ডিসক্লেইমার।। ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ এর কথা। লাইব্রেরী হতে একটা বই নিয়ে এলাম ইতালীর শিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আঁকা ছবি মোনালিসা সম্পর্কে বিভিন্ন মিথের আলোচনা করে চমৎকার মুখরোচক এক বই। পড়তে পড়তে অবেলায় ঘুমিয়ে পড়লাম বই টি বুকে করেই।ঘুমিয়ে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলাম। মোনালিসা ছবি নিয়েই। বইয়ে পড়া মিথ গুলো জট পাকিয়ে আমার স্বপ্নে যা দাঁড়াল তাকে কবিতায় ধরে রাখাই এ ডুয়েট কবিতাটি। ঘুম ভেঙেই সারা সন্ধ্যে ভরে লেখাটি দাঁড়িয়ে গেল একবারেই।
এত বড় লেখা তারপর কবিতা, দেখলে আমারি গা জ্বালা করত। তাই এই সব বিতং করে বলা।
একটু খানি পটভুমি: মোনালিসা ছবিটি আঁকা শেষ। তার মডেল লা জোকেন্দে (মতান্তরে এক ধনী ব্যবসায়ীর বউ) কে শিল্পী পূর্ণাঙ্গ ছবিটি দেখাচ্ছেন। আমার স্বপ্নে এই নারিটি শিল্পীর প্রেমিকা হয়ে এসেছে। ছবিটি দেখানোর সেই সন্ধ্যাটি হঠাৎ পাল্টে যায় নাটকীয়তায়। শত শত মিথের ভীড়ে এ থাকল না হয় আমার একলার মিথ হয়ে। ভালো কথা, কবিতায় ব্যবহৃত সব কথাই কিন্তু একেবারে বানানো নয়, সবিনয়ে এটাও জানিয়ে রাখি। শিরোনামে বোধহয় স্বপ্নে পাওয়া বিজ্ঞাপন দেয়া উচিত ছিল ।
চরিত্র:
লিও ।। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি ( শিল্পী )
মো/লিসা ।। মোনালিসা / লা জোকোন্দে (মোনালিসা ছবির মডেল)
লিও ।। এবার দিনাবশান,
দিন গেছে চলি; কত দিন।
আজ হলো শেষ। যে ধৈর্যে
অদম্য কৌতূহলে তুমি স্থির চিত্রের রেখায়,
এখানে এই পপলার পাটাতনে
ফুটে উঠছিলে, আজ শেষ হলো তার আয়োজন।
মাদমোয়াজেল লা জোকোন্দে আজ মোনালিসা হলো।
মো ।। আয়োজন শেষ যদি তবে
মোনালিসা মুক্তি পেয়ে আজ লা জোকোন্দে হবে।
টেনেছো কি শেষ আঁচড় এখুনি?
লিও ।। দেখ এই, এই যে এখানে
না না অত আলোতে নয়,
এই যে আবছায়ায়; সলাজ আলোতে
অবগুন্ঠনটি তুলে নাও নিজ হাতে,
ওখানে তোমার রাজ্য-পাট।
মো ।। কে ও? এ ছোট্ট কাঠের বুকে
জল রঙে এ কার ছবি? এ কি
আমি? লা জোকোন্দে স্বয়ং?
লিও ।। সরো এসো খানিক তফাৎ।
এই যে, এই দূরত্বে তাকাও স্থির দৃষ্টিতে।
এটা তুমি, তুমি নও?
মো ।। ও চুল, সজ্জিত আঙরাখায় উদভাসিত
ও সুষমা, সোনা রঙ কপালে
স্বচ্ছ অবগুণ্ঠনে ও চোখ,
আমি এটা?
লিও ।। এটা তুমি,
যখন তুমি মোনালিসা।
যখন তুমি লিওনার্দোর অলৌকিক ইচ্ছা হয়ে আস
রেনেসাঁসের উদ্বেলিত আকাংখায়।
স্রষ্টা দিয়েছে অমন কান্তি তোমাকে
আমি দিয়েছি অমরত্ব।
মো ।। তোমার তুলি বুঝি গয়না আঁকেনা,
এমন নিরাভরণ?
