানোর, আমি সেই দিনটার কিছুই বদলাবো না!
কিন্তু এগুলো শুধু আমার কাছে আর আমার পরিবারের মানুষগুলোর কাছে মূল্যবান। অতিথিদের কাছে না। অতিথিদের কাছে স্টেইজের লাল কাতানটা অর্থবহ না, তার চেয়ে আধুনিক কম্যিউনিটি সেন্টারগুলোর সেই গতবাঁধা কাঁচা ফুল আর ছোট ছোট লাইটগুলোর এসথেটিক মূল্য অনেক বেশি!
আমার শ্বশুড় বাড়ি থেকে যেই রিসেপশনটা হলো, সেদিনের জন্য শ্বাশুড়ি কত ঘুরে শাড়ি কিনে দিলেন! তারপর ম্যাচিঙ ওড়না, জুতা, চুড়ি, গোল্ড প্লেইটেড রূপার গয়না, কত কি! অথচ এত দিনের কষ্ট আর অর্থব্যয় যেই দিনের জন্য, সেই দিন ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে বসে থাকা ছাড়া আমার কোন স্মৃতিই নেই! সারাদিনের পরে বাড়ি ফিরে বড় অ্যান্টি-ক্লাইমেটিক লাগছিল, কি হলো কিছুই বুঝলাম না! দেড়শটা ছবি তোলার জন্য এত কিছু!
অথচ, আমাদের বিয়ের দিনের চেয়ে, সেই রিসেপশনের দিন অতিথিরা অনেক বেশি খুশি ছিল! খাওয়া দাওয়া পারফেক্ট, ভেন্যুটা ছিল পারফেক্ট, স্টেইজটা ছিল দারুণ, সব কিছু হয়েছিল এক্কেবারে সময় মত!
সিডনীতে আমার ছোট্ট একটা রিসেপশন হয়েছিল। সেটাও টিপিক্যাল রিসেপশনগুলোর মত হয় নি। রিসেপশনের সমস্ত দায়ভার পরিচিত আংকেল আন্টিরা নিয়ে নিলেন। ওদের একটাই কথা, আমাদের মেয়েরা বড় হয়ে হয়ে দেশে গিয়ে বিয়ে করে আসে, আমরা বিয়ে খেতে পারি না, মজা করতে পারি না, এটা কোন কথা হলো?! বিয়ের চারশ মানুষের সমস্ত রান্না করলেন সেই আংকেল আন্টিরা, নিজেদের মেয়ের বিয়ে বলে কথা! আংকেলরা এক সাথে হয়ে সারা রাত মশলা বাটলেন, আন্টিরা রাত জেগে জেগে মিষ্টি আর জর্দা বানালেন! আর রিসেপশনের দিন সারাদিন আমার মুখে বিশাল একটা হাসি ছিল, কারণ আমি যেই স্টেইজে বসেছিলাম সেটার মূল ডেকোরেশন এবং প্ল্যানিং করেছে 'বর' স্বয়ং, আমার জামাই!!!
মায়ের বিয়ের কাতান শাড়ি, নিজ স্বামীর হাতের ডেকোরেশন, এগুলো আমি হাজার হাজার টাকা দিয়েও কিনতে পারব না, জানি। কিন্তু অ্যামেচার কিছুই প্রফেশনাল জিনিসের মত এত সুন্দর হয় না। আমার রিসেপশনটা অন্যান্য সব রিসেপশনের মত 'পিকচার পারফেক্ট' হয় নি সত্যি, অনেক কিছুতেই প্রফেশনালিজম বজায় থাকে নি, কিন্তু আমাকে যদি আবার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে আমি আবারও প্রফেশনালিজমের চেয়ে আন্তরিকতা প্রেফার করব! প্রফেশনালিজমের অনুপস্থিতিতে, আন্তরিকতার উত্তাপে অনেক গল্প জন্ম হয়, সেগুলোই আমার কাছে অমূল্য।
কিন্তু অতিথিদের কাছেও কি তাই? মনে হয় না!
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন