সেন্ট্রাল স্টেশনের টানেল দিয়ে হাঁটার সময় বিশ্ব দেখা যায়। টানেলের পাঁচ মিনিটের রাস্তা আমি দশ মিনিটে হাঁটি, বিশ্ব দেখতে দেখতে। দুই দিকের দেয়ালে নানা আঁকি বুঁকি। রাজ্যের ব্যস্ত মানুষ ত্রস্ত হয়ে ছুটছে। কেউ ট্রেইন ধরতে, কেউ ট্রেইন ছেড়ে বাস ধরতে, কেউ ক্লাস ধরতে, কেউ কাজ করতে। আমি আস্তে হাঁটতে থাকি, আর তাই সবাই আমাকে ছাড়িয়ে চলে যায়। ওদের কথার ছেঁড়া অংশ আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি শব্দ দিয়ে মানুষ চেনার চেষ্টা করি। শুনে শুনে সিডনী আর ইউটিএসের স্টুডেন্টদের আলাদা করি। 'আর বলিস না...' শুনে উৎকর্ন হই... বাঙালি। আর একটা বিশেষ ধ্বনির জন্য কান পেতে রই। টানেলে নানা কিসিমের মানুষ পয়সার ধান্ধায় বসে থাকে। কেউ পুরানো গিটার নিয়ে ক্যাট স্টিভেন্সের গান ধরে, সামনে গিটারের বাক্স বিছিয়ে। সেখানে ভাংতি পয়সার স্তুপ। কেউ আবার আরেকটু অরিজিনাল। কোন বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই মুখ দিয়ে নানা কিসিমের শব্দ করে। ওগুলা শুনা বেশ মজার। কেউ আবার ক্যাসেট ছেড়ে দিয়ে সাথে সাথে গলা মিলায়, চরম ফাঁকিবাজি। আমি শুনি। দেখি। কখনও সখনও কোন সুর আমাকে খুব ছুঁয়ে যায়। হাঁটার গতি স্লথ হয়। মানিব্যাগে হাত চলে যায়।
সেদিন মেয়েটাকে দেখলাম। প্রথমে শুনেছিলাম। টানেলের এক প্রান্ত থেকে। মেয়েটা খালি গলায় গাইছিল। বিষাদ মাখা বিষন্নতার গান। খালি গলার গানের শক্তি যেন প্রথমবারের মত উপলব্ধি করলাম। এ গলার সাথে পৃথিবীর সব বাদ্যযন্ত্র পাল্লা দিয়েও একই ঝংকার তুলতে পারবে না বাতাসে। বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে গলার অপমান হবে। ওর তীক্ষ্ম, মিষ্টি গান সরু টানেলের পিচ্ছিল টাইলসের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল। যাদুকরী কণ্ঠ যদি কখনও শুনে থাকে, তাহলে এ-ই যে সেই! এক অমোঘ টানে কাছাকাছি পৌঁছতেই আমি থমকে গেলাম। ভূমধ্যসাগরীয় জলপাই রঙের মেয়েটা, মাথায় ঢেউ খেলানো সোনালী চুল। পা পর্যন্ত লম্বা এক গাউন পড়ে আছে। দুই হাত দু পাশে ছড়িয়ে গান গাচ্ছে। পুরা ব্যাপারটায় একটা দেবী দেবী ভাব আছে। কিন্তু এক এক জন যখন পাশ দিয়ে যাচ্ছে, আর ঝনঝন শব্দে পয়সা ফেলে যাচ্ছে, তখন মেয়েটা থেমে যাচ্ছে। উৎকর্ণ হয়ে কি যেন শুনে নরম কণ্ঠে বলছে, 'থ্যাংক য়ু'। শুনছে, নিজের গান আর পয়সার শব্দ। মেয়েটা দৃষ্টি শক্তি নেই।
আমি কয়েকবার টানেলের এ পাশ থেকে ওপাশে গেলাম। শুধু অন্ধ মেয়েটার ভিতরটা ছোঁয়া, ছিন্ন ভিন্ন, ওলোট পালোট করা গানটা আরেকটু শোনার জন্য। গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে ছিল, ঢোক গিলেও সরাতে পারলাম না। কি অদ্ভূত যাদুকরী গলা! এক দিকে বাড়াবাড়ি দিয়ে ফেলেছেন বলেই কি স্রষ্টা চোখের আলো দেন নি?
আবার সেদিন, টানেলের মুখে পৌঁছতেই শুনি ভায়োলিনের সুর। বড় নাটুকে সুর। খুব দু:খ দু:খ হয়ে ধীরে শুরু হয়। তারপর হঠাৎই উদ্দাম হয়ে উঠে সে সুর, সব কিছু ভেঙে ফেলতে চায় যেন। তারপর, ধীরে লয়ে আবার হঠাৎ স্বপ্নীল হয়ে উঠে সুরের বন্যা। আমাকে ভায়োলিনের সুর খুব টানে। উৎস খুঁজতে গিয়ে সুরের অর্থ বুঝে ফেললাম যেন। সোনালী চুলের একটা মেয়ে এক মনে ভায়োলিন বাজাচ্ছে। কালো ছোট টপ আর লম্বা কালো স্কার্ট পড়ে আছে। প্রথমেই চোখ চলে যায় ছোট্ট টপের পরে ফুলে থাকা ফর্সা পেটে। মা হবে মেয়েটা। অনাগত সন্তানের জন্য সেন্ট্রাল স্টেশনের টানেলে ভায়োলিন বাজিয়ে ভাংতি পয়সার স্তুপ বানাচ্ছে। আমি নিথর হয়ে যাই। ওর উদ্দাম জীবনের গান, সংগ্রামের গল্প আর অনাগত প্রান ঘিরে স্বপ্ন-কথা শুনি কান পেতে। ছোট্ট প্রানটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে আর উষ্ণ তরলে ভায়োলিনের নরম সুরে ভাসছে। বুঝে কি সে, এ যে রক্তমাখা কান্নার সুর!