লিও ।। আমার তুলি গয়না চিনতে ভোলেনা।
কেন বকছ অমন, লিসা,
চেয়ে দেখো দেখি তোমার হাসিতে।
প্রতিজ্ঞা নস্যাত করা ও হাসিতে
দেখতে পাচ্ছো উদভিন্ন রেনেঁসাস ?
মো ।। ও যে স্বপ্নাচারের প্রত্যাবর্তন, লিও,
ও কোন মুখের হাসি?
লিও।। ও হাসি মুখের নয়,
ও হাসি তোমার অবয়বের।
ও হাসি দিনান্তের, দিনারম্ভের
ঋতু চক্রের অস্থির মতি দুষ্টুমি,
সার সার ম্যাপলের কোলাহল
ছায়া এঁকে গেছে দু’ঠোঁটের ভাঁজে।
মো।। পেছনে খিলান কই?
দূর্গের প্রাসাদ, স্বর্ণালোকিত রাজ-চূড়া?
আঁকনি কেন এথেন্সের রাজ-তোরণ
কলোনোসিয়ামের ফাঁকে ফাঁকে
ঝলমলে দেবদারু কই?
লিও।। তবে যে তুমি সম্রাজ্ঞী হতে-
মো।। আমি সম্রাজ্ঞী হবো।
লিও।। তুমি সম্রাজ্ঞী হয়েছো, লিসা
এবার মোনালিসা হও।
সম্রাটের মন্ত্রণা কক্ষে,
আভরণ-বহুল গার্হস্থ্য সজ্জায়
তুমি ছড়িয়ে দেবে লেডার দূতি;
সে তোমার নিয়তি।
মো।। এখানে তবে নদী; পাথুরে ভূ-খন্ড জল আর প্রপাতের সংগম।
লিও।। এইখানে, তোমার ডানে- নদী।
তীর ধরে বিবর্ণ উপকূলে নিস্ফলা ভূমি
জনশুণ্য, দূরে এই যে উপত্যকা গুচ্ছ
দেখতে পাচ্ছ? এই যে হ্রদ
মো।। এ ভূ-খন্ড নিম্তরংগ, নিশ্চল
কেন অমন স্থির হয়ে আছে ওগুলো?
লিও।। ও গুলো স্থির হয়ে আছে
কেননা, মোনালিসা’র ভঙ্কিম গ্রীবা
তাকিয়ে আছে অন্য ভূ-গোলে।
কেন লিসা, এত অহংকারী তুমি?
মো।। সে কি লিও? এঁকেছো তো তুমি
অহংকার মূর্ত যদি তবে
সে তোমারই তুলির ছোঁয়ায়।
লিও।। ভূল, তোমার ত্বক ভেদ করে
এ অহংকার তুলি ছুঁয়েছে।
মো।। কিন্ত তুমিই’তো এর স্রষ্টা ।
লিও।। না, আমি স্রষ্টা নই এর
আমি এর উপাসক।
আমি উপাসনা করতে শুরু করেছিলাম
যখন আমার গুরু মহামান্য ভেরেআক্কিও
তুলির নিপুন ছোঁয়ায় অগনন অবয়বে
ফুটিয়ে তুলছিলেন সূক্ষ স্মিত হাসির প্রতিভাস;
আন্তোনেল্লো যখন ঐন্দ্রজালিক তেল রঙে
অবয়ব ভরে দিচ্ছিলেন রূপের জেল্লা,
সেই তখন থেকে
আমাকে মাতাচ্ছে যখন রঙ আর রেখা
দূর শৈশবে যারা আমাকে উদভ্রান্ত পেয়ে
দু’চোখে দৃষ্টি দিয়েছে রূপের-
আমি রূপের উপাসক,
তুমি তার দেবী।
মো।। আমি দেবী নই,
আমি লা জোকোন্দে, দেখো
চেয়ে দেখো, তোমার মোনালিসা সে কি আমি?
