আমাদের দেশের সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে দাম বাড়িয়ে নেয়, নিরুপায় ক্রেতারা তো কিনবেই। সমাধান? হয়তো থিওরেটিক্যাল অনেক সমাধানই অনেকের জ্বিভের ডগায়, কিন্তু সবগুলো সমাধান আমাদের নিজেদের হাতেও নেই। যেগুলো আছে, সেদিক ধরে আগানোই বোধ হয় সমীচীন।
সমস্যাটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে সবার প্রথমে যেই ব্যাপারটার দিকে দ্বিতীয়বার চোখ কচলে তাকাই সেটা হচ্ছে... রমজান, যেই মাসটা 'রোযার' মাস, সারা মাস ভর উপবাসের মাস, সেই মাসে খাবারের দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে... এর মানে কি! এই মাসটায় তো আরও খাদ্যব্যবসায়ীদের ঠেকায় পড়ার কথা, ক্রেতা কম, ব্যবসায় লস অতএব দাম কমিয়ে দাও! বিক্রি করার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করো!
এই হাস্যকর বৈপরিত্যের কারন, রমজানের মূল মহত্ব থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা। ইফতারে মায়ের বেগুনীটা আমারও খুব প্রিয়, অনেকটুকু লোভ নিয়ে বসে থাকি সেটা খাওয়ার জন্য, স্বীকার করছি। কিন্তু অবস্থাটা এমন হয়ে যায় যে রোজার চেয়েও মুখ্য হয়ে যায় ইফতারের খাওয়াটুকু। ইফতার পার্টির আয়োজন। আশে পাশের ভাবিদের ইফতারের আইটেম নিয়ে প্রতিযোগিতা। দিনের বেলায় চাদরের তলের খাওয়া দাওয়া উহ্য রেখেই বলি, যদি কেউ সারা দিন রোজা রাখেও, তাহলেও আজানের সাথে সাথে 'সংযম' শব্দটাকে আদ্যপন্তে উপহাস করে খাবারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। আমাদের শরীরী অস্তিত্বের অবুঝ চাওয়া, সেই কারনাল হাংগারকে নিয়ন্ত্রনে এনে নিজেকে 'মানুষ' করার যেই উদ্দেশ্য, সেই উদ্দেশ্যকে সত্যিই উপহাস করে রোজার সময় আমাদের খাওয়া দাওয়ার কালচার।
শুধু যে ইফতারে প্লেট ভর্তি খাবারের পসরা সাজিয়ে বসা তা নয়, তার একটু পরেই তো আছে রাতের ফরজ ভাত খাওয়া, তিন তরকারী দিয়ে। সেহরীতে আবার গলা পর্যন্ত খাওয়া... দিনে খিদে লাগে যদি! সেই তো তিন বেলা খাওয়া, আত্মত্যাগটা কোন দিকে হচ্ছে আমার হিসেবে মিলে না...
অপচয়, চূড়ান্ত রকমের অপ্রয়োজনীয় অপচয়। সত্যি করে ভাবুন তো, আমাদের শরীরের জন্য সত্যিই প্রয়োজন আছে এত কিছু?
এই রমজানে একটা উপকার করুন নিজের আর জাতির। নিজেকে দিয়ে শুরু করে খাওয়ার অপচয় কমিয়ে নিন। সত্যিই যদি নিজের বাসার রান্না ঠেকাতে না পারেন, তাহলে সেটা দিয়ে দিন অন্য কাউকে। বিশ্বাস করুন, আমাদের দেশী ভাইদের এক একজনের খাবার দিয়ে দশ জনের পেটের ক্ষুধা মিটবে।
নিজের খাওয়ার অভ্যাসটুকু বদলে নিন,সুস্থতাই আসবে, অসুস্থতা নয়। শারিরীক তো আসবেই, মানসিকও আসতে পারে। ওজন কমলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে ততটুকু বলতে পারি )
খাওয়ার ব্যাপারে সুন্নতগুলো পালন করুন রোজায়, রমজানের বাড়তি বরকতে সেই সুন্নতের সওয়াবগুলোও পেয়ে যাবেন।
প্রথমেই, যারা সিগারেট খান, তারা সিগারেট পুরাপুরি বাদ দেয়ার জন্য অভ্যাস করে ফেলতে পারেন রমজানেই।
ফ্যাটি খাবার কম কম। ভাজা পোড়া মজা লাগলেও নিজের জন্য উপকারী অংশ কমই পাবেন, পুরা বাদ না দিয়েও পরিমান কমিয়ে নিন।
বুট, মুড়ি চলতে পারে।
একটা ইন্টারেস্টিং হাদীসের প্র্যাকটিস করতে পারেন রমজানে। পেটের তিন ভাগের এক ভাগ সলিড খাবারে ভরা। আরেক ভাগ পানি/তরলে আর ভাগি ভাগটুকু খালি রাখা। আমার খাওয়া দাওয়া দেখে নানু বলে 'চড়ুই পাখির আধার', জ্বালিয়ে মারে আরেকটু খাওয়ার জন্য। পাখির আধার বলার কারণ, ভাত খাই কম। হাদীসটা প্রথম শুনে অভিভূত হয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম প্রথম। তারপরে উপলব্ধি করলাম, আসলেই তিন ভাগের এক ভাগের বেশি প্রয়োজন নেই তো শরীরের। পানিটাও শান্তিমত খাওয়া যায়। বরং পেট অনেক বেশি ভরে উঠলে যেই তীব্র অস্বস্তি হয়, সেই কষ্টটা থেকে বাঁচা যায়, সুস্থ থাকা যায়। তারাবী আর ফজর পড়তে গিয়ে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে না, আলসেমী লাগে কম কম।
চেষ্টা করে দেখুন!
প্রথম প্রথম কষ্ট হতে পারে। একটা ইন্টারেস্টিং পন্থা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ইফতারের সময় হলে দু'টো খেঁজুর/আম/কাঁঠালের কোষ যা-ই হোক, মিষ্টি ফল জাতীয় কিছু দিয়ে রোজা ভেঙে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিন। তারপরে মাগরিব পড়ে আসেন। খেয়াল করবেন রোজা ভাঙার সময় যেমন মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী খেয়ে ফেলতে পারবেন চিবিয়ে, সেই খিদাটুকু উধাও। আমাদের শরীর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খাবার নিয়ে অভ্যস্ত, খাবার শুরু করে দিয়ে সময়টুকু না খেয়ে পার করে শরীরটাকেই বোকা বানানো আর কি।
আর প্রচুর পানি খাওয়া... অভুক্ত শরীরকে তাজা রাখার জন্য বিকল্প নেই।
ইফতার আর রাতের খাবার... এত কাছাকাছি সময়ে দুইটা ভিন্ন খাওয়াও অপচয় মনে হয়। একটা বাদ দিয়েই দেখুন না। শুধু পেঁয়াজু বুট মুড়ি খেয়ে নিন, অথবা শুধু রাতের ভাত। তারপরে একবারে সেহরী।
সবশেষে আবারও... কষ্ট করে রোজা রাখবেন বলেই ভাবেন, তাহলে রোজার সবটুকু ভালোই না হয় কুড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেন। সংযম সাধনা করতেই হলে সবার আগে পেটের উপর লাগাম পড়ান...
(চলবে হয়তো)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০০৭ সন্ধ্যা ৬:১৭