#জামাল সাহেবের কথাঃ
সকাল এগারোটা। জামাল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন এক সরকারি ব্যাংকের ক্যাশ এর সামনের লাইনে। তার হাতে একাউন্ট পেয়িই চেক। সেখানে অ্যামাউন্ট লেখা আছে পঞ্চাশ হাজার টাকা মাত্র। এরা মাত্র লিখে কেন কে জানে? বাংলাদেশের সাধারণ একজন মানুষের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা কোন ক্রমেই মাত্র হতে পারে না।
জামাল সাহেবের বয়স হয়েছে। পরিশ্রম তাকে পোষায় না। কিন্তু চেকের ধরনের কারনে তাকে আসতে হয়েছে। তিনি ছাড়া আর কেউই এই চেক ভাঙ্গাতে পারবে না। এই পঞ্চাশ হাজার টাকা তার না। বন্ধু ইমরুল সাহেব তাকে ধার হিসেবে দিয়েছে। ধারের বিশেষ প্রয়োজন তার এই মুহূর্তে আছে। কারণ জামাল সাহেব তার মেয়ের বিয়ে হালকা আড়ম্বর করে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু তার কাছে টাকা আছে কাটায় কাটায়। তাই ক্লাব ভাড়ার পঞ্চাশ হাজার টাকা তাকে ধার নিতে হচ্ছে।
জামাল সাহেব যে লাইনে দাঁড়িয়েছেন তার দৈর্ঘ্য কমছেই। ধীরে ধীরে তিনি একেবারে কাছে চলে এলেন। এখন তার আর ক্যাশিয়ারের মধ্যে একটা মাত্র কাঁচের দেয়াল। চেক এগিয়ে দিলেন তিনি। প্রাথমিক কথাবার্তা আর ফরমাল কাজ শেষে তাকে পাঁচশ টাকার বান্ডেল এগিয়ে দিল ক্যাশিয়ার। টাকা নিতে নিতে ভল্টের দিকে চোখ পড়ল তার। আহা! এখানের কিছু টাকা তার ছিল। বিয়েতে চার লক্ষ টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে।
‘ভাই, একটু সরবেন?’- পেছনে লোকটার কোথায় সরে দাঁড়ালেন। একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন। খামে ভরা বান্ডেলটা পকেটে চালান করে দিয়ে হাঁটা ধরলেন তিনি। অনেক কাজ বাকী। প্রথমেই ক্লাবে টাকাটা এডভান্স করতে হবে। ব্যাটারা খালি নগদ খুঁজে!
রাস্তায় নেমে প্রচন্ড রোদে মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল জামাল সাহেবের। অস্বস্তি দূর করার জন্য পকেট থেকে বেনসন বের করলেন। আগে গোল্ডলিফ খেতেন, ডাক্তারের চেম্বার থেকে ধমক খেয়ে এসে এখন বেনসন ধরেছেন। এটা তুলনামূলক মাইল্ড। পকেট হাতড়ে দেখলেন লাইটার নেই। অগ্যতা রাস্তার ওপাশের দোকানের দিকে চললেন।
ভাই, দেশলাই হবে?
দোকানদার কিছু না বলে লাইটার বাড়িয়ে দিল। বাতাস হচ্ছে, কায়দা করে সিগারেট ধরিয়ে লাইটার ব্যাক করলেন তিনি। ফেরত নিতে হাত বাড়িয়ে চোখ তুলল দোকানী। জামাল সাহেব দেখলেন চোখ জোড়া যেন বিস্ফারিত হল। সাথে সাথেই চিৎকার উঠলঃ চোর! চোর!
