চারপাশের পৃথিবীটা অনেক পাল্টে যাচ্ছে। দিন বদলাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে রাতগুলোর চিত্রও। আর সময়? সে তো সদা ধাবমান।বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ, যেখানে কেজি স্কুল থেকে ফিরে আসার পরের সময়গুলো দৌড়ে কাটাতাম সেখানে এখন দুনম্বরী ইট আর বালুসিমেন্টের বেহিসেবী মিশ্রণে উঠে দাঁড়াচ্ছে আস্তরবিহীন চার দেওয়াল। আমার প্রিয় সেই বহুতল ভবনের ছাদে এখন কোন এক টেলিকম কোম্পানির বিশাল টাওয়ার। ইচ্ছেখুশী মতোন যে প্লটের দেওয়াল টপকে ভেতর থেকে সাদা কাশফুল ছিঁড়তাম সেখানে আজ সেমিপাকা ঘরের ভাড়া গুনছে কোন এক সওদাগরেরর ছেলে। বিলের মাঝখানে দশ বাই আট ফুটের গর্ত করে বানানো পুকুরগুলো এখন কেমন আছে?
নতুন নতুন বছরের আসা যাওয়াতে বুঝতেই পারলাম না কখন বাড়ির মাটির দ্বিতল ঘর আমার ভেংগে পড়ল। নানুবাড়ির যে সুউচ্চ জাম্বুরা গাছ থেকে আঠার ফুটের কোন্ডা(ফল পাড়তে ব্যবহৃত) দিয়ে প্রথম জামবুরা পেড়েছিলাম, সে গাছের কাটাটুকরোগুলো এখন গড়াগড়ি খাচ্ছে কোনো এক ফার্নিচারের কারখানায়।
ফেলে আসা সময়ের আবহাওয়া আমি আর খুঁজে পাই না। তখনকার কোরবানির ঈদগুলো ছিল কনকনে ঠান্ডার সময়। যখন গরুর গায়ে দেবার ছালার আয়োজন করতে হত, মাঠে জ্বলত নাড়ার আগুন। প্রত্যেকটা উতসবের আলাদা স্বাদ ছিল, ছিল আলাদা গন্ধ। বছরের প্রত্যেক মাসের ছিল নিজস্ব আমেজ। আমাদের বার্ষিক পরবর্তী সময়গুলো ছিল প্রচন্ড শীতের।
অনেক বয়স হয়ে যাচ্ছে আমাদের সবার। সমবয়সীদের দেখছি একেকজনের বয়স সতের-আঠার-উনিশ...... সংখ্যা বাড়ছেই...............
চাচা চৌধুরী-সাবু এবং আরো অনেক কমিক্সের দিনগুলোকে মিস করি। এসব কমিক্সের জমজমাট বইএর দোকানগুলোর জীর্ণ দশা দেখে হাহাকার জাগে। এখনকার ছেলেরা কি কমিক্স পড়ে না? মুগলি, সিন্দাবাদ কিংবা লেপের নিচে টর্চ জ্বালিয়ে ঘেমে নেয়ে রাত দুটো পর্যন্ত তিন গোয়েন্দায় সাথে এডভেঞ্চার। কোরবানির সময় গরু নিয়ে বিশাল মাঠে সকাল সন্ধ্যা দৌড়োদৌড়ি; খুব মিস করি বিকেল বেলায় ফুটবল, ক্রিকেট নিয়ে বিল্ডিং এর ছাদে, বিভিন্ন মাঠে কাটানো সময়কে।
আমরা এমন এক সময়কে দেখতে পেয়েছি একটুর জন্য হলেও যে সময় চিঠি লেখা হত, গলির মাথার দোকানে পাওয়া যেত দুই টাকারস্ট্যাম্প। যখন বিলাসী কালির কলম ব্যবহার করা হত। যখন দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গুটিকয়েক বাসায় ছিল ল্যান্ডফোন। যখন মানুষের সাথে যোগাযোগ ছিল কম। কিন্তু যখন দেখা হত সে নিবিড় আনন্দে কোন কৃত্রিমতা থাকত না। এমন এক সময় চলে গিয়েছে, যখন চিরাচরিত দাদী-নানীরা ছিল একদমই অনাধুনিক, একদম তাদের মতই। আমরা গ্রীষ্ম থেকে বসন্ত দেখেছি। নতুন যেই প্রজন্মগুলো আসছে, তারা কি কখনো জানবে, সেপ্টেম্বরের এই সময় হতেই শুরু হত শীতের রাতগুলোর আনাগোনা। তারা কি এখনকার ছমাসের গ্রীষ্ম দেখে বুঝবে, আগে গ্রীষ্ম ছিল সর্বোচ্চ তিন মাসের। যখন মানুষ ঝড় আর কালবৈশাখীর আগমন প্রেডিক্ট করতে পারত। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা টাংস্টেন এর হলুদ আলো, চেরাগ-হ্যারিকেন আর ডোবাইওয়ালার ছয় ব্যাটারির টর্চ লাইটে গ্রামের রাতগুলোকে আলোকিত হতে দেখেছিলাম।
এখনকার সবকিছুই কেমন কেমন। পাল্টে যাওয়া সবকিছুই। কটকটিওয়ালার কাছ থেকে পুরোনো বইখাতার বিনিময়ে কটকটি খাওয়া হয় না। বলপেনের বলগুলোও এখন আর খুলে পড়ে হারিয়ে যায় না। পেন্সিলের ভাংগা নিপে বা পুরোনো ডায়েরীতে নোট করা 'গরু' কিংবা 'আমাদের ছোট নদী-গ্রাম' রচনাতেই তখনকার দুরন্তপনা খুঁজতে হয়। আমার রোলটানা বাংলা ইংরেজি খাতার কথা মনে পড়ে। মনে পরে কেজি-প্রাইমারি স্কুলের সামনের চালতা আর বস্তা আইস্ক্রিমের কথা। মনে পরে চারটে পঁচিশ পয়সা জমিয়ে একটাকা করতে পারার দুর্নিবার আনন্দকে। ফেলে আসা ঘরগুলোর কথা ভাবি, মনে পরে ফেলে আসা মানুষগুলোর কথা।
আমি ছয় বছরের হাফপ্যান্ট পরা এক বালককে এখনো দেখতে পাই, যে বিকেলের মিষ্টি রোদে বেরিয়ে পড়ত ষড়ভুজের সাদা-কালোয় ফুটবল অথবা ছোট ব্যাট প্লাস্টিকের বল নিয়ে।
আমার শহর আগের মত নেই। এখনের সময়ও আর আগের মত নেই। এখনকার শহর আর এই সময়ের গন্ধ আমি চিনি না। রুপকথার দিনগুলো শেষ। এখন আছে শুধু হীরন্ময় স্মৃতি।
এখনকার রাতগুলোতে আসলেই কোন রুপকথা নেই।