ফ্রান্সে তো মাঝে মাঝেই বিতর্কের ঝড় উঠে নিকাব বুরকা নিয়ে।
আর বেলজিয়াম ... তর্ক বিতর্কের পালা সেরে পার্লামেন্টের ১৪১ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের ভোটে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, বেলজিয়ামের রাস্তা ঘাটে, পার্কে, কোন পাবলিক জায়গায় 'চেহারা অস্পষ্ট হয়ে যায়' এমন কোন 'কাপড়' পরা যাবে না। আইনে বলা নেই, কিন্তু অলিখিত সত্য হচ্ছে, এই আইনের আওতায় পড়ছে একমাত্র মুখ ঢেকে বের হওয়া মুসলিম মেয়েরা।
বেলজিয়াম রাস্তা দেখিয়ে দিল। এখন আস্তে আস্তে ফ্রান্স, জার্মানী, ইংল্যান্ড সে পথে যাবে কি না, তা সময়ই বলে দিবে। বুরকা আর নিকাব ব্যানের যৌক্তিকতা যাচাই করার সময় এখনই। তাই কীবোর্ডে হাত দেয়া।
লেখার সুবিধার্থে কিছু শব্দ ব্যাখ্যা করে নেই যেন পাঠক আর আমি একই শব্দ দিয়ে একই জিনিস বুঝিয়ে থাকি। হিজাব হচ্ছে শুধু মাথার স্কার্ফ, ওড়না ইত্যাদি, যাতে পুরা মুখ খোলা থাকে। আর বুরকা দিয়ে সারা শরীরের সাথে সাথে মুখের পুরাটুকুই বা কিছু অংশ ঢাকা থাকে। নিকাবে শুধু চোখদু'টো খোলা থাকে। বুঝার সুবিধার্থে ছবি দিলাম। তর্ক বিতর্কগুলো নিকাব আর বুরকা ব্যান নিয়েই, হিজাব ব্যানের কথা এখনও কেউ বলছে না।
এখানে উল্লেখ্য যে হিজাব ব্যানের কথা হচ্ছে না মোটেই। হিজাবের সাথে একই দলে পরে যাবে খ্রীষ্টিয়ান নানদের মাথার কাপড়, রক্ষনশীল ইউরোপিয়ান বুড়িদের মাথার স্কার্ফ, শিখদের আর মুসলিমদের মাথার পাগড়ী, তারপর একে একে খ্রীষ্টিয়ান ক্রস, জুইশ টুপি ইত্যাদি। কিন্তু নিকাব বা বুরকা জিনিসটা মোটামোটি স্বতন্ত্র্য। অন্য কোন ধর্মে ধর্মীয় কারণে মুখ ঢাকার চল নেই। তাই এই আইনের আওতায় শুধু মুসলিম মেয়েরা, তাও সমাজের খুব অল্প একটা অংশ আটকা পরে যাচ্ছে।
প্রথম যুক্তি দেয়া হচ্ছে নিরাপত্তা। যার মুখ ঢাকা থাকে, তাকে চেনা যায় না, তাই দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পরে যায়।
যুক্তিটা প্রথমে খুব ই যুক্তিযুক্ত শোনায়। কারণ, সাধারণ চিন্তা বলে, এটাই সবচেয়ে সহজ ছদ্মবেশ। কিন্তু, সত্য হলো: আজ পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বে যত স্বন্ত্রাসী কাজকর্ম হয়েছে, তার কোনটাতেই বুরকা বা নিকাবে মুখ ঢেকে 'অপারেশনে' নামে নি আক্রমনকারীরা। বুরকা পড়লে সন্দেহ বাড়বেই, যারা সন্ত্রাসী তারা আর কিছু না হোক, ছদ্মবেশের উপর ভালোভাবে রিসার্চ করে নেয়, বুরকার মত এত সহজ ছদ্মবেশে ঢুকবে না।
সব ধরণের ছদ্মবেশ থেকে দেশকে মুক্ত রাখার পরবর্তী ধাপ হতে পারে এরকম: বেলজিয়ামে ঢুকার সাথে সাথেই সবার দাড়ি গোফ কেটে পরিষ্কার করতে হবে। বেলজিয়ামের ভিসা পাওয়ার পূর্ব শর্ত হবে সাথে ক্লীন শেভড একটা ছবি থাকতে হবে। আফটারঅল, সব সন্ত্রাসী আর ক্রিমিনালরাই ছদ্মবেশের শুরু করে দাড়ি গোঁফ দিয়ে…
দ্বিতীয় খুবই কমন কিন্তু একই রকম উদ্ভট যুক্তি হচ্ছে, নিকাব, বুরকা মেয়েদের জন্য অবমাননাকর। যেই মেয়েটা বুরকা পড়ছে, সে কি নিজের অস্তিত্ব নিয়ে বিব্রত? মুখ ঢাকতে হবে কেন? নিকাব আর বুরকার মত অপমান থেকে মেয়েদের বাঁচাতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ আবশ্যক।
এই যুক্তিটা যারা দেয়, তারা বলে না, বেলজিয়ামে মাত্র ৩০ জন মেয়ে নিকাব পরে!
