শাজনীনের মন খারাপ হয়ে গেল রিমার সঙ্গে কথা বলে, এই নিয়ে বেশ কজনের মুখেই সে এ কথা শুনেছে কিন্তু গায়ে মাখেনি। আজ মনে হচ্ছে একটা বিহিত করতেই হবে। কথাটা ওর মধ্যবয়সী ডাক্তার স্বামীকে নিয়ে। বয়সের খানিকটা ব্যবধান থাকলেও স্বামীকে নিয়ে সুখী সে। খুবই সাদামাটা একটা মানূষ ডাক্তার মাহমুদ আযমী। পড়াশোনা আর ডাক্তারি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কখনোই তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। এমন আটপৌড়ে অনাকর্ষনীয় মানুষকে নিয়ে এমন গুজব মেনে নেয়া যায় না তবু পুরুষ মানুষ বলে কথা। মাহমুদের এ্যাসিস্টেন্ট সালেমের কাছ থেকেও কৌশলে সে কিছুটা এমনই শুনেছে।
স্বামীর বিপরীত শাজনীন। সারাক্ষণ সাজগোজ আর বিলাসিতায় ব্যস্ত। সেদিন বিকেলে হঠাৎ করেই উপস্থিত হয় স্বামীর চেম্বারে। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে লক দেখে বিস্মিত হয়। তার সন্দেহ বাড়ে। সালেম দরজা খুলতেই ঝড়ের বেগে উপস্থিত হয় স্বামীর সামনে।
কি করছ তুমি এসময় দরজা বন্ধ করে।
তুমি এখানে! আদনানের আবার জ্বর এসেছে নাকি?
নাহ ছেলের অসুখের জন্য তোমার মত বড় ডাক্তারকে বিরক্ত করতে আসব না। আমি দেখতে এসেছি তুমি আজকাল রোগী ফেলে কি নিয়ে ব্যস্ত থাকো?
তুমি জানো শাজনীন আজ আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে বক্তৃতা দেয়ার কথা আছে। আমাকে বিরক্ত করো না প্লিজ।
কিন্তু আমি তো অন্যরকম কিছু শুনলাম। বন্ধু বান্ধবদের কাছে আমি মুখ দেখাতে পারছি না। এ বয়সে কি ভীমরতি হলো তোমার? জেনে রাখ তোমার মত মধ্যবয়সী, স্বনামধন্য, বিত্তবান পুরুষের সাথে প্রেম করা এখনকার মেয়েদের ফ্যাশন। শুধু টাকার জন্য ঐ বেয়াদব মেয়ে তোমাকে ভালোবাসে।
স্ত্রীর অহেতুক সন্দেহে বিরক্ত হয় মাহমুদ।
তুমিও কি তবে টাকার জন্য আমাকে বিয়ে করেছিলে? আর ঐ মেয়ে কিন্তু আমার চেয়েও ধনাঢ্য। যাই হোক এখন যাও আমি খুব ব্যস্ত। প্রবন্ধটা এখনও শেষ করতে পারিনি। পারলে আমাদের এতদিনের সম্পর্কের উপর আস্থা রাখ, শান্তি পাবে। আর যদি তুমি তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমার সেমিনারে যেতে তবে শুনতে আজ আমি মানুষের মনের উপর বয়স আর সময়ের প্রভাব নিয়েই বক্তব্য দিব।
দরকার নেই আমার ঐসব বস্তাপচা কথা শোনার। ঠিক আছে যাচ্ছি আমি কিন্তু তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি তোমার সবকিছু আমার আর আমার ছেলের নামে কালই তুমি লিখে দিবে তারপর যা খুশি কর।
যেমন এসেছিল তেমন করেই বেরিয়ে যায় শাজনীন। মিসেস সোবহানের মেয়ে লুলুকে চেনে সে। বড়লোকের আহ্লাদী মেয়ে। বেশকিছুদিন অসুস্থ ছিল । এই মেয়েই নাকি তার স্বামীকে ভালোবাসে প্রায়ই তার চেম্বারে আসে। এ কথা এখন পরিচিত মহলে কারো অজানা নয়। সব পার্টিতেই তাকে সবাই এ ইঙ্গিতই করে। অবশ্য সে মন থেকে এ কথা বিশ্বাস করতে পারেনা। মাহমুদের মত রাশভারী আমোদহীন মানুষ এমন কাজ করতে পারেনা।
