অন্যের জন্য জীবন
নাজীব মাহফুয
শেষ বিকেলে রোজকার পত্রিকায় চোখ বুলানো আব্দুর রাহমান আফেন্দীর বহুদিনের অভ্যেস। খুব জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাড়ীর লাগোয়া এই বাগানে সে হাঁটাহাঁটি করে, পত্রিকা পড়েই সময় কাটায়। সেপ্টেম্বর মাসের মনোরম এক বিকেলে নিত্যদিনের মতই সে বাগানের আনাচে কানাচে ঘুরে দেখছিল। ছোটবড় নানা বর্ণগন্ধের ফুল আর গোলাপঝাড়ে বর্ণিল হয়ে উঠেছিল বাগানটা। বাগানের একপ্রান্তে কাঁটা তারের বেড়া ওদের বাড়ীটাকে পাশের বাড়ীর সীমানা থেকে আলাদা করে রেখেছিল। সেখানে পাতা ইজি চেয়ারে প্রফুল্ল মনে বসে রাহমান। আয়েশী ভঙ্গিতে পেপারে চোখ রাখে। তার চলাফেরা, অঙ্গভঙ্গী খুব ধীরস্থির। সে একটি পরিবারের দায়িত্ববান, যতœশীল অভিভাবক। তার অবয়বে পৌরূষত্ব, সাহসিকতা আর উদারতার মিশ্রণ। ওর ঘনগোঁফ, বড় আকারের মাথা আর ভাবসাব দেখে মনে হবে চল্লিশ বছরে পৌঁছে গেছে সে অথচ সেই বয়স ছুঁতে এখনো পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে তাকে। খুব মনোযোগ দিয়ে সে পত্রিকা পড়ছিল হঠাৎ এক মিষ্টি কন্ঠের আওয়াজে তার মনোযোগ ভঙ্গ হয়।
“শুভ বিকেল আংকেল।”
চঞ্চল চিত্তে সে পত্রিকা থেকে মুখ তুলে পাশের বাড়ীর বাগানের দিকে তাকায়। একটি ফুটফুটে, গভীরকালো চোখের কিশোরী হাস্যজ্জ্বোল মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হালকা বাতাসে জেসমিন ফুলের গন্ধ তাকে আকুল করে তোলে। হাসিমুখে সে উত্তর দেয়,
“স্বাগতম মিস সামারা।”
মিষ্টি হেসে মেয়েটি তার ছোট সাদা কুকুরের সাথে খেলতে থাকে। সামারা ষোল বছরের উচ্ছল তরুণী, সদ্য কৈশোর পেরুনো, যৌবনের চিহ্ণ তার দেহমনে চমকাতে শুরু করেছে।
ছোট কুকুরটার দিকে ইঙ্গিত করে সে প্রশ্ন করে,
“আজ কেমন আছে ও?”
“আলহামদুলিল্লাহ, এখন সুস্থ।”
“মনে হয় আলেকজান্দ্রিয়ার আবহাওয়া ও সহ্য করতে পারছেনা।”
“না বরং বিপরীত।”
অপলক চেয়ে থাকে রাহমান এই অনিন্দ্য সুন্দরের দিকে। সামারা খুবই ফর্সা,রক্তিম আভা ওর চেহারাকে আকর্ষনীয় করে তুলেছে। যেন পূর্বদিগন্তে লালিমা ওর মুখে লেগে আছে।
“তুমি তো খুবই ফর্সা হয়ে উঠছ সামারা।”
রাহমানের প্রশংসায় লজ্জা পেয়ে আরো লাল হয়ে মুচকি হেসে ছোট কুকুরটাকে ধরতে ওর পিছু ছুটল। রাহমানের মনটা মোচড় দিয়ে উঠে। বাইরে বাইরে যতই সে গাম্ভীর্য দেখাক ভিতরে তারও একটা স্বপ্নিল প্রেমার্দ হৃদয় আছে। পেপারের আড়ালে চোরা দৃষ্টিতে সে উচ্ছল সামারাকেই দেখে। সামারা একটা চেয়ারে বসে কুকুরটা নিয়ে খেলছে, ওর লম্বা সাদা পশমে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর কুকুরটাও আহ্লাদে ওর সুন্দর হাতটা চাটছে, লাফ দিয়ে কোলে উঠছে। একসময় সামারার রেশমী চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়ে। ওর রক্তিম গালে চুলগুলো হুটোপুটি খায়। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পায় রাহমান। দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় ওর দিক থেকে। ছি: কেন সে লুকিয়ে দেখছে মেয়েটাকে। চোখের সামনেই বড় হয়ে উঠল মেয়েটি। পিতৃস্নেহেই দেখে আসছে তাকে। এমনকি মেয়েটি তাকে আংকেল ডাকে। পুতুল খেলা শৈশবে ওর মুখে মিষ্টি ডাক শুনে মনটা ভরে যেত তার। অবশ্য এখন তার ডাক শুনে সে আলোড়িত,উচ্ছ্বলিত সর্বোপরি ভীষণ আনন্দিত হয় সে।
