সবাই বলে দিনে দিনে বাসের অযোগ্য হয়ে পরছে ঢাকা। তবু এই জ্যামে- জট, দূষিত আবহাওয়ার, ভিক্ষারি, জোচ্চর, ছিনতাইকারী, রিক্সার ঠেলাঠেলি, ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়া সরু রাস্তার শহরটাকেই বড্ডো ভালোবাসে ছেলেটি। মনে মনে সে ভাবে হয়তো যেতে পারি ছবির মতো দেশে, স্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার ছিমছাম সাজানো গোছানো কোন নগরে। কিন্তু সে আমার দেশ তো নয়। তবে কেন ভিনদেশের পষ্যপুত্র হয়ে বেঁচে থাকা। তারচেয়ে তো ঢেড় ভালো আমার নিজের দেশটা। রোজ ঘর থেকে বেড়িয়ে গলির মোড়ে যে দোকানে সে চা খায়, বিড়ি ফোকে, সেই দোকানদার রোজই তাকে শুধায়- ভাইজানের শরীলডা ভালা? এই যে অপরিচিত আত্নীয়তার উষ্ণতা, এমন আছে আরো হাজারও কিছু। কোথায় গেলে আর পাবো এমন।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেনাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
গল্পটির সময় কাল যখন ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এর মাঝে পেড়িয়ে গেছে অনেকটা সময়। ছেলেটি যতটা না পড়ে তার চেয়ে ফাঁকি দেয় বেশী। বাস্তব বুদ্ধির চাইতে আতলামীর মাত্রটা প্রবল বলেই হয়তো সে এমন। তবু নিজেকে নিয়ে তার আত্ন সন্তুষ্টির অভাব হয়না। পরিবার তার কর্মে সন্তুষ্ট না হলেও নিজেকে আবিস্কারের নেশায় মেতে থাকে ছেলেটি। সে কারণেই হয়তো অহেতুক আবেগ তাকে উস্কে দেয়। রবি ঠাকুর যে বলেছেন- আমরা যাদের চিনি তাদের আংশিক অংশে চিনি, তার মাঝে বিশাল ফাঁক। সেই ফাঁককে নিজের কল্পনাশক্তি দিয়ে পুড়িয়ে নিয়ে নিজের গল্পের নায়ক করে নিই মাত্র। রবি ঠাকুরের এই কথা বড্ডো ভাবিত করে ছেলেটিকে। তাইতো! আমরা কি সবাই সবাইকে পুরোপুরি চিনি, জানি? আর জানবই বা কি করে,আসলে নিজেকেই তো নিজে চিনিনা! এই ছাইপাশ ভেবে ভেবে সময় কেটে যায়।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এই পাঁচটি মৌলিক অধিকার তার জন্য চিন্তা। কিন্তু অভাব তার অন্য কিছুর। কোন কোন দিন মনে হয় ও ছাড়া তার বাঁচাই সম্ভব নয়। কিন্তু কিসের অভাব সেটা জানা হয়না। কেবল কোন কোন দিন সে গুনগুনিয়ে গায়- এক একটা দিন বড়ো একা লাগে!
গানের কথার একাকিত্বে প্রেমহীনতাই প্রবল বলে মনে হয়। কিন্তু ছেলেটি নাছোড় বান্দা। না,না, কেবল প্রেম নয় আরও কিছু কিংবা অন্য কিছু। সিদ্ধান্তহীনতার দিন গুলোতে ছেলেটি লুকিয়ে লুকিয়ে লেখে-
আমি কারো বন্ধু হতে পারলাম না, না কারো প্রেমিক
বন্ধুর ভাষা কি হ্যান্ডসেক, প্রেমিকের ভাষা কি চুম্বন
আমি হ্যান্ডসেক আর চুম্বনের দূরুত্বে পড়ে আছি বহুকাল।
আমার শরীর আর বেড়ে ওঠেনা
আমার মন আর বেড়ে ওঠেনা।
আমি স্থির একটি বিন্দুতে ক্রমশই ছোট হয়ে আসছি,
পৃথিবী আর মানুষের সম্পর্ক যে রকম ছোট হয়ে আসছে
আমি ঠিক সে রকম নই।
আমি সাদা কাগজের ওপর দীর্ঘকাল পড়ে আছি একা
যেন কোন সুঁই ফোটা বুক,
ফুসফুসে যার আজন্ম ক্যান্সার, প্রেমহীনতার, বন্ধুত্বহীনতা।
আমি কারো বন্ধু হতে পারলাম কই,
না কারো প্রেমিক?