শাজনীন যাবার কিছুপরেই চেম্বারে আসে লু লু । সেও বন্ধ দেখে চেম্বার। নক করতেই সালেম বলে, ডাক্তার সাহেব আজ বসবেন না চেম্বারে।
লুলূ তবু দরজায় নক করতেই থাকে। বহুতল ভবনের সপ্তম তলায় ডক্টর মাহমুদ আযমীর চেম্বার। লুলুর ক্রমাগত ধাক্কায় আশেপাশের সবাই বিরক্ত এবং বিস্মিত। বাধ্য হয়েই ডাক্তার সালেমকে দরজা খুলতে বললেন। সন্ধ্যে ছয়টায় তাকে পৌঁছতে হবে সেমিনারে কিন্তু এই অবুঝ নারীদের আচরণে সে মনোযোগ দিয়ে লেখাটা শেষ করতেও পারলো না। কিছুটা মানসিক অসুস্থতা থেকেই শারীরিক অসুস্থা নিয়ে লুলু মাস দুয়েক আগে তার মায়ের সাথে এসেছিল তার চেম্বারে। তবে এখন তার বাড়াবাড়ি আচরন তাকে চিন্তিত করে তুলছে। প্রতিদিনই সে আসবে তার কাছে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে বলে খুব কঠোরও হওয়া যায় না মেয়েটার প্রতি। অদ্ভুত সুন্দর একটা মেয়ে কিন্তু মানসিকভাবে সুস্থ নয়।
সালেম দেখে যাও তো। ইনি কি তোমার ডাক্তার সাহেবের ডুপ্লিকেট কপি। তুমি যে বললে তিনি আজ আসবেন না।
লুলুর কথায় সম্বিত ফিরে পান মাহমুদ। বসো লুলু। সালেম আমাদের কফি দাও।
কেন তুমি দরজা বন্ধ করে রেখেছ মাহমুদ। তুমি জানো না আমি এসময়ই আসি।
আমি ব্যস্ত লূলু। প্লিজ আমাকে বিরক্ত করো না। আর আমার নাম ধরেও তুমি ডাকবেনা। সে অধিকার শুধু আমার স্ত্রীর। তুমি জানো আমার একটা পরিবার আছে। সম্মান আছে। তোমার এই নাটক বন্ধ করো আর আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও।
কি বললে তুমি? আমি নাটক করছি? এতদিন পর তোমার এমন মনে হলো? ভন্ড তুমি, মিথ্যুক তুমি। কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে আগে। আমার যখন খুশি তখন নাকি তোমার কাছে আসতে পারি। কি প্রমাণ চাও তুমি বলো। কি করলে তুমি বিশ্বাস করবে আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি।
আপাতত তুমি চলে গেলেই আমি খুশী হবো লুলু। আজ আমার সত্যিই সময় নেই্। রোগীদের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলার শিক্ষাই আমি পেয়েছি।
সালেম কফি রেখে যায়। প্লিজ কফি খেয়ে উঠো আজকের মত। আবার দেখা হবে।
শান্ত হয়ে কফি খেতে খেতে লুলু বলে, আজকের পরে আর কখনো আমাদের দেখা হবে না।
এমন কথা তুমি আগেও বলেছ। আচ্ছা কাল না হোক পরশু না হয় তারপরদিন তুমি ঠিক চলে আসবে।
কফির কাপ রেখে লুলু এগিয়ে যায় গ্রিলবিহীন কাঁচের জানালার দিকে। ডক্টর মাহমুদ ব্যস্ত তার কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে।
মাহমুদ!