ধরে নিলাম নিকাবে সেই ৩০ জনের নারীত্বের ভয়াবহ 'অবমাননা' হচ্ছে। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যক 'বেলজিয়ান' মেয়েরা প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রকৃতি প্রদত্ত চেহারা নিয়ে অশ্রুজল ঝরাচ্ছে। হাজার হাজার টাকা হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে কসমেটিক সার্জারী করে ভোঁতা নাককে খাড়া করতে, মোটা ঠোঁটকে চিকন করতে, নিচু বুককে উঁচু করতে আর উঁচু বুককে নিচু। মুখের কুঁচকানো চামড়াকে টেনে সোজা করতে। ব্রিটেনে প্রতি বছর ১ লক্ষ প্লাস্টিক সার্জারী হয়, আমেরিকায় ২০০৭ সালে ১২ মিলিয়ন প্লাস্টিক সার্জারী হয়েছিল। প্রতিদিন এর চেয়েও আরও অনেক বেশি মেয়ে ছুটছে চুলের রং, নখের রং, গায়ের রং, ভুরুর আকার বদলাতে। প্লাস্টিক সার্জারীর বিজ্ঞাপন হিসেবে একটা ওয়েবসাইটে লেখা:
"Cosmetic surgery is about perception and self esteem. The perception of looking and feeling good about your body image sends a signal to the world that you are confident and successful." (কসমেটিকপ্লাস্টিক ডট কো ডট ইউকে)।
মহা আশ্চর্য হয়ে ভাবতে হয়, এত ভয়াবহ কথাগুলো স্পষ্ট করে বলার পরেও প্লাস্টিক সার্জারী আর বিউটি পার্লারের রমরমা ব্যবসার কিছুই হয় না, বেলজিয়ামের, ফ্রান্স আর ব্রিটেনের লক্ষ লক্ষ মেয়ে ছুরি কাঁচির যন্ত্রনা সহ্য করে যায় নিজেদের চেহারা নিয়ে 'লজ্জা' কাটাতে, আর দেশের মাত্র ৩০ জন মেয়ের চেহারা নিয়ে লজ্জাবোধ কাটাতে একেবারে পার্লামেন্টের আইন পাশ! বাহ!