মামুলি নারী আমি এক।
রূপের ঐশ্বর্য? সে তোমার
তুলির ইন্দ্রজাল।
লিও।। মামুলি নারী- সেই তোমার ঐশ্বর্য।
অসাধারণের কাছে কে দাবী করে
নৈকট্যের। চন্দ্রই মোহময়ী
যদিও সূর্য পেয়েছে দেদীপ্য কান্তি।
থাক এসব বাল্যখিলতা।
এসো লিসা,
মোনালিসা কে দেখো।
মো।। ডান দিকে, এই যে ছোট্ট সেতু
তাতে গুঞ্জন দাওনি কেন জলের।
লিও।। ওখানে স্থিরতার গুঞ্জন,
কান পাতো,
শুনতে পাবে বিহ্বল স্থৈর্যের সংগীত।
দেখেছো ঐ আকাশ।
মো।। আকাশে ছুঁয়ে গেছে
মোনালিসার ঔদ্বত্ব্।
লিও। আকাশ এসেছে নেমে
মোনালিসার ঔদ্বত্বে।
দেখেছো ঐ আলোর প্রতিভাস,
ওখানে উঠবেনা সূর্য আর কোনদিন।
সব টুকু আলো হুমড়ি খেয়ে
পড়ে রবে তোমার সৌন্দর্যে, পোশাকের
ভাজেঁ গরবিনী আঙুলের বিস্তৃত নকশায়।
মো।। ভয় করে লিও, বড্ড ভয়।
লিও।। ভয়? কিসের ভয়।
মো।। আমার যাতনা কই?
এ যে উদভিন্ন হাসি ইন্দ্রজাল।
বিষন্ন একদিনে, একদিন বৃষ্টির
সন্ধ্যায়; হঠাৎ বেভুল বাতাসে
দেবদারুর পত্র পল্লব ছুঁয়ে ছুঁয়ে
যে দিন দিগন্তের ওপার হতে
ভেসে আসবে গত জন্মের ব্যথা
ছোট্ট স্মৃতি সব এসে বিষন্ন
করে দিবে অবয়ব, তখনো ঠোঁটের বিন্যাসে
লেগে রবে ও হাসি?
লিও।। তাকাও দেখি ও হাসিতে আবার,
চেয়ে দেখো গভীর নয়ানে।
দেখতে পাচ্ছ গত জন্মের স্মৃতি কাতরতা
লেপ্টে আছে দু’ঠোঁটের ভাঁজে।
দেখছো বদলে যাচ্ছে দৃষ্টির কোলাহল?
ওখানে এখুনি বেদনা ঘনাবে।
জল ভারে নত হবে বংকিল ভ্রু-কুটি।
দেখতে পাচ্ছো, লিসা?
মো ।। কি অদ্ভুত, কি অদ্ভুত !
একি ইন্দ্রজাল!
এই যে আনন্দ-বিষাদের তরংগ
ক্ষণে ক্ষণে ঝলসে উঠছে গভীর বিপন্ন আরশীতে
তাতে ঠাঁই কই লা জোকেন্দের?
লিও।। ঠাঁই নেই, মোটে ঠাঁই নেই
লা জোকেন্দের তরী এ তীরে ভীড়বেনা,
এটা মোনালিসা।
যে মুহুর্তে তুলির শেষ আঁচড় টুকু অবয়বে নিয়েছে সে পরে
লা জোকেন্দকে সেই মুহুর্তে করেছে অস্বীকার।
মো ।। কে এ মোনালিসা তবে?
লিও।। সে প্রাচীন মামুলী নারী এক
লা জোকেন্দের প্রতিভাস শুধু।
তারপর সে আমি।
সে আমার উপাসনার রূপাবয়ব।
সে আমার হৃদকনা একটি একটি করে শুষে নিয়ে
আমার বেদনা আর বিহ্বলতা ছেনে নিয়ে
ফোঁটা ফোঁটা সুষমা ভরে নিয়েছে নিজ অবয়বে।
সে আমার মোনালিসা,
আমি তাকে ভালোবাসি।
মো ।। তবে কি পরিচয় লা জোকেন্দের?
লিও।। পপলারের এই রুক্ষ-ছোট্ট বুকে
যতক্ষণ খেলা চলছিলো ড্রয়িং আর লিওনার্দোর মনের মিতালীতে
তখন ছিলো সে মোনালিসার প্রতিভাস,
যতক্ষণ ফুটছিলো রেখা, রেখার পর রেখা
বক্র ঋজু জ্যামিতিক বহুমাত্রিক আচঁড়
প্রস্ফুটিত হচ্ছিল যখন তুলির বুক হতে,
লা জোকেন্দে তখন দূর কল্পনার অতীত,
কে তখন লা জোকেন্দের কে জানে?