বলেছি তোমাকে এভাবে ডাকবে না আমাকে।
আমি তো আমার ড্রাইভারকে খুঁজছি। দু:খিত ওর নামও তোমার নামে।
আমার সৌভাগ্য!
মাহমুদ! প্রিয়তম আমার! চিরদিন তুমি শুধু আমারই।
লুলুর দিকে তাকাননি মাহমুদ। তাকালে দেখতে পেতেন সে উঠে দাঁড়িয়েছে জানালার উপর। লুলুর আর্তনাদ শুনে ওর দিকে তাকাতেই চোখের পলকে লাফিয়ে পড়ে শীর্ণকায়া মেয়েটি।
লুলুর আত্মহত্যার জন্য তার পরিবার ডাক্তারকে দায়ী করেনি কোনভাবেই। তবে এ মেয়েটির মৃত্যুতে আমূল বদলে গেছেন ডাক্তার মাহমুদ। তার ব্যস্ততা বেড়েছে দিগুন। দিনদিন তার মহিলা রোগীর সংখ্যাই বাড়ছে। বহুল আলোচিত এ ঘটনার পর সবাই যেন একবার দেখতে চায় সুন্দরী অল্পবয়স্কা বিত্তবান মেয়েটি কি পেয়েছিল এই মানুষটার মধ্যে। ডাক্তারের চেম্বারে লুলুর এক বিশাল ছবি বাঁধাই করা। খুব সুন্দর করে তিনি যেমন চেম্বারটাকে সাজিয়েছেন তেমনি তিনি নিজের প্রতি হয়েছেন অধিক যতœশীল। লুলুর অমূল্য ভালোবাসার মূল্য দিয়ে তিনি যেন নিজেকে লুলুর উপযুক্ত করেই সাজিয়ে রাখছেন। শাজনীনও পাল্টে গেছে স্বামীর মত। মাহমুদের বয়স যেমন দশবছর কমে গেছে তেমনি তার বয়স যেন দশবছর বেড়ে গেছে এক ধাক্কায়। তার সহজ সরল অনুগত স্বামীটি বড় বদলে গেছে। তার দিকে কখনো ঘুরেই তাকায় না এখন। ক্লাব, শপিং, পার্লাার কোন কিছুই আর তার ভালো লাগে না। সবাই যেন তাকে দেখে মুখ টিপে হাসে। জীবিত লুলুর চেয়ে মৃত লুলুই তার স্বামীকে বেশী দখল করে নিয়েছে।
একদিন এক অনুষ্ঠানে শাজনীন আর মাহমুদের দেখা হয় মিসেস সোবহানের সাথে। প্রথমে এড়িয়ে গেলেও পরে কথা হয় তাদের। উভয়ে উভয়কে সান্ত্বনা জানান। মাহমুদের আড়ালে শাজনীন অনুরোধ করে মিসেস সোবহানকে তিনি যেন তাকে অনুরোধ করেন মেয়ের ছবি তার চেম্বার থেকে সরিয়ে ফেলতে। যাবার সময় অপেক্ষা করতে দেখে শাজনীন বলে,
মিসেস সোবহান! বাড়ী যাবেন না। আপনার গাড়ী কোথায়।
আমার এখন গাড়ী নেই। হঠাৎ করে মাহমুদ চলে যাবার পর গাড়ী আমার ছোট মেয়েই ড্রাইভ করত। ও আর কোন ড্রাইভার রাখতে রাযী হয়নি। ও চলে যাবার পর আমিও আর ড্রাইভার রাখিনি। বড় মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। ও আমাকে নিতে আসবে।
মাহমুদ মানে? মাহমুদ কে?
