"...নারীর গর্ভধারণ একান্ত পাশবিক কাজ। নারীকে কি চিরকালই ধারণ ক'রে যেতে হবে গর্ভ, পালন ক'রে যেতে হবে পশুর ভূমিকা? গর্ভবতী নারী দেখতে অনেকটা গর্ভবতী পশুরই মতো, দৃশ্য হিশেবে গর্ভবতী নারী শোভন নয়, আর গর্ভধারণ নারীর জন্যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক।..."
বইটা এনেছি এক বাঙালি আন্টির বাসা থেকে। আন্টি বই দেয়ার সময় বলেছিল, এম্মা এটা নিচ্ছো? আমি তো বিখ্যাত বই বলে এনেছি, শেষ করতে পারি নি, এত্ত বিশ্রী, বমি পায়।
আমি তবুও আনলাম। বিখ্যাত বই বলেই। এও শুনেছি, নারীদের নিয়ে লেখা বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ বই! এতকাল পড়ার খুব শখ ছিল, সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করব কেন?
বলছি হুমায়ূন আজাদের 'নারী' বইটা নিয়ে। উদ্ধৃতিটুকু ৩২০ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া।
শুরু থেকে খুব চমক দেয়া কিছু পাই নি। সাইকোলজিতে ফেমিনিস্ট আন্দোলনের অনেক চিন্তাধারা চলে আসে, তাই লজিকগুলোর সাথে আমি পরিচিত। ধর্মে নারীর অধিকার নিয়েও পড়াশোনা করেছি নানা সময়ে। এদিক ওদিক দুই দিকই। সেক্যুলার ভিউ পয়েন্টটা অনেক বার এত ভাবে পড়েছি যে স্রেফ চর্বিত চর্বন পুনরাবৃত্তি ঠেকছিল। সত্যিই নতুন কিছু পাচ্ছিলাম না বইটায়... এই লাইনগুলোতে আসার আগ পর্যন্ত।
গর্ভধারণ পাশবিক কাজ!
গর্ভ ধারণ করা পশুর ভূমিকা!
গর্ভবতী নারী দেখতে গর্ভবতী পশুর মতো!
আমি হতভম্ব হয়ে বইয়ের পাতায় তাকিয়ে ছিলাম। হতভম্ব, আতঙ্কিত আমি আপাদমস্তক শিউরে উঠেছিলাম।
লেখক কি এই বই লেখার সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স টের পেয়েছেন তার জীবদ্দশায়? এই লাইনগুলো।
খুব আগ্রহ করে বইটা এনেছিলাম, পুরা দেশে হই চই ফেলে দেয়া খুব সাহসী বই নাকি! পড়ে বড় হতাশ হলাম। 'নষ্টনীড়' অধ্যায়টা পড়লাম রম্য হিসেবে। পুরা অধ্যায়টার ভিত্তিই তথ্যগত ত্রুটির উপর। শরীরের ডিফেন্স সিস্টেম, উর্বরতা, মিলনের আগ্রহ, সব একে অপরের সাথে জড়িত। এই লিংকটা তিনি দেখেন নি বলেই ত্রুটিটা হয়েছে। এর বেশি এই প্রসঙ্গে বলা যাচ্ছে না...
'ফ্রয়েড সফল মনোবিজ্ঞানী, কিন্তু ব্যর্থ সমাজবিজ্ঞানী'... বইটা যতদিনে লেখা হয়েছে, ততদিনে মনোবিজ্ঞানীরা স্বীকার করে নিয়েছেন যে ফ্রয়েড মনোবিজ্ঞানী ছিলেন না। ফ্রয়েড বিজ্ঞানী ছিলেন না। সমাজবিজ্ঞানী হলে হতে পারেন, কিন্তু তিনি বিজ্ঞান সম্মত থিওরী দেন নি, বিজ্ঞানের পথ ধরে। অথচ, বইটার একটা বড় অংশ জুড়ে ফ্রয়েডের 'বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব'!
আর ইসলাম নিয়ে তথ্যগত ত্রুটি, অনিচ্ছাকৃত/ইচ্ছাকৃত অন্ধত্ব না হয় না-ই ধরলাম!
এই লেখক সম্পর্কেই একবার ব্লগে একজন মন্তব্য করেছিলেন, হুমায়ূন আজাদ নবী রাসুলদের চেয়েও মহৎ মানুষ। তাঁর দ্বিতীয় বইটা পড়লাম মহত্ব খুঁজে বের করার প্রবল আগ্রহ থেকে। বিনিময়ে পেলাম, গর্ভবতী নারীকে দেখতে গর্ভবতী পশুর মত লাগে!!!
আমি তীব্র কষ্ট নিয়ে, বেদনায় নীল হয়ে অক্ষরগুলো দেখছিলাম।
গত বছর এনাটমিতে একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম, 'দ্যা এমেজিঙ হিউম্যান বডি'।
একজন নারীর গর্ভে একটা ডিম্বক নিষিক্ত হওয়া থেকে শুরু করে সন্তানের জন্ম হওয়া পর্যন্ত পুরাটুকু টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম। ডকুড্রামার শুরুতে একটা কথা বলেছিল। পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে সবচেয়ে বড় মিরাকেলটা হচ্ছে--মানবজন্ম। শুধু আমরা যথেষ্ট জানি না বলে উপলব্ধি করি না।
পুরাটা দেখা শেষ করে দেখি আমার চোখে পানি! ডকুড্রামা শেষে ঘরের লাইট জ্বলতে জ্বলতে লুকিয়ে চোখের পানি মুছলাম। মাকে আরও বেশি ভালোবাসতে শিখলাম। ফিরে এসে বিহ্বল আমি বুক ভরা আবেগ নিয়ে এটা লিখেছিলাম।
গর্ভধারণকে পশুর ভূমিকা বলা শুধু পুরুষ হিসেবে অপরাধ না, 'মানুশ' হিসেবে অপরাধ! বইটা দু'দিন ধরে পড়ছিলাম একটু চমক খুঁজতে, একটু অসাধারন কিছু দেখতে। 'নবী রাসুলের চেয়েও মহৎ' মানুষটার থেকে একটু নতুন কিছু শুনতে।
শুনলাম। বইটা আর পড়ব না। রেখে দিলাম।