তেলের আদুরে কণায় সে মিশতে মিশতে
কোন সভ্যতার অন্ধকার ছুঁড়ে দিয়েছে লা জোকোন্দ ‘কে
এখানে তার স্থান কই?
মো।। লিও, কে আমি তবে?
এই যে, তাকাও এদিকে,
দেখো এই গ্রীবা, তুমি তাকেই প্রস্ফুটিত করেছো কাষ্ঠখন্ডে,
তেল রংয়ে তুলি ছুঁইয়ে
এই কপাল, এই উপল স্তনের আভাস
প্রাচূর্য এনেছে তোমার ক্যানভাসে।
দেখো এই চোখ,
এই যে শতাব্দী অভীজ্ঞতা পুষ্ট ক্লান্তি
সে তো আমার চোখ;
আমিইতো এই যে আঙুলের প্রাচূযের ভঙ্গিমায়
তোমার ক্যানভাসে দিয়েছি আধ্যাত্নিকতার অভয় বাণী।
কেন অস্বীকার করছ আমায় ?
ও মোনালিসা কেউ নয়,
আমি তোমাকে ভালোবাসি।
ও কি লিও, তুমি কাপঁছো?
অমন থর থর করে কাঁপছো?
লিও।। তুমি দেখতো পাচ্ছো না,লা জোকেন্দের?
দেখতে পাচ্ছো না ওখানে নগরের কোলাহলে,
ঐ জনপদের আড়ালে
শতাব্দীর পর শতাব্দীর অলীন্দে
মোনালিসা ছুটছে, হাঁপাচ্ছে,
কিশোরী বালিকার মতো উচ্ছলতা বাজাতে বাজাতে
খিল খিল ছন্দে মাতিয়ে যাচ্ছে শতাব্দীর বাঁক,
দেখতে পাচ্ছো-
ও গভীর আয়ত কপালে,
মুখ ভাবের ঐ প্রশস্ত স্পেসে
ভরে উঠছে লক্ষ যুগের পরিক্রমা,
জোকেন্দে, লা জোকেন্দে
ও কি ক্যানভাসে থাকবে?
থাকবে ঐ ছোট্ট ক্যানভাসে?
মো।। শান্ত হও
শান্ত হও লিও।
তুমি স্রষ্টা এর- ক্যানভাস’ই ওর নিয়তি।
তাকাও আমার দিকে।
ও কেউ নয়- ও আমারি প্রতিরূপ শুধু।
আমাকে লিসা বলে ডাকো,
বলো মোনালিসা, বলো ভালোবাসি।
লিও।। লা জোকেন্দে,
সরে এসো ঐ ক্যানভাস হতে।
ওখানে কিছু নেই তোমার-
ওখানে মোনালিসার রাজ্যপাট-
ওখানে লিওনার্দোর ঘর বসতি, স্বপ্ন উন্মত্ততা।
এখানে, এই যে এখানে দেখো দেখি
এই যে রেখা গুলি,
আমিই কি আঁকিনি অজন্তার ছবি?
দিনান্তের কোলাহল পর
ভাঁড় ভাঁড় সুরা-উন্মত্ত বাইসনের জিঘাংসায় বিদ্ধ হতে হতে
কে ছিলো আমার তুলি-
সে যে মোনালিসা!
মোনালিসা, মোনালিসা।
এই এত দিন পর সে যে এল
কেন তবে ভিড় আর,
লা জোকেন্দ সরে এসো,
ওখানে কোন অধিকার নেই তোমার।
মো।। কে বসেছিলো স্থানুর মতো
দিনের পর দিন, বল লিও?
কে ছিলো পটভূমি?
ক্যানভাসে তোমার আঙুল খেলছিলো যখন
কে ছিলো স্থির প্রস্তরের মতো একাগ্র?
তুলির দক্ষতা পেতে
কে দিয়েছে রূপের অবয়ব?
আমাকে তুমি অস্বীকার করছ?
লিও।। অবুঝ নারী!