আবার সে পূর্ণদৃষ্টিতে সামারাকে দেখে। এমন দৃষ্টি নিয়ে কখনোই এ মেয়েকে দেখেনি সে।
“আচ্ছা, একদিন সামারা আমার জীবনসঙ্গী হবে। এটা কি একেবারেই অসম্ভব ভাবনা ?!” মনে মনে ভাবে সে। আনমনেই আবার মাথা নাড়ে, “নাহ্ কোনভাবেই এটা বাস্তব হতে পারেনা। সত্যিই এটা অসম্ভব, অবাস্তব। তবু রাহমান বিনাতর্কে নিজের বিবেকের কাছে নতি স্বীকার করতে চায় না। আবার ভাবে,“কোন কারণটা সবচে বেশী বাধা?....বয়স...নি:সন্দেহে বয়স...সে ছত্রিশ বছরের আর সামারার সবে ষোল। মাঝের এই বিশটা বছরই সবচে বড় বাধা যা তাকে চাচাতে পরিণত করেছে। যাকে পিতৃজ্ঞান করেছে তাকে কি করে প্রিয়তম স্বামীরূপে গ্রহণ করবে মেয়েটি?! সত্যিই বয়সের পাহাড় ডিঙ্গিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব হয় না। কঠিন ত্যাগ স্বীকার না করলে এমনটা মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু এমন ত্যাগ কেইবা করতে চাইবে মূল্যবান কিছু পাবার আশায়?
প্রকৃত অর্থে সে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নগন্য কর্মচারী। আর তেমন অর্থসম্পদও নেই তার। তবুও সে মেয়েটিকে ভীষণ ভালোবাসতে শুরু করেছে। কি করে এই মোহ থেকে মুক্তি পাবে সে। যে মেয়ে ষোলটি বছর ধরে তার চোখের সামনেই একটু একটু করে বেড়ে উঠল, সম্ভব কি তাকে ভুলে থাকা! তার নিরস তিক্ত যৌবনে সেই একমাত্র নারী, ভাগ্যের বিড়ম্বনায় যাকে তার ভাল লাগতে শুরু করেছে। তার মনপ্রাণ সামারার প্রেমে নিমজ্জিত হয় প্রশান্ত হয়ে। ধৈর্যশীল চোখের পাতা ভিজে উঠে। নীল নদের শান্ত বাতাসে দীর্ঘক্ষণ সে বসেই থাকে ছোট বাগানে।
ছোট্টবেলায় সামারার শিশুমুখটা পরিতৃপ্ত করত তাকে। মনের মাঝে সুপ্ত ভালোবাসার বীজ জন্ম নেয় তখুনি। যখন থেকে সে তরুনী হয়ে উঠল তার উপস্থিতি তাকে চঞ্চল করে তোলে। পরিতৃপ্তি নয় শুরু হয় এক অদ্ভুত যন্ত্রণা তার সঙ্গে কথা বলার সময়। যদিও তাকে স্নেহ করে আগের মতই। ছোটবেলার মতই সে তাকে নিষ্পাপ চুমু দেয়, নারীসুলভ নয় বরং শিশুর মতই তার আচরণ। সে জানে রাহমান তার প্রিয় চাচা। এর চেয়ে বেশীও নয় কমও নয়। তাই সে এত সাবলীল তার কাছে। কেমন হবে তার প্রতিক্রিয়া, যদি সে কখনো তাকে প্রস্তাব দেয়? কেমন হবে তার অনুভূতি? পিতামাতাকে কি বলবে সে? নিজেকেই বা কি বলবে? প্রত্যাখ্যান করার পর আবার কি আগের মত তার সামনে আসবে? কথা বলবে এমন হাসিমুখে? এই যে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখে সে মনের সাধ মেটাতে পারছে আর কি পারবে তেমন? নাকি চিরদিনের মত তাকে ত্যাগ করবে।
মনে মনে সে সাহস সঞ্চার করে, সে নিশ্চয় মেয়ের বাবাকে বুঝাতে সক্ষম হবে। সে সমঝদার বন্ধু মানুষ। কিন্তু কি বলবে তাকে? কত কঠিন হবে কথাগুলো! অনেকক্ষণ ধরে সে ভাবে বিষয়টা। একসময় চোখ বুজে সে রিহার্সেল দেয় বন্ধুর সাথে কথোপকথনটা।
