#১#
সময় সন্ধ্যা।
বাসায় একা তিথি। রাফি অফিসে। আসার সময় হয়ে এসেছে।
কোন এক কবিতার বই থেকে জয় গোস্বামীর কবিতা আবৃত্তি করছিল তিথি। কবিতার নাম পাগলী তোমার সঙ্গে। বেল বাজল এসময়। ডিং ডং। কবিতার শেষ দিকে তখন তিথি। একদম মোহিত হয়ে গিয়েছিল। অবচেতন মনের সাড়া পেল, একেবারে শেষ করে উঠ তিথি। তিথি তাই পড়ছিল।
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
……………………………………………………………………
সন্ধেবেলা ঝগড়া হবে, হবে দুই বিছানা আলাদা
হপ্তা হপ্তা কথা বন্ধ মধ্যরাতে আচমকা মিলন
পাগলী, তোমার সঙ্গে ব্রক্ষ্মচারী জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে আদম ইভ কাটাব জীবন।
নিজেদের কথা ভাবছিল তিথি। তখনই বেল বাজল আবার। এবার দুবার। ডিং ডং, ডিং ডং। কবিতা শেষ। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামল তিথি। স্যান্ডেল খুঁজে পেল না সহসা। একটা পেল, আরেকটা বিছানার তলায় ঢুকে গেছে বোধহয়। নিচু হয়ে খুঁজে নিল তিথি। তারপর দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। ততক্ষণে বেল টিপে ধরে রেখেছে আগন্তুক, একটানা বেল। দরজা খুলে দেখল রাফি দাঁড়িয়ে আছে।
এতক্ষণ কেন? ভ্রু কুচকে বলল রাফি।
ঠোঁট কামড়াল তিথি। বলল, একটা কবিতা পড়ছিলাম, শেষ করে আসছিলাম, দেখি স্যান্ডেল ………
থামো। ধমকে উঠল রাফি। আমি বাইরে থেকে আসলাম তুমি দরজা না খুলে পড়ছ কবিতা। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকো, তখন পড়তে পার না? আমি এলেই পড়া বেড়ে যায়? উত্তেজিত কন্ঠে বলল রাফি।
স্যরি স্যরি। কি যে হয়ে গেল। আর ভুল হবে না। তিথি আসলেই নিজের ভুল বুঝতে পারছিল।
তিথির অনুতপ্ত হওয়া রাফির মনে কোন প্রভাব ফেলল না। সে জুতা খুলে ছুড়ে মারল একদিকে। তারপর দড়াম করে দরজা লাগিয়ে হনহন করে ভেতরে চলে গেল।
পেছনে দাঁড়িয়ে তিথি চেয়ে থাকল রাফির দিকে। এই ছেলে তার জীবন ধ্বংস করছে নাকি প্রাপ্তিতে ভরিয়ে দিচ্ছে; তিথি বুঝতে পারে না। এই রাগ এই হাসি। মাঝেমাঝেই সে ভাবে রাফিকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাবে। ও এমন কেন? প্রতিদিন ঝগড়া, হাতাহাতি। আবার পাগলের মত ভালোবাসাবাসি। আর খুব রেগে গেলেই রাফি চিৎকার করে উঠে। তালাক। তালাক। বছর ধরে এমনই দেখে এসেছে তিথি। রাফি আজো তার কাছে এক রহস্য।
#২#
কিছুক্ষণ পর। ডাইনিং এ খাবার পরিবেশন করছিল তিথি। ওভেনে গরম করে নিয়ে এল নতুন করা এক পদ। বেডরুমে গিয়ে রাফিকে ডাকল।
এস। খাবার দিয়েছি।
খাব না। রাফি বলল।
কেন? খেয়ে এসেছ?
হুম।
কোথায় গেলে?
এরিস্টোক্রেসি।
কার সাথে? তুমি তো একা খেতে অপছন্দ কর।
আহা! এত জেরা কর কেন? বিরক্তি ঝড়ল রাফির গলায়। চাকরী করি, কত জায়গায় যায়, কয়টি বলব?