দেখছো লা জোকেন্দ কেউ নয়।
ওখানে সহস্র বছরের ঝাঁক ঝাঁক স্তুতি
ওখানে বিম্বিত অযুত নিযুত নিস্ফল কামনা,
ও নারী প্যাগানের প্রত্যাবর্তন এনেছে তুলে
অপসৃয়মান ভ্রুতে দেখতে পাচ্ছো না
রোমের যৌবন্মাদ-
শুনতে পাচ্ছ সহস্র নাইটের ক্রোধোন্মত্ত পদাঘাত।
শতাব্দীর হ্রেষা ধ্বনি তার পায়ে গড়াগড়ি খাবে-
কোথায় লা জোকেন্দ তখন-
কোথায় লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি?
মো।। লিও, এযে অবিমিষা।
লিও।। এ অবিমিষা নয়, এ রূপ সৃষ্টি।
আমার এ পাজঁর গুলো
পাজঁর নেই আর-
দেখো চোখ নেই আর-
নেই পেশী, স্নায়ু, নিউরনের আলোড়ন।
নেই কেউ নেই ক্যানভাসের বাইরে।
না তুমি, না আমি-
কে ছিলো লা জোকেন্দে,
কেউ কি ছিলো?
কে ছিলো লিওনার্দো
কেউ কি ছিলো?
শব্দ বলোনা আর,
দোহাই শব্দ বলো না লা জোকেন্দে আর ।
যাও দূর।
দূর যাও নারী,
কে ছিলো লিওনার্দো তোমার?
ও অযুত রং কনা ফুটিয়েছে যাকে
সে আজন্ম উপাসনা আমার,
মোনালিসা, সে আমি।
ওখানে আমার বেদনা, আমার হাসি
ওখানে শিল্পী লিওনার্দোর বিমূত আর্তনাদ,
ওখানে মানুষ লিওনার্দোর সোল্লাস অহংকার।
কে রাখে খোঁজ এই বিকেলের?
এই রূদ্ধ দ্বার বিলাপের কে স্বাক্ষী?
এখানে সত্য এই ক্যানভাস শুধু
সত্য এই পপলারের বুকের ঐন্দ্রজাল।
ঐ হাসি, ঐ আয়ত নয়ন,
সমৃদ্ধ অবয়ব, এ মোনালিসা
এ আমার প্রতিহিংসা,
বুক ছুঁয়ে ছুঁয়ে কণা কণা শোণিত পান করে
ও পূর্ণবার- বার বার জন্ম-মৃত্যূ পাবে
ভ্যাম্পায়ারের মত, ও জাগবে
জাগাবে বিশ্বামিত্র সভা।
তুমি লা জোকেন্দে দূর যাও
মামুলী নারী তুমি, কে রাখে তোমার খোঁজ?
মো।। তবে তাই হোক,
এই দূর যাই, এবেলা তোমার মোনালিসা হতে,
যাকে দিয়েছো ঢেকে ক্যানভাসের আড়ালে
তার পাবেনা খোঁজ কেউ আর-
তবে একদিন ব্যথায় তুমি লীন হবে
যখন শতাব্দী একে চিত্রের চেয়ে
আইকন ভেবে কাছে নেবে,
জানবেনা এর ড্রয়িং,
কোন নোট, ভাবনার আর কোন শব্দ বর্ণনা
পাবেনা তুলির আঁচড় সন্ধান,
জানবেনা কোন্ নদী কো্ন সাঁকো
উঁকি দিয়ে গেলো, কোন্ পাথুরে উপত্যকা পেছনে
কেউ পাবেনা সন্ধান।
যে প্রস্তরের পরে বসে
কত সাঁঝ, সকাল, মধ্যাহ্ন অপরাহ্নের
ধৈর্যে দিয়েছি প্রেরণা,
আঁজলা ভরে পান করে করে
ক্যানভাসের পলেস্তারায় অবয়ব যার গেঁথে দিয়ে
লা জোকেন্দে কে ছুঁড়ে দিচ্ছ অবজ্ঞায়,
সে এখুনি হারাবে-
এই ভর সন্ধ্যাটি নিয়ে
এই সংলাপ, বদ্ধ ষ্টুডিওর এই প্রহসন,
সব ষ্টাডি, নোট, ড্রয়িংয়ের অস্থির ঐতিহ্য,
ও প্রেক্ষাপট, আলোর প্রক্ষেপন,
সব -সব নিয়ে, লিও
এই গেল জিওকোন্দা ক্যানভাসের আড়ালে,
মোনালিসা যতনা চিত্র হবে,
তারো’চে বিহ্বল আইকন,
শিল্পী তুমি, পারবে সইতে
শিল্পের চেয়ে আইকনের দৌরাত্ব?
