আবৃত্তি: সর্বশাস্ত্রাণাং বোধাদপি গরীয়সী। আবৃত্তি সবশাস্ত্রের বোধের চেয়েও গৌরবের। আবৃত্তি সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম বাচিক শিল্প।
প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে আবৃত্তি শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ ছিল। শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ-বারংবার পাঠ। প্র, পরা, অপ, সম ইত্যাদি যে বিশটি উপসর্গ বাংলায় পাওয়া যায় আ তার একটি। আ মানে সম্যকভাবে বা সর্বতোভাবে। সেক্ষেত্রে আবৃত্তির প্রাচীন অর্থটা হয় এরকম- সম্যকভাবে বা সর্বতোভাবে যা পঠিত বা উচ্চারিত।
বৈদিক ভাষা যখন রচিত হয়, তখন লেখার কোন পদ্ধতি আমাদের জানা ছিল না। বৈদিক কবিরা রচনা করতেন মুখে মুখে এবং সে রচনা কাগজে লিখে রাখবার মতোই ধরে রাখতেন মুখে মুখে, আবৃত্তির সাহায্যে। বৈদিক সাহিত্য আবৃত্তির মাধ্যমে যুগে যুগে বাহিত হবার আরো একটি কারণ ছিল। এ প্রসঙ্গে সুকুমার সেন বলেন- সে হল লেখাপড়ার চেয়ে আবৃত্তির উৎকর্ষ। লেখাতে ভাষার সবটুকু ধরা পরে না। না কন্ঠস্বর, না সুরের টান, না ঝোঁক। কিন্তু আবৃত্তিতে এসবই যথাযথ বজায় থাকে।
আর্য সমাজে এমনকি বৌদ্ধ যুগেও আবৃত্তির ছিল অপ্রতিহত প্রতাপ। বৈতালিক, বন্দী, ভাট, নকীব আবৃত্তি করেই রাজসভা সূচনা করেতন। মঙ্গলাচরন, স্বস্তিবাচন, ভরতবচন, প্রণতি, আর্শীবচন হত আবৃত্তির মাধ্যমে। আবৃত্তি করেই জীবিকা অর্জন করতেন সভাকবি।
০২
আধুনিক কালে বাংলা ভাষায় আবৃত্তির নবতর প্রসার ঘটে বিশ শতকের গোড়ার দিকে। প্রাচীনকাল থেকে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে আবৃত্তি বলতে যা বোঝাত তা হল, পাঁচালী, পুঁথি, রুপকথা, আর্শীবচন ইত্যাদির সুরেলা পাঠ। আবৃত্তির মোড় ঘুরে যায় আধুনিক বাংলা কবিতার উন্মেষ পর্বে। রবীন্দ্র কবিতার আবৃত্তি দিয়েই মূলত আধুনিক আবৃত্তি চর্চার শুভ সূচনা হয়। আর শিশিরকুমার ভাদুড়ি ছিলেন আধুনিক আবৃত্তির প্রথম পথিকৃৎ।
০৩
সংগঠন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত সংঘটন [ সম্ +ঘটন] শব্দ থেকে। সংগঠন মানে সম্যকভাবে গঠন, সংঘবদ্ধ করা। বহুকাল আগে থেকে মূলত সংগঠনের মাধ্যমে ধর্ম, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছে।
আমাদের সংগঠন চর্চার ইতিহাসও দীর্ঘ এবং অত্যন্ত উজ্জ্বল। শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন প্রথম সার্থক সংগঠক। বাঙালির দীর্ঘ দিনের অন্ধকার দূর করতে পরবর্তিতে রীতিমতো সাংগঠনিকভাবে কাজ করেছন রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বেগম রোকেয়া প্রমুখ।
যুগ যুগ ধরে সাংস্কুতিক সংগঠন গুলো জনজাগরণের কাজ করে আসছে। যার মূল জায়গা চেতনা ও মূল্যবোধ। সাংগঠনিক চর্চার জন্য শিল্পী হতে হয়না। সংগঠন চর্চা মানে মহত্বের চর্চা, মনুষ্যত্বের চর্চা, মানবিকতার চর্চা। সংগঠন করা মানে কেবল নিজেকে তৈরি করা নয়, দেশ জাতি সমাজকে কিছু দেবার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। দীক্ষাহীন, ব্রতহীন, প্রতিশ্রুতিহীন, দায়বদ্ধতাশূন্য সাংস্কুতিককর্মী দিয়ে সংগঠনে কী কাজ হবে?
আমাদের সংগঠন চর্চায়ও কিছু ভুল আছে বলে মনে হয়। আমরা কেন একেকজন নতুন আবৃত্তিশিক্ষার্থীকে সংগঠনে ধরে রাখার জন্য আপোস করছি? আমরা কেন একেকজনকে শিল্পী হিসেবে মঞ্চে তোলার কিংবা টেলিভিশনে মুখ দেখাবার স্বপ্ন দেখাচ্ছি? এবং এই করে আমরা মনে হয় ছোট ছোট ভুল করে করে বড়ো ধরনের ভুল করছি। আমরা বড়ো বেশী অনুষ্ঠান নির্ভর হয়ে পড়ছি, খুব বেশী আনুষ্ঠানিক হয়ে পড়ছি। ফলে হিসেব মিলছে না, হতাশা জমাট বাঁধছে আবৃত্তি সংগঠনগুলোতে।আমাদের এখন ঘুরে দাড়াবার সময় এসেছে। কেবল মিডিয়ামূখী নয়, কেবল অনুষ্ঠানমুখী নয়, আমাদের এখন আর্দশের জায়গাটা ভালো করে দেখে নেয়া দরকার। প্রতিশ্রুতিহীন, দায়বদ্ধতাশূন্য প্রতিভাবানশিল্পীদের নিয়ে আবৃত্তি সংগঠন করা সম্ভব নয়। মূল্যবোধহীন, চেতনাহীন, খ্যাতিলোলুপ-শিল্পী আর শয়তানের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। শয়তানকে সহজে চেনা যায়, কিন্তু প্রতিভাবান অস্ৎ শিল্পী ছদ্মবেশী।
আবৃত্তিপ্রযোজনার বদ্ধমূল ধারণা বদলাতে হবে। দলগতভাবে মঞ্চে যাবার মতো বাংলা কবিতার আকাল পড়েনি। কেবল প্রয়োজন সেগুলোর উপযুক্ত গ্রন্থনার। কিন্তু এমন দৃষ্টান্তের বড়ো অভাব কেন? উপযুক্ত পরীশ্রমী আর মেধাবীর কি অভাব আবৃত্তি অঙ্গনে? নাকি সবচেয়ে বড়ো অভাব সৎ মানুসিকতার?