“প্রিয় বন্ধু! এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আজ আমি আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। অপ্রত্যাশিত এক আলোচনা যা কখনো ভাবতেই পারেননি। আমিও যা আগে ভাবতে পারিনি। এমন এক বিষয়ে আপনার মতামত জানতে এসেছি যা নিয়ে আমি বা আমার পরিবার আপনার কাছে কখনো আসবো, এমনটা ভাবাই যায় না। কিন্তু আমার একান্ত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার এ সূবর্ণ সুযোগ আমি হাত ছাড়া করতে চাই না। প্লিজ..আপনি আমার বন্ধু....
কথোপকথন শেষ না হতেই একটা মিষ্টি কন্ঠ তার দিবাস্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়।
আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?
চমকে উঠে সে কিছুটা ভয়ও পায়। সে কি শুনতে পেল তার মনের কথা।
“নাহ..ঘুমাইনি তো।”
“মাফ করবেন...আমি দেখলাম আপনি অনেকক্ষণ চোখ বুজে আছেন তাই ভাবলাম...
“আসলে আমি একটু চিন্তা করছিলাম..”
“কি নিয়ে এত ভাবছিলেন?”
উদ্বিগ্ন হয়ে সামারা তাকিয়ে আছে তার দিকে। ওর প্রশ্নের জবাবে কি বলবে সে?...বলবে কি তোমাকে নিয়ে এত চিন্তা?..এমন বলা ঠিক হবে না। নীরব থাকল সে। এই নিতান্ত বালিকার কাছে তার অস্থিরতার প্রকাশ হাস্যকর। ওর কালো গভীর চোখে হারিয়ে গেল সে। এক অপার্থিব আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। আশ্চর্য এই চোখ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারল না তখন। সামারার অদ্ভুত পরিবর্তন চোখে পড়ল তার, দেখল হঠাৎ ওর লাল গাল দুটো আরো রক্তিম হয়ে উঠল আর পাতলা ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল যখন বিস্মিত হয়ে ও ওর পিছনে কাউকে উপস্থিত হতে দেখল.....কিশোরীসুলভ চপলতায় এক দৌড়ে বাড়ির ভিতরে লুকালো সে। পিছনে তাকিয়েই চমকে উঠে দেখল তার ভাই নূর হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে সালামের জন্য। অজানা কারনে মনটা তার বিষন্ন হয়ে উঠল। ভয় আর আতঙ্কে তার হৃদয় কেঁপে উঠল। তবু সে মুখে হাসি ফুটিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে অভিনন্দন জানাল ভাইকে।
“আহলান! কি খবর ডক্টর? কেমন আছ?”
হেসে উঠল নূর। “কি যে বল ভাইয়া!”
“কত আনন্দিত তুমি!?”
সে বুঝল কি অর্থে এমন কথা বলল সে কিন্তু না বোঝার ভান করে বলল,
আনন্দিত?! কেন ? কিভাবে?
অবশ্যই। সামারার সঙ্গে যে গল্প করে সে আনন্দিত না হয়ে পারেই না।
খুব কষ্টে এক টুকরো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখে সে মনে মনে বলল, এই ছেলে হয় চতুর, দুষ্টু অথবা বোকা। না বুঝেই এসব কথা বলছে। প্রকৃত অর্থে সামারা যার সাথে কথা বলে সে সুখী নয় বরং সেই সুখী, যার সাথে কথা বলতে যেয়ে সামারা লজ্জা পায়, যার দিকে দৃষ্টি পড়তেই রক্তিম হয়ে উঠে আর ভীষণ লজ্জায় দৌড়ে পালায়। সে কি জানে না এই সহজ কথাটা নাকি সে তাকে বোকা ভেবে ঠাট্টা করছে?! সে চেষ্টা করল মনের অস্থিরতার কথা যেন ছোট ভাইয়ের কাছে প্রকাশ হয়ে না পড়ে। তাই ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা শুরু করে।
“ গত রাত কেমন কাটলো তোমার?
পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়ল।
“কলেজে কাল রাতে অনেক ধকল গেছে। প্রায় সারা রাতই জেগে থাকতে হয়েছে।”
আব্দুর রাহমান ভাইয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে পারছে না, তার মন ডুবে আছে অন্য চিন্তায়। ...আসলে তার মনটা খুব উদার। ভাইদেরকে খুবই ভালোবাসে। আর্থিক, মানসিক সবরকম সহযোগীতা দিয়েই সে তার ছোট তিনভাইকে মানুষ করে তুলেছে অপরিসীম ধৈর্য্যরে সাথে। কিন্তু এ ভাইটির প্রতি ইদানীং তার একধরণের ভয় বা আশংকা জেগেছে। হয়তো এর চেয়েও বেশী কিছু কিংবা বলা যায় এক ধরণের ঘৃণায় পোষন করে সে এর প্রতি। যেদিন থেকে ওর মুখে সামারার নাম শুনেছে সেদিন থেকেই সম্ভবত তাকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে। ওর অধিকাংশ কথাতেই সামারার নাম শুনলে মনে খুব কষ্ট হয় তার। বিশেষ করে একটু আগে এই দুই তরুন তরুনীর লাজুক দৃষ্টি বিনিময় তার মনকে বিক্ষিপ্ত করে তুলেছে।
এ ঘৃণা অবশ্যই তার ইচ্ছাকৃত বা মনের গভীর থেকে নয়। এ প্রসঙ্গ বাদ দিলে সে বরং তার ভাইকে খুব ভালোই বাসে। তার ভবিষ্যতের কথাও ভাবে। কি এক অস্থিরতা...আচ্ছা এই বুদ্ধিমান ছেলেটি কি তার বড় ভাইয়ের মনের কথা বুঝতে পেরেছে। না না এমন কখনো হতে পারেনা। সে কখনো দু:স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না এক বালিকাকে তার ভাই ভালোবাসে।
নূর তখন ভাবছিল তার সুখী সুন্দর ভবিষ্যতের কথা। ভাই কে বলল,
“আজ একটা জরুরী বিষয়ে কথা বলতে চাই ভাইয়া।”
মনের মধ্যে আবার মোচড় দিয়ে উঠে তার।
“বাহির থেকে এসেছ, পোষাক চেঞ্জ করে একটু বিশ্রাম কর তারপর না হয় কথা বলা যাবে।
কিন্তু সে খুবই আগ্রহী এখুনি তার কথা বলতে:
“এখুনি শুনুন ভাইয়া আমার কথা। খুব শীঘ্রই আমার জীবনযাত্রা হয়তো বদলে যাবে...
রাহমান চুপ করে শুনতে থাকল ভাইয়ের কথা।
“ আর কয় মাস পরই আমার ইন্টার্নীশিপ শেষ হবে। আমার শিক্ষক ড.ব্রাউন আমাকে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রেরিত দলের সদস্য নির্বাচিত করেছেন।”
খুব খুশী হলো সে ভাইয়ের কথা শুনে:
মুবারক! মুবারক! তুমি সত্যিই এ পদের যোগ্য।
কিন্তু নূরের চিন্তিত মুখ সত্যিই রাহমানকে ভীত করে তুলল, আর কি বলতে চায় সে? কারন এটাই তার জরুরী কথা নয়। আসল কথা অন্য কিছু। নিচুস্বরে নূর বলে,
কিন্তু আমি...মানে আমি বলতে চাইছিলাম যে ...আমি দেশের বাইরে একা যেতে চাই না।”
“বুঝলাম না কি বলতে চাইছ?”