যারা উপরের যুক্তিটা দিয়েই নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন, তারা নিজেদের শুধরে নেন নিচের যুক্তিটা দিয়ে: অনেক মেয়েকে জোর করে নিকাব পড়ানো হয়। বাবা, স্বামী বা ভাই, সোজা কথা পুরুষ আত্মীয়দের এই অন্যায় অবিচার থেকে মেয়েদের রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
এই যুক্তির সাথে আমি পুরাপুরি একমত। আমার এক বিন্দু দ্বিমত নেই সত্যি।
যেই মেয়েদের জোর করে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিকাব পড়ানো হয়, বুরকায় আবৃত করা হয়, তাদের মুক্তির দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের।
কিন্তু বুরকা ব্যান কি আসলেই সমস্যার সমাধান? যেই মেয়েরা মুখ থেকে একটা পাতলা কাপড় সরাতে পারে না পুরুষ আত্মীয়দের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে, বুরকা ব্যান করলেই কি ওদের মুক্তি হবে? না। তখন সেই পুরুষ আত্মীয়রা তাদের 'সম্মান' আর 'ধর্ম' রক্ষার খাতিরে তাদের ঘর থেকেই বের হতে দিবে না। বুরকা পড়ে ঘর থেকে বের হওয়ার স্বাধীনতাটুকু তো ওরা অন্তত: ভোগ করতে পারত, প্রয়োজনে সরকারী বেসরকারী সংস্থাগুলোর সাহায্য নিতে পারত, বেলজিয়ান সরকার সেই পথটুকুও সেঁটে বন্ধ করে দিল।
আর নারী আন্দোলন, আর নারী মুক্তির কথা যারা বলে, তারা কিভাবে এই আইনকে সমর্থন করছে, যেখানে পশ্চিমে বেশির ভাগ নিকাব পরিহিতাই নিজের ইচ্ছায়, জেনে বুঝে নিকাবকে গ্রহন করে? আমি সিডনীতে মাত্র দুইজন নিকাবীকে চিনি। এদের দুইজনই টিনেজ থাকা অবস্থায় ইসলামে এসেছে। একজনকে নিয়ে একবার লিখেছিলামও। এরা অধিকার সচেতন, আত্মসচেতন, আত্মবিশ্বাসী, সফল, বুদ্ধিমতী মেয়ে। নিকাব ওদের নিজেদের বেছে নেওয়া। ওদের কাছ থেকে নিকাবের অধিকার কেড়ে নেওয়া মানে হচ্ছে একটা মেয়ে যা 'উম্মোচন' করতে চাইছে না, তা উম্মোচন করতে তাকে বাধ্য করা। নিকাব দিয়ে শুরু এই আধুনিক বর্বরতা।
একটা আইন করার আগে ভবিষ্যতে এর প্রভাব কি পরতে পারে, সেটা ভাবতেই হবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মত মানবাধিকার সংস্থাগুলো বেলজিয়ামের নিকাব ব্যানের বিরোধিতা করেছে, প্রতিবাদ করেছে, সুদূরপ্রসারী ঋনাত্মক প্রভাবের ভয়ের কথা জানিয়েছে। চিন্তা করে দেখুন, ফেইথ মরিসদের যখন রাষ্ট্রীয় ভাবেই আইনের রক্ষকেরা যখন ওদের পথে ঘাটে, পার্কে আইনের দোহাই দিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য করে অপমান করবে, তখন সাধারন মানুষেরা কি করবে? বর্ণবাদী, রেইসিস্ট, অজ্ঞ মানুষের কি অভাব আছে, যারা আইনকে নিজের মত করে ব্যাখ্যা করবে? সরকার যেখানে নিজেই বলে দিচ্ছে মুখ ঢাকতে হলে সেই দেশের মাটিতে জায়গা হবে না, সেই মানুষগুলোর প্রতিক্রিয়া তখন কেমন হবে? বিবিসির একটা অপিনিয়ন পোলে একজন বেলজিয়ান আইনের সার্থকতা যাচাই করেছিলেন এক বাক্যে:
"This law will offend those who want to wear headscarves, crucifixes or other symbols of their religion, and only benefit those who are somehow offended by seeing the symbols of other people's beliefs in public."