হতভম্ব হয়ে জামাল সাহেব পকেটের দিকে তাকাতেই দেখলেন, বের হয়ে থাকা খাম হাতে নিয়ে দৌড় দিয়েছে এক যুবক। ধ্বক করে উঠল জামাল সাহেবের বুক। তার ধার করা পঞ্চাশ হাজার টাকা। তার মেয়ের বিয়ে। ধাতস্থ হওয়ার আগে তিনিও ছুটলেন। ততক্ষণে দোকানদার আর কয়েকজন দৌড়ে অনেকটুকু চলে গিয়েছে। চোর চোর সাড়া পরে গেল। এক মিনিটও লাগল না, চোর ধরা পড়ে গেল।
এত দ্রুত ঝড় আসে না, এত দ্রুত মাথা থেতলানো পুলিশকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে না কেউ; যত দ্রুত পিলপিল করে হাজির হল প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ। এদের প্রত্যেকের হাত-পা ছুটছে অবিরাম। উৎসুক জনতার সংখ্যা শ খানেকের বেশী। এদের অনেকেই গণধোলাই এর নাম শুনেছে। আজ চোখে দেখছে প্রথমবার।
হ্যাঁ, গণধোলাই । বৃষ্টির বেগে ঝড়ছে ঘুষি, লাথি, চড়! কেউ আশপাশ থেকে তুলে নিয়েছে লাঠি। সেগুলোও চলছে। সবার লক্ষ্য একজন। সেই চোর।
কিন্তু শিকারীর চেয়ে শিকার জোরে ছুটতে চায়। তাই এই মানব বলয় ভেঙ্গে কিভাবে বেরিয়ে গেল সেই চোর।
তার গায়ে জামা নেই, এক চোখ প্রায় থেতলানো। নাকের হাড় স্পষ্ট বেঁকে গেছে। কারো টানে উঠে গেছে কয়েক গুচ্ছ চুল। শরীরে ছোপ ছোপ দাগ। হার কয়টা ভেঙ্গেছে অজানা।
এই অবস্থা নিয়ে চোর দৌড়ে ঢুকে গেল বড়সড় এক দোকানে। সচেতন জনতা পিছু নিল। অশ্রাব্য গালিগালাজ চলছেই। দোকানের সৌম্য চেহারার বৃদ্ধ সর্দার এগিয়ে আসলেন। বললেন, ভাই হইসে। আর মাইরেন না। মাইর খাইসে ঠিক হয়ে যাইব। আর না মারেন।
এই মুহূর্তে এগিয়ে গেলেন জামাল সাহেব। কান্না বিজড়িত কন্ঠে জানালেন তার কতবড় সর্বনাশ করতে চেয়েছিল এই চোর।
জনতা আহারে জাতীয় শব্দ করল। যেখানে দল সেখানেই দলপতি। এখানেও মারমুখী এক লোক এগিয়ে আসল। বলল, মুরুব্বি, বাধা দিয়েন না। এ আর কারো সর্বনাশ করবে। তারপর পাবলিককে বললেন, এই ইতেরে মারি ফেলা।
ছেঁচড়ে নিয়ে আসা হল চোর কে। পাবলিক শাস্তি দিতে আবার হামলে পড়ল। চোরটা কিছু বলতে চেষ্টা করল, পাবলিক গা করল না।
দূরে দাঁড়িয়ে জামাল সাহেব দেখলেন, নিস্তেজ হয়ে আসা ছেলেটি জ্ঞান হারাচ্ছে। হঠাত করেই নিজের উপর ঘৃণা জন্মাল জামাল সাহেবের, ছেলেটার এ ক্ষতি না করলেও পারতেন।
আকিবের কথাঃ
সকাল এগারোটা। আকিব দাঁড়িয়ে আছে এক সরকারি ব্যাংকের ভেতর। তার হাতে কোন চেক নেই।
আকিব ব্যাংকে এসেছে অন্য কাজে। সে পরিবারের একমাত্র সন্তান। মা গত হয়েছে তার শৈশবে। তার পরিবার শুধুই বাবাকে নিয়ে। তার বাবা তাদের জায়গা দেখিয়ে বাড়ি করার লোন নিয়েছিলেন। সে টাকা পর্যাপ্ত ছিল না, তাই তার সমুদয় ব্যাংক ব্যালেন্স মরটগেজ রেখে লোনও করেছিলেন। বাড়ির কাজ শুরু করার পরই শুরু হল বিপত্তি। দুনিয়ার সব রোগ তার বাবাকে একত্রে আক্রমন করল। জানা গেল কিডনি দুটোয় নষ্ট, ফুসফুসে পানি জমেছে। ডায়ালাইসিসের জন্য পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়ল