না বোঝার ভান করলেও সে সবই বুঝতে পারছে কিন্তু তিক্ত বাস্তবের মুখোমুখি হতে সে ভয় পাচ্ছে। অপ্রস্তুত ভাব গোপন করে ছেলেটি এক নি:শ্বাসে বলে ফেলল,
“ইনশাল্লাহ আমি আমার জীবনসঙ্গিনীকে নিয়েই বিদেশ যেতে চাই।”
“ অবাক করলে! তুমি কি এই ব্যাপার নিয়ে ইতিমধ্যে কথাও বলেছ আর কারো সঙ্গে?”
“কখনোই না।”
“ তবে কি হঠাৎ করেই এমন সিদ্ধান্ত নিলে?”
“ না। এই সুযোগ পাবার অপেক্ষায় ছিলাম আমি তাই এতদিন প্রসঙ্গটা তুলিনি।”
“ তবে কি ধরে নেব তুমি কাউকে পছন্দও করে রেখেছ?”একটু ভেবে রাহমান বলল।
মুখ ঘুরিয়ে ইশারায় পাশের বাড়ি দেখিয়ে বলল,“সা মা রা....”
নিস্তব্ধ হয়ে গেল রাহমান। ভাইয়ের গম্ভীরতা উৎকন্ঠায় ফেলে দিল নূরকে। দু:খিত হয়ে সে জানতে চাইল,
“আপনার কি মত ভাইয়া?...আপনি কি আশা করেননি এমন..?
“ অতি উত্তম...খুব ভালো পছন্দ তোমার।” তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল রাহমান।
“ শুকরিয়া ভাইয়া...আমাকে মাফ করবেন..আপনি সম্মত থাকলে আগামী কালই আমরা তার বাবার কাছে যেতে পারি। আশা করি অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে না সেখানে।”
“ভালোই তো। কিন্তু এত তাড়াহুড়ো কেন নূর?”
“অবশ্যই দ্রুত সব কিছু সেরে ফেলতে হবে, আর মাত্র কয়েক মাস সময় আমার হাতে। এর মধ্যেই ইংল্যান্ড যাবার সব প্রস্তুতি আমাদের সম্পন্ন করতে হবে।”
“হানিমুনটা আমি দেশের বাইরেই করতে চাই।”
মুচকি হেসে ভাইকে ডেকে বাড়ির মধ্যে চলে গেল নূর...
ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকল রাহমান। উ™£ান্ত এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। অদ্ভুত এক নি:সঙ্গতা ঘিরে ধরল ওকে। দমবন্ধ সেই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পায়চারী করল বাগানের পথ ধরে। আবার বসে পড়ল চেয়ারে আশাহত, বেদনাহত আর অপমানিত হয়ে।
অতীতের কথা এসে পড়ল তার ভাবনায়....চোখের পলকেই যেন কেটে গেল বিশটি বছর। এই তো সেদিন সে ছিল উঠতি তরুন। যে বয়সে মানুষের জীবনটা থাকে এক তাল খামিরের মত যাকে যেমন ইচ্ছা তেমন গড়া যায়, কঠিন বাস্তবতা যে বয়সকে বিষন্ন করে তোলে না, সেই উচ্ছ্বল জীবনেই সে হয়ে পড়ে গম্ভীর, চিন্তাক্লিষ্ট। আনন্দে আর উচ্চাশায় পরিপূর্ণ ছিল তার কৈশোর। সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মে ছিল সে। বাবা মার প্রথম সন্তান হিসেবে ভীষণ আদর আর যতেœ শুরু হয় তার জীবন। খুব মনোযোগী আর মেধাবীও ছিল সহপাঠীদের মধ্যে। আলো ঝলমলে ভবিষ্যত অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। সাফল্যের পথে সে এগিয়ে আসছিল কিন্তু ভাগ্যের লিখন ছিল অন্যরকম। অসময়ে পিতার মৃত্যু তার জীবনকে লক্ষচ্যুত করে দেয়।