এমন অসম্ভব অসংলগ্ন ভাবনা যেদিন পেয়ে বসে তাকে সেদিন অন্যদিনের চাইতে বেশী মাত্রায়ই অনিয়ম হয় ছেলেটির। বন্ধু বলতে যদি পরিচিত জন হয় মাত্র, তো তা তার আছে বটে। কিন্তু এমন দিনে তাদের সঙ্গ তার ভালো লাগেনা। সারাদিন ঘরে বসে বসে সে বের হয় সন্ধ্যায়। আর অদ্ভুত ভাবে সে আবিস্কার করে শহরটি অন্যদিনের চাইতে আরো বেশী আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে তার কাছে। এমন দিনগুলোতে অদ্ভুত একটা কাজ করে ছেলেটি। একা একা রিক্সায় ঘোরে সে, আর তার চারপাশের সমস্ত কিছুই যেন তার কাছে নতুন ভাবে আর্বিভূত হতে থাকে। তারপর সে সোজা গিয়ে দাঁড়ায় নিউ মার্কেটের মূল গেটে। হয়তো কারো জন্য সে অপেক্ষা করে। এবং তার কিছুক্ষণ পর সে অনেকের মাঝ থেকে বেছে নেয় একটি জুটিকে। অবশ্য জুটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সে প্রেমিক প্রেমিকাদেরই প্রাধান্য দেয় বেশী। তারপর চলতে শুরু করে তাদের পেছন পেছন! তারা যে দোকানে যায় ছেলেটিও যায় পিছু পিছু। ভাবটা এমন সেও এসেছে কেনাকাটা করতে। অবশ্য বেশীক্ষণ এমন চালাতে পারেনা সে। পাছে ধরে পরে যায় সেই ভাবনায়! তাই একসময় ফিরেও আসে কিংবা অন্য কোন জুটিকে বেছে নেয়। এই অল্প সময়েই ছেলেটি দেখে নেয় অনেক কিছু। নানান জনের নানান রকমের বায়নক্কা। এটা নাও,ওটা নিও না, এটা ভালো,ওটা ভালো না, এটা তোমার জন্য, ওটা তার জন্য। এমন আরো কতো কি! যে মজার ব্যাপারটি ছেলেটি আবিস্কার করে তা হলো, এই সব জুটিদের মধ্যেও ভেদ আছে। যেমন কেউ সবে প্রেম করতে চাইছে, কেউ চুটিয়ে প্রেম করছে, কেউ বা ভাঙ্গতে বসা প্রেমকে জোড়া লাগাবার চেষ্টা করছে, কেউ বা আবার পরকীয়াও করছে। আর সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো এদের সকলের কথাবার্তা, আচরণ আলাদা আলাদা রকমের, এমনকি দেয়া নেয়াটা পর্যন্ত।
ছেলেটি প্রায়ই এই কাজটি করে কিন্তু আশ্চর্যের হলো এদের কারো সাথেই ছেলেটির দ্বিতীয় বার আর দেখা হয়না। কিন্তু যে জীবন দর্শনকে সে আবিস্কার করে তা রোজই থাকে প্রায় একই রকম। ফিরে আসবার সময় একটি ভাবনাই ভাবিত করে ছেলেটিকে, প্রেমের ভেতর প্রেম ততটা কই, যতটা দেখি প্রয়োজন। প্রয়োজন নয়তো কি? কোনদিন ছেলেটি আসে মেয়েটির প্রয়োজনে। কোনদিন মেয়েটি ছেলেটির। জানি প্রেমিক প্রেমিকা মাত্রই একথার তুমুল প্রতিবাদ করবেন। হয়তো বা আপনারাই ঠিক। হয়তো এই প্রেমের ভেতরেই প্রয়োজনীয়তা,কিবাং প্রয়োজনীয়তার ভেতরেই প্রেম। অত ভাবতে ভালো লাগেনা ছেলেটির। রাত হয়ে আসে,তার বাড়ি ফেরার সময় হয়। তাছাড়া ততক্ষণে এই রাতের শহরটি যে আরো মহনীয় রুপে অপেক্ষা করে থাকে ছেলেটির জন্য। তাই সেই রাস্তায় এসে দাঁড়ায় রিক্সার জন্য। আর সেদিনই ঘটে যায় ঘটনাটি।
চলেব....