দ্বিতীয় স্টেজের ক্যান্সার। সকল টাকা বাড়ি তৈরির বদলে চলে গেল চিকিৎসায়। তাও লাভ হল না, শরীরের একপাশ অচল হয়ে গেল। এই যখন অবস্থা, আকিব তখনও সেশন জ্যামের কারনে শিক্ষার্থী; সবদিক থেকে টাকা যেন চোরাবালিতে চলে গেল; বাড়তি এল ঋণের বোঝা। ব্যাংক ব্যালেন্স সিজড হল, জায়গার মালিকানা গেল। আকিবের জীবন হয়ে গেল নারকীয়। পরিবার অর্থাৎ তার বাবাকে নিয়ে উঠল কলোনিতে। সেখানে হরদম খিস্তি চলে, তিন মাসের ভাড়া বাকী পরায় কান পাতা যায় না। কুকুর জীবন হল তার।
তাই এখন সে খানিকটা অস্বাভাবিক। দিনরাত কাটে ধর্না দিয়ে। ব্যাংক থেকে কিছু টাকা ছাড়ানোর চেষ্টা থাকে সবসময়।
আজো আকিবের ব্যাংকে আসার এটাই কারন। তবুও নিস্ফল। ব্যাংকের অফিসারেরা শুধুই কাগজ দেখায়, আরে সেসব কাগজ তো বোঝে না মানুষের কষ্ট। কিছু কাগজ যদি মানুষকে চালায়, মানবতা কাকে চালাবে?
এসব ভাবতে ভাবতে মনটায় খারাপ হয়ে গেল আকিবের। দিনরাত আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না আকিব। বাধ সাধে তার বাবা। অসুস্থ, সে না থাকলে মাটিও জুটবে না তার কপালে। আত্মীয়? মুখ কোঁচকাল আকিব। ধুর শালা- বলে দেওয়ালে ছোট একটা লাথি মারল। বেকায়দায় আঙ্গুল লেগেছে, উঃ করে বসে পড়ল আকিব। উঠতে গিয়ে তার চোখ পড়ল ভল্টের দিকে। হাহাকার উঠল মনে। এখানের কিছু টাকা একসময় তাদের ছিল। ভল্টের সামনে ক্যাশ, আর তার সামনেই লাইন। লাইনের মানুষগুলোর দিকে তাকায় আকিব। ঘৃণা ফুটল তার মুখে; আর তখনই তার মনে পড়ল একটা কথা। ভাবল, তার সম্পদ যদি ভাগ্য কেড়ে নিতে পারে, কেন সে আরেকজনের সম্পদ কেড়ে নিতে পারে না?
কথাটা মাথায় আসতেই লোভ হল খুব। মনের একটা অংশ মানা করলেও, আরেক অংশ বলল- নীতিকথার বালাই রাখ। এখন লাখখানেক টাকা তাকে দিতে পারে নারকীয় যন্ত্রনা থেকে মুক্তি।
ভাবতে ভাবতেই আকিবের চোখ গেল সেই লাইনের সামনের লোকটার দিকে। তার লোভকে চাগিয়ে দিয়ে, পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল হাতে নিল লোকটি। তারপর খামে পুড়ে পকেটে চালান করে দিল।
ঘোর খুব খারাপ। এর কবল থেকে মুক্তি পাওয়া দায় সহসা। তাই ঘোরের মধ্যেই লোকটার পিছু নিল আকিব।
রাস্তায় নেমেই দেখল, লোকটি সিগারেট হাতে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। অনুসরন করল আকিব। দেখল, লোকটা একটা দোকানে ঢুকল। দোকানের বাইরে পিলারের আড়ালে কায়দা করে দাঁড়াল আকিব। লোকটা লাইটার হাতে নিয়েছে, দোকানি নিচু হয়ে কি করছে; আকিবকে দেখেনি। লোকটা সিগারেট ধরাল। আকিব দেখল, বান্ডিলের খামটা উকি দিচ্ছে পকেট থেকে। লোকটা লাইটার ফেরত দিচ্ছে। দোকানী এখনো নিচে তাকানো। এখনই সময়-মনে হল আকিবের। হাত বাড়াল আকিব। হাতে চলে এল খামটি। হাত গুটিয়ে নিয়ে পেছনে ফিরতে যাবে তখনই, হ্যাঁ তখনই দোকানী দেখে ফেলল তাকে। আকিব দাঁড়াল না, ঘুরেই দৌড় দিল। এক সেকেন্ড? তারপরই শোনা গেল চিৎকারঃ চোর! চোর!