'... এই আইনটা শুধু তাদের উপকারে আসবে যারা অন্যদের বিশ্বাসের প্রকাশ্য চিহ্ন দেখতে অস্বস্তি বোধ করে'।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ছয় লাখ ইহুদীকে ধুঁকে ধুঁকে মারার প্রক্রিয়াটা একদিনে শুরু হয় নি। দীর্ঘদিন ধরে জার্মানদের বুঝানো হয়েছে, ইহুদীরা পঁচা, ওদের জার্মানীতে থাকার অধিকার নেই। আস্তে আস্তে একদিন ইহুদীদের থাকার জায়গাগুলোর চারপাশে দেয়াল তুলে দেয়া হলো। ইহুদীদের গায়ে হলুদ রঙের তারা ঝুলিয়ে ঘুরতে হতো, সীল ছাপ্পড় দেয়া জন্তুর মত। ইউরোপ এই ভয়াবহ গণহত্যার সাক্ষী, তাই একটা জাতিকে কিভাবে সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেটা ইউরোপ খুব ভালো বুঝে।
তারপরেও, মানুষ বার বার ইতিহাসের নিদারুণ ভুল চক্র ধরে হাঁটতে থাকে
------
লেখাটা লিখেছিলাম ৬ মে। এর পরের আপডেইট:
১. ইংল্যান্ডে ভোট হয়ে গিয়েছে এবং উপরের মন্তব্য করা ভদ্রলোকের দল সংসদে একটা সীটও পায় নি!
২. ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি বুরকা ব্যানের সিরিয়াস মিশনে নেমেছেন। তাঁর ভাষায়:
''We are an old country anchored in a certain idea of how to live together.
''A full veil which completely hides the face is an attack on those values, which for us are so fundamental. Citizenship has to be lived with an uncovered face. There can therefore be absolutely no solution other than a ban in all public places.''
পড়ে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে ছিলাম, হতভম্ব হয়ে। একটা পশ্চিমা দেশের প্রেসিডেন্ট, তাও ফ্রান্সের মত প্রগতিশীল সরকার কিভাবে এই কথা বলে পার পেয়ে যায়: ''We are an old country anchored in a certain idea of how to live together." "আমরা একটা প্রাচীন দেশ, একসাথে থাকার জন্য আমাদের কিছু নিজেস্ব নির্দিষ্ট ধারণা আছে।"
পুরানো দেশ, এক সাথে থাকার নির্দিষ্ট ধারণা, পশ্চিমা একটা দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে ও এটা কি বলে?
এর পরে কি বলবে, ফ্রেঞ্চরা ঐতিহ্যগত ভাবে কখনও সুশি খায় নি, তাই চাইনীজদের ফ্রান্সে থাকতে হলে সুশি খাওয়া বন্ধ করতে হবে? ফও কি সাদাদের বর্ণবাদী ইতিহাস জানে না? ভিন্ন সংস্কৃতিকে জড়িয়ে ধরতে না পারার সংকীর্ণতাকে দু'পায়ে ঠেলে দূরে পাঠানো কি বর্তমান পশ্চিমের জীবনধারার আদর্শের অংশ না?
৩. অস্ট্রেলিয়ার সিনেটে উঠেছে বুরকা ব্যানের তর্ক । তাতে মাত্র ৩ জন হ্যা ভোট দিয়েছে! থ্যাংক য়ু অস্ট্রেলিয়া! ফ্রেড নীলের অবশ্য বুরকা এলার্জি বহু আগের। কয়েক বছর পর পরই বুরকা ব্যানের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু তেমন কাউকে পক্ষে জুটাতে পারে না।
৪. ফ্রান্সের বুরকা ব্যান আলোচনার (বুরকা ব্যান অফিশিয়াল হওয়ার আগেই) প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া: একজন আইনবিদ নিজ হাতে আইন তুলে নিয়ে শপিং সেন্টারে একজন নিকাবীর নিকাব টেনে ছিঁড়ে ফেলেন।
Click This Link
আমি নিকাব পড়ি না। কিন্তু চিন্তা করি আমার দাদী, যিনি সারা জীবন পর পুরুষের সামনে মুখ ঢেকে চলেছেন, তিনি ফ্রান্সে গেলে শপিং সেন্টারে যদি তার নিকাব ছিঁড়ে ফেলতেন একজন দাম্ভিক আইনবিদ, আমার কেমন লাগত?