লিও।। অভিশাপে টলে কি স্রষ্টা?
আইকন যদি হবে
তবে এ ক্যানভাস কেউ দেখবেনা।
লিওনার্দোর বুকের এ গহ্বরে পুরে
লিওনার্দোর সাথেই সে সমাহিত হবে।
মো।। তোমার তুলির আচঁড় সৃষ্টি করে যে কৌতূহলের
যে রূপ-তৃষা সূষ্টি করে তোমার ক্যানভাস
অজস্র রূপরসিকের অনুসন্ধানী দৃষ্টি
নিত্য খুঁজে ফেরে তোমার অনুপ্রেরণা, ক্যানভাসের কঠিন বুক চিরে
খুঁজে ফেরে ভাবনা রেখা আলোড়নের প্রেক্ষাপট।
কাল ভোরে
দ্বারে ভিড় যাবে বেড়ে-
তুমি রূপ-জীবি,
ভার্সাইয়ের নাগরিক দল তোমার
মোনালিসা’কে দেখতে চাইবে-
লিও।। এই যে পাশের ক্যানভাসে
এই রাত্রির নির্জনে-
বদ্ধ ষ্টুডিওর নির্জনয়তায়-
আমি মোনালিসা’কে বুকে পুরে নিয়ে
এঁকে দিব অন্য ক্যানভাস এক,
কেউ জানবে না।
মো।। সে ও পাবে এই অভিশাপ।
লা জিওকোন্দার অভিশাপ।
প্রেম প্রত্যাখ্যাত এক নারীর অভিশাপ,
তাকেও করবে আইকন।
লিও।। সে কথা কে ভাবে?
ও তো মোনালিসা নয়, সে প্রতিরূপ কেবলি,
এ মোনালিসা বাণিজ্যে যাবেনা।
এই বেলা, মোনালিসা
আহা মোনালিসা, আমাকে আরেকবার
দেখতে দাও তোমার সুষমা,
শুনতে পাচ্ছ বাইরে কোলাহল?
কে নেবে তোমাকে কেড়ে, বাণিজ্যের হাটে
কে করবে তোমাকে নিক্তিতে ওজন;
সে কি সহা যায়? লিওনার্দো সে পারবেনা সইতে।
দেবী, সম্রাজ্ঞী,
আমার উপাসনা তবে পূর্ণ হোক তোমার বিনাশে।
মো।। ও কি লিও,
ও কি করছো,
জ্বালিয়ে দিচ্ছ তোমার সৃষ্টি?
লিও।। না, না, ভয় নেই, জিওকোন্দা,
মোনালিসা আমারি হল তবে।
এই যে শোণিত, বেয়ে আসছে আমার স্নায়ু বেয়ে
পেছনে তার অন্তরাত্বা,
তার ভাঁজে শিরায় উপশিরায় অলিন্দে নিলয়ে
আমার মুহুর্মুহু বেঁচে থাকার স্বপ্ন কল্পনায়
মোনালিসা পেল কীর্তিনাশহীন অক্ষয় ক্যানভাস।
রূপের হাটে বাণিজ্যে সে থাকবে ছায়া অবয়বে।
এই যে ছাই দ্রুত গিলে নিচ্ছে মোনালিসার রেখা-উপরেখা
শত মুহুর্তের কল্পনা স্থির-অস্থির-দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস
এখুনি সব ছাই নেবে কেড়ে,
এখুনি পল পল সময়ের লয়ে
মোনালিসার এ ক্যানভাস বিলীন হবে অগনন অতীতে
কালযাত্রার এ মুহুর্ত এ ক্ষন এ দৃশ্যায়ন বুকে করে
নিদাগ স্রোতের মতো মিশে যাবে নিরুদ্দিষ্ট অনন্ত গর্ভে
কেউ পাবেনা মোনালিসার খোঁজ।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
ছবি সংগ্রহ। গুগল
অ.ট: মোনালিসা সম্পর্কে মিথ গুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে শুধু গুগুল করলেই হাজার হাজার পেইজের ঠিকানা এসে যাবে।যেমনা:http://www.monalisamania.com/