তিথি বেড়িয়ে এল রুম থেকে। রাফি শুরুতে এমন ছিল না। সে পাঁচ বছর আগের কথা। সে গল্প লিখত আর লিখত তিথিকে নিয়ে কবিতা। এক দুটি নয়। শতশত কবিতা। এক নীল জামা পড়ে এসেছিল তিথি যেদিন প্রথম তাকে দেখেছিল রাফি, তাই নিয়ে কবিতা ফাঁদল রাফি। কয়দিনের মধ্যে তিথির হাতে এল চিঠি। হ্যাঁ রাফি চিরকুট আর চিঠি লিখতে ভালবাসত। রাফি লিখেছিল,
এখন আকাশ অনেক নীল
ছিল না এতটা তখন,
যখন তুমি এসেছিলে
নীল ওড়না গায়ে।
অনেকখানি আকাশের নীল এসে ভীড় করেছিল তোমার ওড়নায়।
আর?
মূল আকাশ হারিয়েছিল ঔজ্জ্বল্য।
পরে লিখেছিল,
রমনী তোমার ওড়না-আঁচলের পরশটুকু দিও।
তোমার চোখের ভাষা শুধু আমায় পড়তে দিও।
রাফি বরাবরের মতই একটু অস্বাভাবিক। তার সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। সবসময়ই সে সন্দেহপ্রবণ। তিথিকে নিয়ে খুব ইনসিকিউরড ফিল করত রাফি। খুব করে নিজের সম্পদ ভাবত তিথিকে, একদমই নিজের অধিকার। প্রশ্ন বানে জর্জরিত ছিল তিথি। এমনকি তাকে পাবলিক যানবাহনেও চড়তে দিত না রাফি।
ডাইনিং থেকে নিজের তৈরি নতুন খাবার হাতে করে নিয়ে লিভিং রুমে এল তিথি। সেখানে টিভি দেখছিল রাফি। তিথি এগিয়ে এসে বলল, আজ এটা বানালাম তোমার জন্য। একটু খেয়ে দেখ। কেমন হয়েছে?
আহা বলেছি না খাব না। বিরক্ত কর কেন?
অপমান লাগল। টপ করে পানি চলে এল তিথির চোখে। যেন একবিন্দু তরল মুক্তো। দেখেও দেখল না রাফি।
ডাইনিংএ এসে দাঁড়াল তিথি। মনে পড়ল, প্রথম যখন কাঁদতে দেখেছিল রাফি; উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছিল, তোমার চোখে যেন আর পানি না দেখি। কিসের কষ্ট তোমার? সব কষ্ট আমি নেব।
কাব্য করে বলেছিল,
চোখের কোণে জন্ম নেওয়া একটি ফোঁটা অশ্রুর।
ছলছল করতে থাকা দুফোঁটা কান্নার জল।
কত কষ্টের প্রতিনিধি তোমরা।
আমায় দাও। কষ্ট সব আমি নেব।
তিথির পুরনো কথা মনে পড়ে।
#৩#
রাফি লিভিং রুমে টিভি দেখছিল। হঠাৎ তার চিৎকার শুনল তিথি
তিথি। তিথি।
দৌড়ে এল তিথি। বলল, কি হয়েছে? এমন করছ কেন?
চেহারা পাল্টে গেছে রাফির। হিস্টরিয়াগ্রস্থ রোগীর মত করছে যেন।
এশট্রেতে সিগারেটের টুকরো কেন? জিজ্ঞেস করল রাফি। এই ব্র্যান্ড তো আমি খাই না।
থামো, ঠান্ডা হও। বলল তিথি। ধ্রুব এসেছিল। ধ্রুব তাদের ব্যাচমেট, প্রথমদিকে তিথির পেছনে ঘুরেছিল, সেটা রাফি জানে।
কি? চিৎকার করল রাফি? আমাকে বলনি কেন?
ভয় পাচ্ছিল তিথি। কোনরকমে বলল, বলার সময় পায়নি।
ফোন করতে পারনি? এতক্ষন সময় পাওনি?
ও এসে পাঁচমিনিট বসল। সিগারেট খাচ্ছিল, আমি চা করছিলাম। তুমি নেই শুনে চা না খেয়েই চলে গেল। আর তুমি এসেই রাগারাগি করলে, কখন বলব?
কি? চিৎকার করল রাফি। আমি রাগারাগি করেছি?
হ্যাঁ করেছ।
ওই হারামজাদা এসে বাসাই বসে রইল। তুমি আমাকে জানালে না? কেন? কি করছিলে? জানালে কি ক্ষতি হয়ে যেত? আমি তোমাদের কাজে বাগড়া দিতাম।
তিথি জানে এবার রাফি পাগলামী করবে। তবু বলল, তুমি মিসবিহেভ করছ। চিৎকার করছ কেন?