বিধবা মা আর ইয়াতিম তিন ভাইকে নিয়ে শুরু হয় আব্দুর রাহমানের জীবনসংগ্রাম। যৌবনের প্রারম্ভেই সামান্য বেতনে কর্মজীবনে প্রবেশ করে সে। এক প্রানবন্ত তরুনের আনন্দমুখরে জীবনে নেমে আসে সংসারের গুরু দায়িত্ব। সব উচ্চাকাংখা জলাঞ্জলী দিয়ে বাস্তবকে গ্রহণ করে। মন শক্ত করে কচি কাঁধে টেনে চলে অনেক বড় সব কর্তব্য। নিজের সুখের বিনিময়ে সে একটি পরিবারের সুখ দেখতে চেয়েছে। পরলোকগত পিতার সব দায় নিজের দায় মনে করেছে। ছোট চাকুরী নিয়েই সে মানিয়ে চলার চেষ্ঠা করেছে।
কত দুশ্চিন্তা আর উৎকন্ঠায় কেটেছে সেই সব দিনগুলো। মুখ বুজে বিনা প্রতিবাদে সে মেনে নিয়েছিল এত সব দায়িত্ব...কিন্তু কেন? কারন সে মহৎ হৃদয় আর স্নেহার্দ মনের অধিকারী। ভাইদের ফেলে সে নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে পারেনি। আস্তে আস্তে ভাইদের সাফল্যই তার নিজের সাফল্য আর সুখ মনে করেছে। সে শুধু বড়ভাইই নয় বাবার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সে পিতৃসুলভ ভালোবাসায় অনুভব করে তাদের জন্য। অফিস আর সংসারজীবনের হাজারো ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও সে একাকীত্বে ভুগত ভীষণ। তবু সে বিয়ের চিন্তা করেনি। সংসারের বোঝা বাড়ানোর সাহস তার হয়নি। ধৈর্য ধরে সে অপেক্ষা করেছে সুদিনের। অথচ তার ভাইয়েরা এতটুকুও ধৈর্য ধরেনি। এতটুকু সাহায্য করেনি তাকে। হয়ত এমনটাই জগতের নিয়ম। ওর দ্বিতীয় ভাইটি পুলিশ অফিসার হয়েই বিয়ে করে আলাদা হয়ে যায়। কোন প্রকার সাহায্য সে করে না ভাইকে। কিছুদিন পর তাকে অনুসরণ করে তৃতীয় ভাইটাও প্রকৌশলী হয়ে সরে পড়ে। রাহমান শুধু পারেনা সংসার ছেড়ে যেতে তাই এ মধ্যবয়সেও সে অবিবাহিত।
তারপর প্রেম এলো তার জীবনেও। জীবনকে পূর্ণ করার স্বপ্নে সে হলো বিভোর। যে প্রবল প্রেমে সে সুখ আর সান্ত্বণা দেখেছিল তা কতটা অসার হয়ে গেল।
স্বপ্ন আর দু:স্বপ্নের মাঝে সে যখন হাবুডুবু খাচ্ছিল তখন মমতামাখা একটা কন্ঠ তাকে জিজ্ঞেস করল:
“এই অন্ধকারে বসে কেন আব্দুহ?”
এটা তার প্রিয় আম্মার কন্ঠ....আরে.. রাত নেমে এসে অথচ সে একটুও টের পায়নি।
মায়ের সাথে বাড়ীর দিকে এগিয়ে যেতেই মা বললেন,
“নূর কি তোমায় কিছু বলেছে?”
“হুম..
“কি মত তোমার?”
“ওর পছন্দ খুব ভালো হয়েছে আম্মা। কালই আমরা ওদের বাড়ী যাব। আমাদের ব্রিলিয়ান্ট ছেলের জন্য ঐ সুন্দরী মেয়েকে আমাদের চাই।”
“শুধু তুমিই বাকী থাকলে বাবা!” নরম সুরে মা বললেন।
এরপর শুধুই নীরবতা...
কে বলতে পারে?....অতীতের দু:সহ কষ্ট আজকের কষ্টের কাছে হয়ত তুচ্ছ। তার মহৎ হৃদয় এবার সত্যিকারের পরীক্ষার মুখোমুখি হল। জীবন তাকে যেমন শিখিয়েছে ধৈযের্র গুরুত্ব, তেমনি শিখিয়েছে কোন কোন ব্যাপারে দেরী করতে নেই। জীবনের অভিজ্ঞতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে,সুখ সৌভাগ্য তার জন্য নয় ঐসব অন্যের জন্য।
(নোবেল বিজয়ী নাজীব মাহফুযের “হায়াত লিল গায়ের” গল্পের অনুবাদ। গল্পটি হামসুল জুনুন গ্রন্থ থেকে নেয়া।)
ডাকটিকিট(মার্চ ১২) এ প্রকাশিত
ভাষান্তর: তাসনীম আলম
ধষধসঃধংহরস@মসধরষ.পড়স