এত দ্রুত ঝড় আসে না, এত দ্রুত মাথা থেতলানো পুলিশকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে না কেউ; যত দ্রুত পিলপিল করে হাজির হল প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ। এদের প্রত্যেকের হাত-পা ছুটছে অবিরাম। উৎসুক জনতার সংখ্যা শ খানেকের বেশী। এদের অনেকেই গণধোলাই এর নাম শুনেছে। আজ চোখে দেখছে প্রথমবার।
আকিবের মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। বুঝে উঠার আগেই তার শরীর ভরে গিয়েছে অসহ যন্ত্রনায়। বৃষ্টির মত পড়ছে চড়, থাপ্পর, লাথি, ঘুষি। মুখে রক্তের স্বাদ অনুভব করল আকিব; লোনা। আর তখনই মট করে শব্দ হল, তীব্র ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ল পাজরে, মস্তিষ্কে যেন ভোতা আঘাত করল। আঘাত ছাপিয়ে তার মাথায় চলে এল বাবার চেহারা। সাথে সাথে প্রবৃত্তি বলল, ছুটতে হবে। পালাতে হবে। নয়ত মাটি দেবে কে?
ঘোরের ভেতরই বলয় থেকে ছিটকে বেরোল আকিব। ছুটতে ছুটতে সামনে পড়ল একটা বড় দোকান। জান বাঁচাতে ঢুকে পড়ল। বাঁকা হয়ে পড়ে যেতে যেতেই দেখল, দোকানের সৌম্য চেহারার বৃদ্ধ সওদাগর এগিয়ে গিয়ে কিছু বলছে। কয় সেকেন্ড? আকিব দেখল কিছু হাত আবার তাকে ছেঁচরে নিয়ে যাচ্ছে রাস্তায়। আকিব তার বাবার কথা কি বলতে চাইল, চিৎকার করে বাঁচতে চাইল, ক্ষমা চাইল। কেউ কান দিল না। রাস্তায় আছড়ে পড়তে পড়তে সে শুনল কে যেন বলছে; ‘এই ইতেরে মারি ফেলা’
আরো কিছুক্ষণ পর আকিব খেয়াল করল, আগের মত আঘাত সে পাচ্ছে না। শুধু পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছে। পাশবিক চেহারার মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য আকিবের মনে হল, এরা আদৌ মানুষ তো, যাদের সে ভালবেসেছিল। আর কত কথা তার মনে এল, তা অজানা। আকিবের চোখ পড়ল সেই বৃদ্ধ লোকের উপর। শুধু নিজের উপর ঘৃণা নিয়ে জ্ঞান হারাতে হারাতে আকিবের মনে হল- লোকটার এ ক্ষতি সে না করলেও পারত।
শেষ কথাঃ
ঝড় শেষ হলে প্রকৃতি শান্ত হয়ে যায়। অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পরে প্রকৃতি জুড়ে, ঝরের রাতের পর; সকাল বেলা। শুধু গৃহহারা কিছু মানুষকে দেখা যায় উড়ে যাওয়া টিনের চাল ইতিউতি খুঁজতে। আর আশেপাশে পরে থাকে মরা পশু, পাখি, উপড়ানো গাছ।
তান্ডব শেষ হলে রাস্তা খালি হয়ে গেছে। একজন বয়স্ক লোককে খালি খাম হাতে হতভম্ব হয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে রাস্তায়। সম্ভবত তিনি তার পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিল খুঁজে পাননি।
লোকটার একটু দুরেই দোমরানো অবস্থায় পড়ে আছে ধৃত চোর অথবা এক যুবক। তার হাতের কাছে মাত্র পাঁচশ টাকার একটা রক্তাক্ত নোট পরে আছে।
পরিহাস, পরোপকারী জনতা সেটাও নিতে ভুলে গেছে।