দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠান হলেও আইএমএফের অর্থনৈতিক নীতিই অনুসরণ করে বিশ্বব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে এ দুটি সংস্থার প্রধান কার্যালয় রাস্তার এপার-ওপার। দুই সংস্থার বোর্ড একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা কী হবে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ওয়ান-সাইজ-ফিটস-অল- একই জামা সবার গায়ে চড়ানো। এটিই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) নীতি। ঋণগ্রহীতা দেশটি ইউরোপের ধনী (এককালের!) দেশ হোক, দক্ষিণ আমেরিকার সন্ধিক্ষণের উন্নয়নশীল কোনো অর্থনীতি হোক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান বাঘ হোক অথবা বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশ হোক, আইএমএফের নীতি একই। আর সেটা হলো, সংশ্লিষ্ট দেশটির অর্থনীতিকে সংকুচিত করা বা এর গতি কমানো। মূল্যস্ফীতির জুজু সংস্থাটির প্রধান অস্ত্র। এটি কমানোর কথা বলে সংস্থাটি এমন এমন শর্ত চাপিয়ে দেয়, যা মানতে গিয়ে জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ, জনপ্রিয়তা হারায় ক্ষমতাসীন সরকার।
আর্জেন্টিনায় ছয় সপ্তাহে পাঁচ রাষ্ট্রপতি বিদায় নিয়েছিলো। সম্প্রতি ইতালিতে সরকার বদলে গেছে, কৃচ্ছসাধনের আইন পাস করে তীব্র জনরোষের মুখে রয়েছে গ্রিস সরকার।
আরো জানা যায়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আইএমএফের যেটুকু ঋণ পাওয়া যায় তা চলে যায় বিদেশি দায় মেটাতেই। যা থাকে তা হলো নতুন ঋণ, যা পুরনো ঋণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে 'বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো' অর্থনীতিতে চেপে থাকে। বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে যেখানে সরকারি ব্যয় এমনিতেই কম, যেখানে কর্মসংস্থান ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য অবকাঠামো নির্মাণে দরকার সরকারি-বেসরকারি বিপুল বিনিয়োগ, সেখানে আইএমএফের ক্রমাগত চাপ থাকে ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা, যা অর্থনীতির গতিও কমিয়ে দেয়।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, আইএমএফের মূল কাজ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ধনী দেশগুলোর ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান করা। সত্তর দশক নাগাদ সে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল ইউরোপের। তখন আইএমএফ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কর্মকা- বিস্তৃত করল। মূল উদ্দেশ্য বিওপি সমস্যা সমাধানের নামে দেশগুলোতে সরকারি কর্মকা- সংকুচিত করা, তাদের অভ্যন্তরীণ শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ করে বিদেশি বহুজাতিক কম্পানির বাজার সম্প্রসারিত করা।
২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আইএমএফের নতুন ঋণ প্রকল্প ছাড়াই চলেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি। তখন মূল্যস্ফীতি, বাজেট ঘাটতিও কম ছিল, জিডিপি প্রবৃদ্ধিও অব্যাহত ছিল। ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে পোভার্টি রিডাকশন অ্যান্ড গ্রোথ ফ্যাসিলিটি (পিআরজিএফ) কর্মসূচির আওতায় ৬২ কোটি ডলার ঋণের প্রতিশ্রুতি দেয় আইএমএফ। এর শর্ত হিসেবে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ১২৫টি শাখা কমানো, রূপালী ব্যাংক বিক্রি করা, সোনালী, জনতা, অগ্রণীকে কম্পানি করে ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়ার পথ তৈরি করার মতো কাজগুলো করিয়ে নেয়। এরপরও ৪৯ কোটি ডলারের বেশি হাতে পায়নি বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে এসেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে কতটুকু স্বাধীন হতে পেরেছে- এমন একটি প্রশ্ন হুট করে কেউ করে ফেললে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এটাই যে এই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, তা অস্বীকার করারও উপায় নেই। একাত্তরে আমরা রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আজও আসেনি।
আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংককে যতই আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বলা হোক না কেন, আসলে দুটি সংস্থাই নিজেদের তহবিল বৃদ্ধির ব্যবসা করে। এই ব্যবসা করতে গিয়ে দরিদ্রতর দেশগুলোকে উন্নয়নের ফাঁদে ফেলা হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের এই ফাঁদ পাতা আছে। তাদের 'ইকোনমিক হিটম্যান' ছড়ানো আছে বিশ্বজুড়ে। যেকোনো দেশে কেমন করে ঋণ দেয়া হবে বা সেই দেশকে কেমন করে ঋণের ফাঁদে ফেলা হবে, তার ছক আগে থেকেই তৈরি করা থাকে। দেশভেদে ছক বদলে দেওয়া হয়। এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্বব্যাংকেরই সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী জোসেফ ই স্টিগলিজের উদ্ধৃতি। সে বলেছে, আইএমএফের অর্থনীতিবিদদের সব কিছুই গোপন। তারা চায় না বহিরাগতরা তাদের কাজ নিয়ে কিছু বলুক। বাইরে তারা খোলামেলা নীতির কথা বললেও নিজেরা দরকষাকষি করে গোপনে। কোনো একটি দেশে গিয়ে পাঁচতারা হোটেলে থেকে কয়েক দিন বা সপ্তাহের মধ্যেই সে দেশের জন্য তারা একটি কর্মসূচি তৈরি করে ফেলে, যা ওই দেশের মৌলিক চাহিদা বা আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোনো দেশভিত্তিক আইএমএফ টিম আগে থেকেই কর্মসূচির খসড়া তৈরি করে রেখেছে কিংবা এক দেশের প্রোগ্রাম হুবহু অন্য দেশের জন্য চালিয়ে দিয়েছে- এমন নজিরও আছে।
বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের ঋণের জালে জড়িয়ে দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার উদাহরণ যেমন আছে, তেমনি এ দুই সংস্থার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার উদাহরণও আছে।
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের নানা বাহানার পর এ দুই সংস্থার কার্যক্রম দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। বাংলাদেশের এখন কী করা উচিত? অনেকে মনে করে, বাংলাদেশকে এখন থেকেই ধীরে ধীরে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। তবে অর্থনৈতিক মুক্তির নতুন পথে চলতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন রাজনৈতিক সততা। সেখানে বাংলাদেশ নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারলেই অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব। বিশ্বের অন্যান্য দেশ পারলে, বাংলাদেশও পারবে।