সরি। মাহমুদ ছিল আমাদের ড্রাইভার। খুবই ভালো ছিল সে। ভালো ছাত্রও ছিল। একদিন কিছু না বলেই চলে গিয়েছিল। অবশ্য লুলুর মৃত্যুর পর ও আমার কাছে এসে মাফ চেয়ে খুব কেঁদেছিল। লুলুর মৃত্যুতে সে খুব কষ্ট পেয়েছিল। কেই বা কষ্ট পাবে না এমন মৃত্যুতে।
শাজনীন কিছু একটা আবিস্কারের আনন্দে মনে মনে লাফিয়ে উঠে।
ঠিক আছে মিসেস। আবার দেখা হবে।
মাহমুদ তুমি কত গাধা আর আহাম্মক। গাড়ীতে বসেই বলে শাজনীন।
মাহমুদ অবাক হয়ে যায় শাজনীনের এমন কথা শুনে। আজকাল তাদের প্রয়োজনের বাইরে তেমন কথাই হয় না।
আমি বুঝতে পারছিনা তুমি কেন এ কথা বলছ?
ভেবেছ তুমি কোন সুন্দরীর ভালোবাসা পাবার যোগ্য? কখখনো নয়। লুলু তোমাকে ভালোবেসে মরেনি ডক্টর মাহমুদ। সে ভালোবাসত তার ড্রাইভার সুদর্শন যুবক মাহমুদকে। কিন্তু কোন কারনে ওর হঠাৎ চলে যাওয়াই লুলূ প্রতিশোধ নিতেই তোমাকে বেছে নেয়। সে মাহমুদকে দেখিয়ে দেয় তাকে ভালোবেসে মরেনি সে। সে ছোট হতে চায়নি মাহমুদের কাছে। কিন্তু মাহমুদ ঠিকই বুঝেছে লুলু কার জন্য মরেছে। ও তোমাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে শুধুমাত্র।
মাহমুদের যেন চেতনা ফিরে, মনে পড়ে যায় আত্মহত্যা করার আগে লুলু তো বলেছিল তার ড্রাইভারের নামও মাহমুদ। তবে কি শাজনীনের কথায় ঠিক।
পরদিন মাহমুদ চেম্বারে বসে মনমরা হয়ে। লুলুর মৃত্যু নিয়ে সে নতুন করে ভাবছে। ভালোবাসা কি সে বোঝে না। তবু একটি মৃত মেয়ের ভালোবাসার জন্যই তো সে বদলে ফেলতে পেরেছিল নিেেজকে। ভালোবাসার এমনই শক্তি।
একজন ভদ্রমহিলা দেখা করতে চান স্যার। সালেম এসে বলে।
তোমাকে না বলেছি আজ আমি কারো সঙ্গে দেখা করব না।
আমি বলেছি কিন্তু তিনি কিছুই শুনতে চাইছেন না।
আচ্ছা পাঠিয়ে দাও। তবে আর কাউকেই নয় বুঝলে।
সরি ডক্টর। আমি অনেক দূর থেকে এসেছি তাই জোর করেই ঢুকে পড়লাম। কিন্তু আমি আশাহত।
ভীষন স্মার্ট আর আধুনিকা মেয়েটি এগিয়ে যায় লুলুর ছবির দিকে। আহ্ কত বোকা মেয়েটি।
সরি মিস। আমি বুঝতে পারছি না আপনার কথা। কেন আশাহত আপনি।
আমি যাবার অনুমতি চাচ্ছি ডক্টর। আপনি কষ্ট পান এমন কিছু আমাকে বলতে চাই না। আপনাকে দেখার বড় কৌতুহল ছিল।
বলুন যা বলতে চান আমি কোন কথায় কষ্ট পাবো না।
মেয়েটি কেন আপনার মত একজন মানুষের জন্য সুন্দর জীবনটা উৎসর্গ করল। আফসোস তার জন্য বড়ই আফসোস। বলেই মেয়েটি বেরিয়ে গেল।
ডক্টর মাহমুদ লুলুর ছবিটা খুলে ঐ জানালা দিয়েই ছুড়ে ফেলে দিলেন যেখান দিয়ে কয়েকমাস আগে লুলু লাফিয়ে পড়েছিল।
[email protected]
(মিশরীয় নাট্যকার তাওফীক আল হাকিমের নাটকের ছায়া অবলম্বনে)