“ঠাশ” শব্দ হল হঠাৎ। আর সাথে সাথেই লুটিয়ে পড়ল তিথি, ধাক্কা খেল সোফার হাতলে।
হারামজাদি, তুই লীলা করে বেড়াবি, আর আমি কিছুই বলব না? যা তোকে তালাক দিলাম। তিন তালাক। এবার যা তোর যেখানে খুশি, ধ্রুবকে ফোন দে তোকে নিয়ে যাক।
তিথি খুব কান্না করছিল। ঠোঁট ফেটে রক্ত এসেছিল।
রুম থেকে বের হবার সময় এশট্রেটা মেঝেতে আছাড় মারল রাফি। ভাঙ্গা টুকরো ছড়িয়ে পরল ঘরময়, কিছু এসে আঘাত করল তিথিকেও।
#৪#
তিথির মনে আসছিল হাজার কথা। একবার আজকের মত কিছু হওয়াতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সে। প্রতিদিন শত শত ম্যাসেজ, ফোন আর চিঠি যেত তার ঠিকানায়। প্রত্যেকদিন রাফি দাঁড়িয়ে থাকত তার বাসার সামনে। ঘন্টার পর ঘন্টা হাটাহাটি করত। রাফি লিখেছিল,
এখন আমি পরিবর্তিত এক সত্তা
বেঁচে আছি তবুও।
মাঝে মাঝেই স্বপ্নে ভাবি,
হয়ত হঠাৎ আবার
কোন একদিন
আমি ফিরে পাব সেইদিন।
আর পারেনি তিথি। ফিরে গিয়েছিল একা, পরিবারহীন রাফির কাছে।
তিথির হাত চিরদিনের মত চেয়ে নেওয়ার সময় রাফি লিখেছিল,
দেখ এনেছি তোমার জন্য
লক্ষ তারার আলো।
এনেছি আমি পৃথিবীর যত ভালো।
আমি ডাকছি তোমায় সুখ বরষায় ভিজতে।
সুখ বরষায় ভেজার এমন আমন্ত্রণ সেদিন উপেক্ষা করতে পারেনি উনিশ বছরের তিথি। সেদিন থেকে অন্য যাত্রার শুরু। তিথি পত্র পেয়েছিল কবিতা লেখা,
ধরনী তুমি দ্বিধা হও।
নাও আমাদের জ্বলন্ত লাভায়
কিংবা পাঠাও মহাকাশের কালো অতল গহ্বরে
তবু নির্জনতা দাও আমাদের।
শ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে অধিকার করেছি।
এখন চাই ক্ষণিক নির্জনতা।
পরে লজ্জা পেয়েছিল তিথি। লজ্জায় লাল হয়ে মুখ থেকে ছিটকে বেরোল, অসভ্য।
পাত্তা দেয়নি রাফি। যুগে যুগে সম্ভ্রমা প্রেমিকার কাছে তাদের প্রেমিকেরা সর্বদা অসভ্য। জীবনের প্রথম, আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করার পরপর রাফির লেখা,
শুন্য কক্ষে আমরা দুজন ছিলাম।
তুমি লজ্জায় মুখ ঢাকলে দুহাতে।
কক্ষে তখন সময়ের নাম ছিল না।
মনে পড়ে?
কিসব ঘটেছিল সেই স্নিগ্ধপ্রাতে?
তাদের দুজনের এই পথচলায় রাফি যেন এক বিস্ময়ের নাম। একের পর এক আঘাত করে। আবার শোধ করে দেয় ভালোবেসে। তিথির জীবনে এই রাফির কারনেই এমন সব মুহূর্ত আছে, যা খুব কম মেয়ের জীবনে থাকে। নিজেকে সম্রাজ্ঞী ভাবে তিথি। হয়ত রাফি অস্বাভাবিক; তাই সে স্পেশাল।
#৫#
এতসব ভাবনা চিন্তার মধ্যে মধ্যে কোত্থেকে এল রাফি। এখন চেহারা অন্যরকম। ভেতরের পশু নেই, আছে এক সরল বালক। তিথি তখনও মেঝেতে শোয়া।
আমার রানী মেঝেতে কেন? বলেই আচমকা তিথিকে কোলে তুলে নিয়ে শয়ন কক্ষের বিছানায় শুয়ে দিল পরম যত্নে। সাথে সাথ উঠে বসল তিথি। রাফি গেছে ফার্স্ট এড কিট আনতে। বাক্স এনে তিথির পাশে বসল রাফি। খুব মনযোগ দিয়ে কি যেন খুজছে। তারপর তিথির দিকে ফিরে বলল, তুলো তো নেই।
লাগবে না আমার। কিচ্ছু লাগবে না।
তিথি, ঈশ কি রক্ত ঝরছে। কি করি? তুলো তো নেই। আচ্ছা দেখি; বলেই মুখ নামাল রাফি।
মুখ তুলল খানিক পর। ততক্ষণে তিথির ঠোঁটে জমে উঠা কালচে রক্ত শুষে নিয়েছে রাফি।
কিছু মুহূর্ত কাটল। সবাই নিশ্চুপ।
তারপর তিথি কিট বক্সটা হাতে নিল। একটু পরই হাতে উঠে এল তুলার প্যাকেট।
সেদিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে হাসল রাফি। জিজ্ঞেস করল, তখন চোখে পড়েনি কেন?
তিথি নিরুত্তর। জানা উত্তরটা তার কাছেই থাক।
#৬#
তিথিকে সন্ধ্যের সেই খাবার আর পেরাসিটামল খাওয়িয়ে শুয়ে দিল রাফি। বলল, একটু ঘুমোও।
ফিরে যেতে চাইতেই হাতে টান পড়ল রাফির। ফিরে দেখল, তাকিয়ে আছে তিথি।
আমায় যে তালাক দিলে? তোমার ঘরে আর থাকতে পারি?
হালকা হেসে চলে যাচ্ছিল রাফি। এবার সে নিরুত্তর।
#৭#
এখন মাঝরাত। ঘুমানোর আগে তিথি ভাবছিল, তার রাফি এমনই থাকবে হয়ত। কেমন পাগল পাগল। থাক, আপত্তি নেই।
এই মুহূর্তে তিথি ঘুম। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চাঁদের আলো জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়ছে। পাশে বসে তিথির ফুলে উঠা ঠোঁটে আঙ্গুল ছোঁয়াল রাফি। বিড়বিড় করে বললঃ
অতন্দ্রীলা, ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো………
বিশ বছর আগে, যেন এক ঝড়ের রাতে, প্রচন্ড চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গেছিল রাফির। তার বাবামার ঝগড়া খারাপ ভাবে প্রতিদিনই হত। অশ্লীল গালাগালিতে বালিশের নিচে কান চেপে থাকত ছোট্ট রাফি। সেদিন দেখল বাবা রাফির মাকে বলেছিল, তোমায় তালাক দিলাম। যাও। সেদিন তার জন্মদাত্রী বলেছিল, এদিনের অপেক্ষায় ছিলাম কতকাল।
সেদিন থেকে তারা আলাদা। রাফি অবাক হয়ে ভেবেছিল, একটি শব্দ কিভাবে এক পরিবার ভেঙ্গে দেয়? তাহলে বিয়ের প্রতিশ্রুতি আর কোথায়? এই রাফি বড় হয়েছে মানসিক আঘাত পেয়ে। বেড়ে উঠেছে কষ্টের মধ্য দিয়ে। এক ভিন্ন ছাঁচে। সারাক্ষন তার মনে হয়, এই তিথিই তার আছে একমাত্র। এই তিথির মাঝেই তার জীবন। তাই রাফি একটা কাজ করেছিল; রাফির মতই। যাতে তিথিকে সে না হারায়।
বিয়ে একটি প্রতিজ্ঞা। তালাকে যা ভাঙ্গে।
সেই প্রতিজ্ঞায় ভাঙ্গে, যা করা হয়। রাফি-তিথি তারা কখনোই সেই প্রতিজ্ঞা করেনি। তিন তালাকের তাই ক্ষমতা নেই, সেই প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গার, তাদের আলাদা করার। তারা তাই নিশ্চিন্তে বসবাস করে, এক তিন তালাকের ঘরে।
বিদ্রঃ দুটি কবিতা সংগ্রহীত-প্রথম কবিতাটি জয় গোস্বামী এবং শেষ কবিতাটি অমিয় ভট্টাচার্য'র।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৫ রাত ১১:১২